আকাশপরি
আমার জন্মের পর প্রথমবারের মতো ১৯৬৪ সালের গোড়ার দিকে আমাদের ঢাকার পাট চুকল। আব্বার বদলি হলো; সেটা আবার প্রমোশনের সঙ্গে। তাঁর নতুন কর্মস্থল যশোর। আমার তখন যে বয়স, বদলিও বুঝি না, প্রমোশনও না। তাতে কী? নতুন জায়গায় যাবার আনন্দই আলাদা। খবর শোনা মাত্র ঘুমটুম চলে গেল। আব্বা চলে গেলেন কিছুদিন আগে। না, বাড়িঘর খোঁজা, ভাড়া নেওয়া ওসবের জন্য নয়। ওসবের ব্যবস্থা সরকার করে রাখত। আব্বা আগেভাগে গেলেন আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে এই পরিবর্তনের ধাক্কা আম্মা, আর আমাদের ওপর থেকে কিছুটা কমিয়ে আনার জন্য। খাট-পালং, বাসন-পাতি, কাপড়-চোপড় সব বেঁধে ছেঁদে সেগুলো অফিসের লোকের কাছে সমঝে দিয়ে আম্মা আমাদের নিয়ে রওনা হলেন সপ্তাখানেক পর; বুবু তখন নয়, আমি কেবল পাঁচ পেরিয়েছি। আর ছোট বোনটি তখনো দুইয়ে পৌঁছেনি। আমার প্রথম প্লেন-যাত্রা। না, ওই বয়েসের স্মৃতি অবশ্যই আমার নিজের পুরোটা নয়। বড়দের থেকেই বিভিন্ন সময়ে শুনে, জোড়াতালি দিয়ে, আর তাতে অল্প-স্বল্প কল্পনার ঝোল মাখিয়ে বানানো এই গল্প। ঢাকা-যশোর প্লেনের টিকিটের দাম—আম্মারটি সতেরো টাকা, আমার আর আমার বুবুর সাড়ে আট টাকা করে, ছোটটি দুধভাত-তার জন্য কিছু লাগল না।
ইস্কাটনে আমাদের ফ্ল্যাটের এলাকা থেকে বেরিয়ে ডানে ঘুরে কিছুটা এগোলেই ময়মনসিং রোড। সেখানে আবার ডানে মোড় নিয়ে মাইল চারেক এগোলেই তেজগাঁও এয়ারপোর্ট। আব্বার অফিসের দরজাবিহীন সবুজ উইলি জিপে ছোট বোন, আর আম্মা সামনের সিটে। গাট্টি বোঁচকার সঙ্গে আব্বার একজন সহকারী। বুবু আর আমি পেছনের টানা বেঞ্চসিট দুটোর সওয়ারি। ময়মনসিং রোড বিভাজিত চওড়া অ্যাভিনিউ। মধ্য দিয়ে সবুজ ঘাসে মোড়া সড়কদ্বীপ। তিনতলার সমান উঁচু কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলো সারি ধরে উঠে গেছে তার পেট ফুঁড়ে, আর সারাটা পথে বিছিয়ে রেখেছে একটা কোমল ছায়া। দুপাশে সুনসান ফুটপাত। এক-দুটি শাড়ি-কাপড়, আর লেস-ফিতাওয়ালা, কিংবা বাঁশের দু-মাথায় বাঁধা ঝুড়ি বয়ে ইতস্তত হেঁটে যাওয়া মুটে-মজুর ছাড়া অহেতুক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জনমানুষ বা কোনো জটলা প্রায় চোখেই পড়ে না। সড়কে গোটা কয়েক রিকশা। তারও চেয়ে কম বেবিট্যাক্সি, আর হঠাৎ এক-দুটি গাড়ি-যানবাহন বলতে এই। ফুটপাতের ওপারে ঘরবাড়িও তেমন নেই। পাক মোটর, কারওয়ান বাজার আর ফার্মগেটে চৌরাস্তার ধার-ঘেঁষে ইতিউতি কিছু পাকা দালান, দোকানপাট। চলার পথে মুড়ির টিনের মতো ঝরঝরে গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে থাকা একটি বাস পেরিয়ে গেল আমাদের জিপগাড়ি। বালকের বিস্মিত চোখ হাঁ করে এই সব গিলছিল। গাড়ি এসে এয়ারপোর্ট ভবনের গা থেকে ডানা মেলে দেওয়া গাড়িবারান্দার তলে থামার