আড়িপাতার সফটওয়্যারে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কি মার্কিন অভিযান শুরু
ফোনে আড়িপাতার প্রযুক্তি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ চলতি বছর আলোচনায় এসেছে। এমন প্রযুক্তি যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে না, তা ইসরায়েলের এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের যৌথ অনুসন্ধানের কল্যাণে এমন কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে এসেছে। গত জুলাইয়ে বিষয়টি সামনে আনে তারা।
প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুসন্ধানের পর বলা হয়েছিল, এনএসও গ্রুপ তাদের সফটওয়্যার বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে। এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসোগির ঘনিষ্ঠজন, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, বিরোধী রাজনীতিকের ফোনে আড়িপাতা হয়েছে।
খাসোগির ঘনিষ্ঠজনদের ফোনে কে আড়ি পেতেছিল, সেটা স্পষ্ট নয়। এনএসও বলেছে, তারা খাসোগির ঘনিষ্ঠজনদের ফোনে আড়ি পাতেনি। এ নিয়ে তদন্তেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এনএসও। তাদের প্রতিশ্রুতিতে আরও বলা হয়েছে, কোনো দেশের সরকার যদি এই আড়িপাতার কোনো ঘটনায় তদন্ত করে, তবে সহযোগিতা করবে ইসরায়েলের এই প্রতিষ্ঠানটি।
এনএসও গ্রুপের পেগাসাস সফটওয়্যার নিয়ে বিতর্ক কয়েক বছর ধরে চলছে। গত নভেম্বর নাগাদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এনএসওকে কালো তালিকাভুক্ত করে মার্কিন সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের অভিযোগ, এনএসওর কর্মকাণ্ড তাদের পররাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত স্বার্থবিরোধী। এ ছাড়া গত নভেম্বরে আরও দুটি আড়িপাতার প্রযুক্তি তৈরিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তর।
কোনো ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপ অস্বাভাবিক। এ ছাড়া এনএসওর পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, বাইডেন প্রশাসনের এমন কর্মকাণ্ডে ‘হতাশ’ তারা। সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত স্বার্থ ও নীতিকে সমর্থন করে এমন প্রযুক্তিই তৈরি করেছে এনএসও।
কিন্তু চলতি ডিসেম্বরে এনএসওকে নিয়ে আবারও বিতর্ক শুরু হয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কমপক্ষে নয়জন কর্মকর্তার ফোন হ্যাক করা হয়েছে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠানের তৈরি আড়িপাতার সফটওয়্যার ব্যবহার করে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন আইনপ্রণেতা ট্রেজারি (রাজস্ব) দপ্তর ও পররাষ্ট্র দপ্তরকে চিঠি দেয়, এনএসও ও এর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্লোবাল ম্যাগনিস্কি আইনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক (মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এই আইনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আইনে অনুসারে, অভিযুক্ত ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দ করা হবে এবং ওই ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারবে না)।
এনএসও গ্রুপ নিয়ে চলতি সপ্তাহে আরেকটি তথ্য সামনে আসে। ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়, কানাডার টরন্টোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সিটিজেনল্যাবের ফরেনসিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, খাসোগিকে হত্যার মাত্র এক মাস আগে তাঁর এক ঘনিষ্ঠজনের মুঠোফোন হ্যাক করা হয়েছিল।
এসব গেল চলতি বছরের কর্মকাণ্ড। নতুন বছর আসছে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, বাইডেন প্রশাসন এমন আড়িপাতার সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও পদক্ষেপ নিতে পারে আগামী বছর। আইনত যারা বৈধভাবে বা যারা কালোবাজারে বিক্রি করে— সবার ক্ষেত্রেই এমন পদক্ষেপ নিতে পারে তারা।
সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন আটলান্টিক কাউন্সিলের সাইবার স্টেটক্রাফ্ট ইনিশিয়েটিভের ফেলো উইনোনা ডিসোম্ব্রে। বিশ্বের ২২৪টি সাইবার-সার্ভিল্যান্স প্রতিষ্ঠানের ২০ বছরের তথ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন তিনি। উইনোনা বলেন, একটি ট্যাংক বানানোর চেয়ে একটি সফটওয়্যারের জন্য কোড লেখা সহজ, একটি নজরদারি বা আড়িপাতার সফটওয়্যার তৈরি করা সহজ। তিনি বলেন, এনএসও এবং অন্য দুই প্রতিষ্ঠানকে মার্কিন সরকারে যে কালো তালিকাভুক্ত করেছে, তা একটি কার্যকর পদক্ষেপ। এর ফলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা করা কঠিন হবে।
তবে উইনোনা ডিসোম্ব্রে এ–ও বলেছেন, এনএসওর মতো আরও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে খুবই নগণ্য। এই প্রতিষ্ঠানগুলো কী কী করতে পারবে, তার একটি সীমা তৈরি করে দিতে হবে আইনপ্রণেতাদের।
আরেক দল বিশেষজ্ঞ বলছেন, মানবাধিকার ইস্যুতে এসব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান যে হুমকি দিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের পদক্ষেপ নগণ্য। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ল স্কুলের সেন্টার ফর গ্লোবাল লিগ্যাল চ্যালেঞ্জেসের পরিচালক ওনা এ হ্যাটাওয়ে বলেন, ‘পেগাসাসের মাধ্যমে পররাষ্ট্র দপ্তরের নয়জন কর্মকর্তার মুঠোফোন হ্যাক করে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে আমরা কতটা ঝুঁকিতে।’ তিনি আরও বলেন, সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের অপরাধ চিহ্নিত করতে পারে এবং তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। তবে এই সংকট সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন বলে অভিমত তাঁর।
বেসরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, এমনটা নয়। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপল মামলা করেছে এনএসওর বিরুদ্ধে।
সরকারি পদক্ষেপও বাড়ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সাইবারজগতে এমন আড়িপাতার প্রযুক্তির বিস্তার যাতে কমে, এ জন্য মিত্রদের পাশে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র সম্মেলনেও এমন কথা বলেছে বাইডেন প্রশাসন। তাঁর প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মানবাধিকার কর্মসূচি ও পণ্য রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হবে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক ও নরওয়ের পক্ষ থেকে। নজরদারি এমন প্রযুক্তি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে দেশগুলো। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাসী সরকারেরা যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, এমন প্রযুক্তি রপ্তানিতেও নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশগুলো। এমন পদক্ষেপে সমর্থন দিয়েছে কানাডা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্য।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা