আমি যখন প্রথম আমেরিকায় আসি, তখন নিউইয়র্কে অফিশিয়ালি বসন্তকাল। তবে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দর থেকে ব্রুকলিনের রাস্তার দুপাশের গাছগুলো তখনো ধূসর বর্ণ, ন্যাড়া, কঙ্কালসম। বসন্ত মানে যে ফুলের সম্ভার, পাখির কলকাকলী, তার কিছুই নাই। অল্পবিস্তর কিছু গাছ গোলাপি ফুলে সেজেছে। কোকিল তো নেই। কোনো পাখি ও চোখে পড়ল না।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘আসে বসন্ত ফুল বনে, সাজে বনভূমি সুন্দরী।’
নজরুলের এই গানের সঙ্গে কোনো মিল নেই। মনে মনে ভাবলাম, এ যে কোন দেশ! কোথায় যে আসলাম! এমন ধূসর বসন্ত কাল। পরদিন সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিসে গেলাম। এত নিয়মকানুন! রেশনের দোকানের লাইনের মতো লম্বা লাইন দিয়ে ঢুকতে হলো। আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় তখনো ইংরেজি শ্রবণে দক্ষ না, তাই প্রতিটি বাক্য দুবার করে শুনে নিশ্চিত হতে হলো। যা হোক, একপর্যায়ে সব কাজ শেষ হলো। ওরা বলে দিল, এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে ডাকযোগে আমরা সোশ্যাল সিকিউরিটি পেয়ে যাব। আমরা সাবওয়েতে ট্রেন ধরে ফিরলাম। পথে ট্রেন নদী পার হচ্ছিল যখন, তখন দেখলাম ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’। হালকা সবুজ এক বিশাল মূর্তি নদীর মধ্যখানে দাঁড়ানো।
নিউইয়র্কে এখন বসন্ত। তবে এখনো প্রচুর ঠান্ডা। তার মধ্যে এক/দুই দিন তাপমাত্রা বেড়েছিল। কিছু গাছে ফুল কলি মেলেছে। সাদা আর গোলাপি চেরি ফুলে গাছগুলো ছেয়ে গেছে। নিউইয়র্কের নববর্ষ উদ্যাপনে নানা আয়োজন চলছে। এখানে প্রথম এসে আমি রীতিমতো অবাক। কাউকে দাওয়াত দিলে টেবিলে জায়গা হয় না, এত রান্না। ভাবতাম জিন ভূত আছে মনে হয়। নতুবা পরি। তারপর আস্তে আস্তে জানলাম, দাওয়াতিরা সবাই এক বা দুই আইটেম রান্না করে নিয়ে আসেন। যেমন কেউ চিকেন রোস্ট আর আলুর চপ। কেউ পোলাও আর গরুর মাংস। দশজন আনলেন বিশ পদ খাবার। বিষয়টা বেশ। বাচ্চাদের স্কুলে একটা স্লোগান ছিল, ‘টুগেদার উই আর পাওয়ার’। এই যে মিলে–মিশে বিরাট শক্তি, এটা আমার খুবই ভালো লাগে। এই বিষয়টাও ‘টুগেদার উই আর পাওয়া’–এর মতোই। একসঙ্গে কমিউনিটির সবাই মিলে গানবাজনা, খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, হইহুল্লোড়। আর ছবি তোলা।
‘আইলো রে বৈশাখ
গাছের ডালে আমের মুকুল,
আকাশ মেঘে সাজলো দুপুর
হালখাতা সব হিসেব শেষে,
আসলো বছর নতুন বেশে
এক বাণীতে সব বাঙালি খুশির মেলায় দেশটা হাসে
আইলো আইলো রে বৈশাখ আইল রে।’
আমেরিকায় আসার পর আমি একটা কলেজে ভর্তি হই। ক্লাস করতে গিয়ে দেখা পেলাম নানা বর্ণের, নানা আকৃতির মানুষের। অনেক দেশের মানুষের। বহুজাতিক দেশ বলে কথা। কিছু বাংলাদেশি আর কিছু পাকিস্তানিও আছে। দেখলাম, কয়েকজন বাংলাদেশি মহিলা পাকিস্তানিদের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলছে। আমার মন ভারাক্রান্ত হলো। আমার মন বলছিল, কই পাকিস্তানিরা তো বাংলায় কথা বলছে না! কিছুদিন পর বাংলা ভাষাভাষী বোনদের ডেকে বললাম, তোমরা কেন উর্দুতে কথা বলছ? কই পাকিস্তানিরা কি বাংলা বলছে? ওরাতো বাংলা বলছে না।
১৯৭১ আমাদের অহংকার। আমরা সেই জাতি, যারা অধিকার আদায়ে নয় মাস যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতা কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। রক্ত দিয়েছে আমার ভাই। সম্ভ্রম হারিয়েছে আমার বোন। এটা কোনো রসিকতা না। আমার ভাইবোনের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এক মূল্যবান অর্জন। আমাদের মনে রাখতে হবে সব সময় এই কথা, আমেরিকায় এসেছি। জীবনের প্রয়োজনে ইংরেজি বলতে হয়, বলব। এটা আন্তর্জাতিক ভাষা। কিন্তু উর্দু না।
আমাদের প্রাণ আর রক্ত দেওয়ার ইতিহাস আমাদের গৌরব। ১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি ভাষার জন্য। এ ইতিহাস আর কোনো জাতির নাই। বাংলায় কথা বলার জন্য প্রাণ দেন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত প্রমুখ। তাঁদের ভুলে গিয়ে ইতিহাস কলঙ্কিত করা উচিত নয়। দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছি বলে নিজের ইতিহাসকে নুয়ে পড়তে দেব না কখনো। দরকার হলে পাকিস্তানিরা বাংলা বলুক, আমরা উর্দু বলব না।