সঙ্গে সঙ্গে আম্মার ডাকে চমক ভাঙল। এক পাশে দাঁড়ানো হলুদ রঙের গোটা ছয়েক ট্যাক্সি। সবগুলো মার্সিডিজ বেঞ্জ। গাড়ি থেকে যেখানে নামলাম, তার ধার-ঘেঁষে অনেকগুলো ধাপে উপরে উঠে গেছে একটি প্রশস্ত সিঁড়ি। আম্মা আর বুবুর আগে আগে আমি একছুটে উঠে গেলাম ওপরে। দুপাশে গুটিয়ে রাখা কলাপসিবল দরজার মাঝখান দিয়ে মালপত্র নিয়ে সবাই ঢুকলাম দোতলা সমান উঁচু ছাদের মস্ত একটি ঘরে। সেখানে পিআইএর হাতে মালপত্র সমঝে দেওয়ার সময় ঘড়ির মতো দেখতে গোল ডায়ালওয়ালা মাপ-যন্ত্রটির ওপর চড়ে বসলাম। আমার ওজনে সেটার কাঁটা ঘুরে যেখানে অবতরণ করল, তার ওপরে চোখ পড়তেই আম্মার মুখে উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে উঠল। তিনি শব্দহীন কঠিন ভ্রুকুটিতে নেমে পড়ার ইঙ্গিত দিয়ে অফিসের লোকটিকে বিদায় জানালেন।
আম্মার কোলে ছোট বোন, পাশে বুবু। তাঁদের দুজনের পেছন পেছন উঁচু হলঘরটি ছেড়ে এরপর আমরা সামনের অন্য একটি ঠান্ডা একটি ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সেখানে কালো চামড়ায় মোড়া গদিআঁটা চেয়ারের সারি। আম্মা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে একপাশে বসতে বললেন। কিন্তু সেটি হবার নয়। ঝটকা মেরে হাত ছুটিয়ে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে রানওয়েমুখী কাচের জানালায় মুখ রাখলাম আমি। বাইরের গরম হাওয়া, আর ভেতরের ঠান্ডার সংঘর্ষে ওটার সারা গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমে গেছে। ধোঁয়া ধোঁয়া সেই কাচ দুহাতে মাখামাখি করে পরিষ্কার করতেই দেখলাম, ওপাশে কংক্রিটের টারমাকে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্লেন। পেছন দিকটা ছোট একটি চাকার ওপরে ভর করা। প্লেনের লেজ প্রায় মাটি ছোঁয় ছোঁয়, মাথাটা উঁচানো, যেন ছোটার সংকেত পেলেই একটি লাফ দেবে। তার কোমরের মাঝ থেকে বেরিয়ে এসেছে দুটি ডানা, সেগুলোর গায়ে আঁটা একটি করে তিন ব্লেডের পাখা। এটাতে চড়ে আকাশে উঠে যাব, ভেবে অজানা এক রোমাঞ্চে শরীরটা বারবার শিউরে উঠল। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটু পরই রোদের আঁচে উত্তপ্ত রানওয়ে ধরে হাঁটা দিতে দিতে দেখলাম দুজন লোক চার চাকার একটি সিঁড়ি ঠেলে প্লেনের গায়ে লাগাচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে সেটা বেয়ে প্লেনে উঠলাম। একটু আগে আম্মা ভেতরের একটি দোকান থেকে এক বোতল ফানটা ছ’আনা দিয়ে কিনে দিয়েছিলেন। সেটা আমরা তিন ভাইবোন ভাগ করে খেয়েছিলাম। প্লেনে ঢোকার মুখে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়ানো সোনালি বর্ডার দেওয়া সবুজ কামিজে, মাথায় ওড়না প্যাঁচানো পরির মতো সুন্দরী একটি মেয়ে। তাকে দেখে আমার ফানটার ঢেকুর তোলা বন্ধ হয়ে গেল। ‘এটা কি পরি বুবু?’
