আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম
আমার একটি স্বপ্ন আছে—একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে, সাবেক দাসের সন্তান আর সাবেক দাস-মালিকের সন্তান একসঙ্গে ভ্রাতৃত্বের আসনে বসতে সক্ষম হবে। আমার একটি স্বপ্ন আছে—একদিন, এমনকি মিসিসিপি স্টেটে যে ছটফট করছে অবিচারের উত্তাপে, যে ছটফট করছে নিষ্পেষণের উত্তাপে, তা পাল্টে গিয়ে হয়ে উঠবে মুক্তি আর ন্যায়ের মরূদ্যান। আমার একটি স্বপ্ন আছে—আমার ছোট চার সন্তান একদিন এমন একটি জাতির মধ্যে বসবাস করবে, যেখানে গায়ের রং দিয়ে আর তাদের বিচার করা হবে না, বিচার করা হবে চরিত্রগুণ দিয়ে।
বলছি ১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারি জর্জিয়ার আটলান্টায় জন্ম মার্টিন লুথার কিংয়ের কথা। মার্টিন লুথার খনি শ্রমিকের সন্তান। অত্যন্ত ধর্মভীরু এক পরিবারে জন্ম নেন মার্টিন। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় মাইকেল কিং। বিখ্যাত জার্মান সংস্কারক মার্টিন লুথারের নামানুসারে ১৯৩৪ সালে তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।
ছেলেবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন মার্টিন। মেধাবী এ শিক্ষার্থীকে ছেলেবেলা থেকেই সইতে হয়েছে বর্ণবাদের বঞ্চনা। কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় তাঁকে যেতে হয়েছিল আলাদা স্কুলে। সেখান থেকেই এ বৈষম্য দূর করতে ব্রতী হয়ে ওঠেন তিনি। তবে কখনো বেছে নেননি হিংসাত্মক পথ। পরিবার থেকে পাওয়া মানুষের সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার শিক্ষা তিনি সারা জীবন মেনে চলেছেন।
মার্টিন লুথার কিংয়ের মূল আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে। বাসে এক নারীর বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। লুথার কিং ও অন্য নেতারা এ ঘটনার প্রতিবাদে বাস সার্ভিস বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। টানা ৩৮১ দিন এ অবস্থা চলার পর অ্যালাবামা রাজ্যের সব যানবাহনে বর্ণবৈষম্য বেআইনি ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৩ সালে এক সমাবেশে তিনি পৃথিবীর অন্যতম সেরা বক্তব্য দেন। তাঁর এ ভাষণটি ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ নামে পরিচিত।
১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং সরকারের গৃহীত বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ঘোষণা করেন। কিং তাঁর অনুসারীদের নিয়ে দুই মাসব্যাপী আন্দোলন চালিয়ে যান। আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল অ্যালাবামাতে কৃষ্ণাঙ্গদের শ্বেতাঙ্গদের সমান অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে হবে, কালোদের সর্বত্র প্রবেশাধিকার থাকতে হবে, শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। এমনি এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে অ্যালাবামার পুলিশ সেই সমবেত জনতার ওপর দমনমূলক নিপীড়ন চালায়। মার্টিন লুথার কিংসহ আরও অনেকেই সে সময় গ্রেপ্তার হন। এই ঘটনা ব্যাপক সাড়া জাগায় বিশ্বব্যাপী।
তাঁর বিখ্যাত ভাষণের প্রভাবেই ১৯৬৪ সালে আমেরিকায় নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়। আমেরিকা থেকে কাগজে কলমে, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য দূর হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, কীভাবে বর্ণবৈষম্য গোটা জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এরপর তুলে ধরেন ভবিষ্যতের আমেরিকা নিয়ে তাঁর আশাবাদ। যেখানে সব আমেরিকান হবে সমান। এটাই হবে সত্যিকারের স্বপ্নের আমেরিকা। এই মানুষটি মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৬৪ সালে।
মার্টিন লুথার কিংয়ের উক্তি মানে অসাধারণ শক্তি আর অনুপ্রেরণার উৎস। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এমন একজন নেতা যিনি সব দেশে, সবার কাছে প্রিয়। পৃথিবীর হাতেগোনা যে কয়জন রাজনীতিক সারা বিশ্বে সমান ভাবে সম্মানিত, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তাঁদের অন্যতম। তবে মৃত্যুর আগেই তিনি এমন কিছু কাজ করে গেছেন, এমন কিছু বাণী বা উক্তি দিয়ে গেছেন যা ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছে।
আজও মার্টিন লুথারের উক্তি, ভাষণ ও আদর্শ মানুষকে সাহস যুগিয়ে চলেছে, অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। হতাশা আর অন্ধকারের মাঝে সাহস আর আশা খুঁজে পাচ্ছে মানুষ তাঁর উক্তি থেকে।
১৯৬৮ সালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম এই নেতা ও বক্তা।