আমেরিকার বাস্তব চিত্র
মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে ভাইয়া দেশ থেকে আমেরিকা এসেছেন। প্রথম দিনের ঘটনা দিয়ে শুরু করি—প্রথম দিন রাতে নিউইয়র্ক, তথা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত জায়গায় নিয়ে গেলাম। টাইমস স্কয়ারের আশপাশের এলাকায় ঘোরাঘুরি করছি। হঠাৎ তিনি বিস্ময়ে চমকে উঠে বললেন, ‘হায় এরা কারা? এরা এখানে এভাবে পড়ে আছে কেন?’ আমি বললাম, ‘এদের ঘরবাড়ি নেই; রাস্তাতেই বসবাস। ভদ্র আমেরিকানরা এই মানুষগুলোর নাম দিয়েছে “হোমলেস”; বাংলাদেশে আমরা যাদের বলি বাস্তুহারা।’
আমেরিকার মতো এত উন্নত দেশে এবং পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত জায়গায় হোমলেস মানুষগুলোকে দেখে তিনি বিস্ময়ে পাগলপ্রায়। উন্নত দেশে সাধারণত উন্নত জীবন ব্যবস্থা থাকার কথা। কিন্তু আমেরিকাতেও অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশের মতো অনেক কর্মকাণ্ড চলে শুনলে বা নিজের চোখে দেখলেও অনেকে যা বিশ্বাস করবে না। আমার ভাইয়ের বিশ্বাসে আঘাত লেগেছে। প্রতিনিয়ত তিনি বুঝতে শিখছেন, নিজের চোখে দেখছেন আসল আমেরিকা, বাস্তব আমেরিকা। সেই সঙ্গে তাঁর ভেতরে প্রাণের দেশ, বাংলাদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে, যা গত কয়েক বছরে আমার হৃদয়ে জমা হয়েছে।
বাস্তবের আমেরিকা সম্পর্কেই আজ লিখব। আমেরিকার গুণগান গেয়ে অনেকেই লেখেন, লিখেছেন ও লিখবেন। আমি না হয় আমেরিকার বাস্তবতা সম্পর্কে লিখলাম। লেখার আগেই ক্ষমা প্রার্থনা করছি সেসব মানুষের কাছে, যাদের মনে গভীর আমেরিকা প্রীতি রয়েছে। বিষয় ‘আমেরিকার বাস্তবতা’ হলেও এর বিষয়বস্তুর অধিকাংশই কিন্তু নিউইয়র্ককেন্দ্রিক। কারণ, আমার বাস আমেরিকার নিউইয়র্কে। আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্য জীবনযাত্রার দিক থেকে অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা। অঙ্গরাজ্যভেদে আইন-কানুনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরাট পার্থক্যও রয়েছে।
এমনও অনেক অসংগতি, অন্যায়, অনিয়ম, সামাজিক অবিচার আছে, যা বাংলাদেশ ও আমেরিকা দু জায়গাতেই আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা নেতিবাচক কিন্তু আমেরিকার ক্ষেত্রে তাকেই ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমেরিকায় অসংগতি বাংলাদেশকেও ছাড়িয়ে যায়। আমেরিকা উন্নত দেশ বলে এসব আমাদের চোখে সহজে ধরা দেয় না। মানুষের চিন্তাপদ্ধতির এমন রকমফেরের কারণ নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারবেন। সে যা-ই হোক; কিছু অসংগতির কথা তুলে ধরা যাক—
চিকিৎসা
সবাই জানে আমেরিকায় চিকিৎসা সেবা ফ্রি। আসলেই কি ফ্রি? উত্তর হচ্ছে, ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। সবার জন্য ফ্রি না। আবার বিনা মূল্য যে চিকিৎসা পাওয়া যায়, তারও একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যারা বিনা মূল্য চিকিৎসা সেবা পায়, তাদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নির্ধারিত থাকে। মেডিকেইডের আওতাধীনরাও কিন্তু সব ধরনের চিকিৎসা বিনা মূল্যে নিতে পারেন না। কারা ফ্রি চিকিৎসার আওতাভুক্ত এবং কারা নয়—এই সম্পর্কে লিখতে গেলে অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে লেখা। শুধু এটুকু বলা যায়, নিম্ন মধ্যবিত্তরাই ফ্রি চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকেন। আবার অঙ্গরাজ্যভেদে এই আইনেও রয়েছে ভিন্নতা। কিছু অঙ্গরাজ্যে আবার ফ্রি চিকিৎসা বলতে কিছু নেই। তা ছাড়া এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে ভুল চিকিৎসার কারণে সবচেয়ে বেশি রোগী মারা যায় আমেরিকাতেই। এখানে চিকিৎসা-সংক্রান্ত ভুলের কারণে গড়ে প্রতিদিন ৭০০ জন মানুষ মারা যায়, যা বছরে হওয়া মোট মৃত্যুর সাড়ে ৯ শতাংশ। জন হপকিন্স পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকায় প্রতি বছর গড়ে চিকিৎসা-সংক্রান্ত ভুলে মারা যায় আড়াই লাখ মানুষ।
ট্রাফিক জ্যাম