‘কোনটা?’ হাতের ইশারায় তাকে দেখালাম। ‘গাধাটা বলে কি? ওটা পরি হতে যাবে কেন?’ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে আমার সবজান্তা বুবু বলল, ‘ওটা এয়ার হোস্টেস!’
দরজা দিয়ে ঢুকছি, বাঁয়ে চোখ পড়তে এক-ঝলক দেখলাম; প্লেনের একদম সামনে কাচের জানালায়ে মোড়ানো ছোট্ট মতন একটি জায়গা। তার ছাদে আর দেয়ালজুড়ে অসংখ্য সুইচ, আর ঘড়ির ছড়াছড়ি। সেগুলোকে ঘিরে একরাশ হলুদ, নীল, আর লাল আলো কেবলই জ্বলছে আর নিভছে। কাঁধের ওপর নীল এক টুকরো কাপড়ে সোনালি স্ট্রাইপ লাগানো সাদা শার্ট, ঘন নীল প্যান্ট, মাথায় ঝুলবারান্দা টুপি পরা দুজন মানুষ, দুটি চেয়ারে বসা। ফিসফিস করে বুবু আমাকে বলল, ‘এদের বলে পাইলট, এরা প্লেন চালায়, বুঝলি?’ মোটেও বুঝিনি; তবু ঘাড় নাড়লাম। সেই মুহূর্তে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে বসলাম, বড় হলে কিছু যদি হতেই হয়, তবে পাইলটই হব।
আকাশে ওড়াটা সেই বয়েসে আমার জন্য ছিল একটি স্বপ্নের মতো অভিজ্ঞতা। যেটাতে উঠেছি, পিআইএর সেই চকচকে নতুন ডগলাস ডিসি-৩ প্লেনের ভেতরে হাঁটার জন্য একটি সরু গলিপথ, দুপাশে দুটো করে একেক সারিতে চারটি করে সিট। একপাশে ছোট বোনকে কোলে নিয়ে আম্মা, তাঁর পাশে জানালার ধারে আমি। আইলের উল্টো দিকের জানালায় বুবু। জানালাগুলো চারকোনা, কাচের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, একটি লোক সরু লম্বা লাঠির মতো একটি বস্তু আমার দিকের পাখায় তাক করল। সেটা থেকে বাতাসের মতো কিছু একটা বেরিয়ে প্লেনের পাখায় গিয়ে লাগতেই অল্পক্ষণ পর সেটা ভনভন করে ঘোরা শুরু করল। আম্মার ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে অন্যদিকের জানালা দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। মনে হলো সেদিকের পাখাটিও ঘুরতে শুরু করেছে। পুরো দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু আমার পাশে যেমন, তেমন অন্য পাশেও ধুলোর ঘূর্ণিঝড় উঠতে দেখে তাই মনে হলো। এরপর গোঁ গোঁ করতে করতে প্লেন ছোটা শুরু করল। কিছুক্ষণ আগে এসে পরিটি আমার কোমরে একটা বেল্ট এঁটে দিয়ে গেছে। একসময় কেমন জানি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। মনে হলো শরীরের বাইরের দিক ভারী হয়ে আসছে, আবার ভেতর থেকে সবকিছু যেন হালকা হয়ে গলা দিয়ে উঠে আসতে চাইছে। বাইরে তাকাতে দেখলাম, নিচের মাঠটা তলিয়ে যাচ্ছে। আর ঘরবাড়ি, গাড়ি মানুষ কেবলই গুটিয়ে পুঁচকে