বাংলাদেশে ট্রাফিক জ্যাম এক বিরাট সমস্যা। নিউইয়র্কেও কিন্তু ট্রাফিক জ্যাম হয়। বাংলাদেশের মতো এত ভয়াবহ না হলেও খুব যে আরামদায়ক তা নয়। রাত ২টার সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকতে হয় অনেক সময়। কোনো কোনো ট্রাফিক জ্যাম এত দীর্ঘ হয় যে, দু মাইল পথ পেরোতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় বসে থাকতে হয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের ওয়েবসাইটে বিশ্বের ভয়াবহ যানজটের শহরের তালিকা প্রকাশ করেছে।
এ নিয়ে গবেষণা করেছে ইনরিক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ট্রাফিক স্কোরকার্ড প্রকাশের জন্য বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালে ১ হাজার ৬৪টি শহরের ওপর গবেষণা চালায়। ইনরিক্সের পরিসংখ্যানে যানজটের জন্য বিশ্বের শীর্ষ ১০ শহরের তালিকায় রয়েছে আমেরিকারই চারটি শহর। তালিকায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেস, যেখানকার গাড়ি চালকদের প্রতি বছর পিক আওয়ারে ১০৪ ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকতে হয়। এই তালিকায় নিউইয়র্কের স্থান তৃতীয়। শুধু গাড়ি নয় ট্রেনেও একই রকম পরিস্থিতি হয়। ট্রেনে যাতায়াতে আরও অনেক সাধারণ সমস্যা হয়।
সপ্তাহের শনি ও রোববার ট্রেন চলাচল খুব ধীর গতির হয়। সবগুলো রুটে বন্ধ থাকে এক্সপেস ট্রেন। নিউইয়র্ক নগরীর প্রায় প্রতিটি সাবওয়ে (ট্রেন স্টেশন) লাইনে প্রতি বছর কাজ লেগেই থাকে। শুধু ট্রেন নয়, রাস্তাঘাটেও প্রতিনিয়ত খোঁড়াখুঁড়ি লেগে থাকে। একদিকে কাজ শেষ হয়, তো আরেক দিকে শুরু হয়। এভাবে প্রতি বছর কন্সট্রাকশন লেগেই থাকে। প্রেসিডেন্ট ডিসি থেকে নিউইয়র্কে যেদিন আসেন, সেদিন নিউইয়র্কের ট্রাফিক ব্যবস্থা কেমন হয়—একমাত্র যারা গাড়ি নিয়ে বাইরে বের হন, তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন।
এই সাধারণ সমস্যাগুলো আমরা খুব সাধারণভাবেই চিন্তা করি। কিন্তু একই সমস্যা বাংলাদেশে হলে আমাদের মুখ থেকে দেশ সম্পর্কে শুধু নেতিবাচক মন্তব্য বের হয়। অথচ এই সাধারণ সমস্যাগুলোর সম্মুখীন আমরা প্রতিদিন হচ্ছি আমেরিকাতেও।
জরুরি সেবা
আমেরিকাতে ৯১১ সার্ভিসের কথা কে না জানে? জরুরি যেকোনো প্রয়োজনে পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার সার্ভিস মুহূর্তের মধ্যেই এসে হাজির। কিন্তু মাঝেমধ্যে এর ব্যতিক্রম হয়। অনেক সময় রাস্তায় ছোটখাটো গাড়ি দুর্ঘটনায় পুলিশ আসতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়। জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার পর চিকিৎসক এসে আপনাকে দেখবে। কখনো কখনো ৭-৮ ঘণ্টা লেগে যায়। অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের পরিস্থিতি হয়তো ভিন্নতা হতে পারে। কিন্তু নিউইয়র্কের বাস্তবতা এমনই। একমাত্র অ্যাম্বুলেন্সে করে যদি হাসপাতালে যান, তাহলে আপনি দ্রুত সেবা পাবেন; না হলে নয়।
নিরাপত্তা
নিউইয়র্ক কি সবার জন্য নিরাপদ? ব্রঙ্কস, ব্রুকলিনের অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষ যেতে ভয় পায়। কেউ কেউ আছেন, ব্রঙ্কসের নাম শুনলেই ভয় পান। আসলেই ভয় পাওয়ার মতো বিষয়। এসব জায়গায় দিনে-দুপুরে আপনার ওপর হামলার আশঙ্কা রয়েছে। নিউইয়র্কে বসবাস করা যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে এ কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। আমেরিকানদের রক্তে বর্ণবাদ মিশে গেছে। ইদানীংকালে ‘হেট ক্রাইম’-এর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এ ধরনের অপরাধের শিকার হয়ে নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশিদের নামও রয়েছে। অনুসন্ধানী পত্রিকা মাদার জোনসের তথ্যমতে, ১৯৮২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পুরো আমেরিকায় বন্ধুকধারীর গুলিতে গণহারে হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১১৪টি। এসব হামলায় নিহতের সংখ্যা ৯৩২। সেফটি রেটিং নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট সেফঅ্যারাউন্ড-এর রেটিং এ বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশ আইসল্যান্ড। ওই তালিকায় আমেরিকার অবস্থান ৪৯তম, যা আফ্রিকার দেশ ঘানারও নিচে।