হয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম প্লেন তাহলে মাটি ছেড়ে ওপরে উঠছে। খণ্ড খণ্ড জমিগুলো মিলে মিশে একসময় একটা বিশাল সবুজ মাঠ হয়ে গেল। আর নদীগুলো রুপালি ফিতের মতো তাঁর মাঝে রোদের আলোয় ঝিকমিক করতে লাগল। সেই সময়ের প্লেনগুলো খুব উঁচু দিয়ে উড়ত না। মেঘের তলে তলে চলা সারাটা পথ, নিচে তাকিয়ে সবই দেখতে পাচ্ছিলাম।
প্লেন ওপরে উঠে যেতেই দরজায় দেখা পরির মতো মেয়েটির এল। হাতে ছোট ট্রেতে একগাদা বিপির চকলেট ছড়ানো। আমার দিকে সেটা এগিয়ে ধরতেই আমি বাঁ হাতে ট্রে আঁকড়ে ধরে ডান হাত দিয়ে মুঠো মুঠো চকলেট তুলে নিতে থাকলাম। সেটা করতে করতে আম্মার চোখে চোখ পড়ল; বুঝলাম এটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। আম্মার হাতের মুঠি থেকে দুটি আঙুল বেরিয়ে লম্বালম্বি হয়ে উঠল। সেই সংকেতে কাঁচুমাচু মুখে মাত্র দুটি চকলেট রেখে বাকিগুলো ফিরিয়ে দিতে গেলাম, পরিটি ট্রে সরিয়ে নিল। তারপর সে সামনের সিটের পেছনের পকেট থেকে একটি কাগজের ঠোঙা বের করে আনল। প্লেনে উঠে আমি প্রথমেই আশপাশের সবকিছু উলটে পাল্টে দেখে নিয়েছিলাম। অন্য জিনিসের সঙ্গে এই ব্যাগটিও। সাদা মসৃণ কাগজের ব্যাগ, ওপরের দিকে চওড়া সবুজ বর্ডার, তার ওপর সোনালি আঁচড়ে আঁকা ইংরেজি তিনটি অক্ষর, পিআইএ। আম্মা বলেছিলেন, আকাশে উঠলে অনেকের বমি বমি লাগে। তখন বমি করতে হলে এই ব্যাগের মুখে মুখ রেখে সেটাতে ব্যাপারটা সারতে হয়। কী আশ্চর্য! এত সুন্দর একটি ব্যাগে মানুষ বমি করবে কেন? সে যাক, পরিটি আমার হাতে ব্যাগ দিয়ে বলল, মুখটি খুলে মেলে ধরে রাখতে। কথা মতো সেটা করতেই সে তার ট্রের সমস্ত চকলেট সেটার ভেতরে উপুড় করে দিল। তারপর আমার গাল টিপে দিয়ে সামনে থেকে সরে গেল। আমি বুঝলাম বুবু যতই একে এয়ার হোস্টেস মনে করুক, এ সত্যি সত্যি পরি না হয়ে যায় না! মনের আনন্দ সামলে মনোভাবটি বুঝতে তাড়াতাড়ি আম্মার দিকে তাকালাম। এবার আম্মার একটি আঙুল মুঠি থেকে বের হলো, মুখে মনে হলো খানিকটা প্রশ্রয়েরও হাসি। বুঝলাম, ঠিক আছে, তবে এখন একটির বেশি নয়। আমি আগেই ব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে চকলেটের মোড়ক খোলা শুরু করে দিয়েছিলাম। টপ করে এবার সেটা মুখে পুরে দিলাম। তাকিয়ে দেখলাম বুবু আম্মার তত্ত্বাবধান সীমানার বাইরে থাকার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে চলেছে। দুই গালই ফুলে আছে। কতগুলো এক সাথে পুরেছে কে জানে!
পরিটি ইতিমধ্যে হাতের ট্রে রেখে দিয়ে একটি ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে সিটগুলোর মাঝ দিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। আমাদের সারির সমান্তরালে এসে যখন পৌঁছাল, ট্রলির ওপরে রাখা অনেকগুলো ছোট ছোট প্লাস্টিকের ট্রে, তার একটি আম্মাকে, আরেকটি আমার হাতে তুলে দিল। ট্রেতে কড়কড়ে সেলোফেনের কাগজে মোড়া দুটো তিন কোনা ধবধবে সাদা রুটি, পাশাপাশি আঁটসাঁট করে রাখা। তাতে জোড়াটি মিলিয়ে গিয়ে একটি চারকোনা রুটির মতো দেখাচ্ছে। কোলের ওপরে ট্রে, সেখান থেকে ধবধবে ওই রুটির টুকরোটি তুলে আম্মা সেলোফেনের মোড়কটি খুলে দিলেন। রুটিটিতে কামড় বসাতেই প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল। ভেতরে মাখন ও নরম মুরগির মাংসের পুর। বুবু তারটা একটু ওপরে তুলে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘স্যান্ডুইচ!’ স্যান্ডুইচ নামক জিনিসটির সাথে সেই আমার প্রথম পরিচয়। মহানন্দে সেটা চিবাতে চিবাতে ট্রেতে রাখা অন্য জিনিসগুলোর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। ট্রেটির দুই কোনা গোল চাকতির আকারে একটু দাবানো। তার একটিতে হৃষ্টপুষ্ট, কিন্তু খাটো মাপের একটি প্লাস্টিকের গ্লাস বসানো, মুখটি রাংতা এঁটে বন্ধ, ভেতরের হলুদ রঙের তরল বস্তুটি, অরেঞ্জ জুস! অন্যটিতে একটি খালি কাপ। প্রথমে না বুঝলেও পরে আম্মার কাপে পরি যখন এসে চা ঢেলে দিয়ে গেল, তখন বুঝলাম কেন খালি কাপ ট্রেতে দেওয়া হয়েছে। আরও আছে; একটি কাগজ ভাঁজ করে করে তৈরি করা অদ্ভুত একটি বাটির মতো বস্তু, সেটাতে সাজানো চারকোনা একটি পেস্ট্রি। মুখে স্যান্ডউইচ, কিন্তু সেটা চিবোতে ভুলে গিয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে ওই স্বর্গীয় খাদ্যসম্ভার অবলোকন করছিলাম। ‘প্লেন কিন্তু নেমে পড়বে এক্ষুনি’, আম্মার সতর্কবাণী শুনতেই খাবার ফেরত নিয়ে যাবে এই ভয়ে তাড়াহুড়ো করে সব খেতে লাগলাম।
মাত্র চল্লিশ মিনিটের ওড়া। ঘোর কাটার আগেই প্লেন যশোর এয়ারপোর্টে নেমে পড়ল। দরজার সামনে আসতেই দেখলাম আব্বা টারমাকের ওপরে সিঁড়ির পাশে দাঁড়ানো। নেমে তাঁর কাছে আসতেই তিনি আমাদের গালে মাথায় আলতো করে একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে পাশে দাঁড়ানো একজন লোকের হাতে আমাদের সঁপে দিয়ে বললেন, ‘গাড়িতে চলে যাও। আমি জিনিসপত্র নিয়ে আসছি।’ প্লেন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তার থেকে মাত্র কয়েক পা হাঁটলে একটা তারের জালির ঘের। সেটা দিয়ে রানওয়েতে জনসাধারণের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমরা তার কাছাকাছি পৌঁছাতেই একজন খাকি পোশাক পরা মানুষ আমাদের সসম্ভ্রমে ছোট একটি গেট খুলে দিল। বের হয়ে আসার সময় শেষবারের মতো ঘাড় ফিরিয়ে প্লেনের দিকে তাকালাম। দরজায় পরিটি দাঁড়িয়ে। গভীর মনোযোগে আমাদের ছোট দলটির দিকেই তাকিয়ে ছিল মনে হয়। চোখে চোখ পড়তে হেসে সে হাত নাড়ল। না কি নাড়েনি?
আমার বয়েস যে তখন মাত্র পাঁচ বছর, এত দিন পরে সেটা আর পরিষ্কার মনে করতে পারছি না।