অধরা কণার আবিষ্কারক জাহিদ

জাহিদ হাসান

মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি কিংবা হঠাৎ করেই সোনার হরিণের দেখা মেলা নতুবা হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে পড়ে আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার গল্প এসবের কোনো কিছু দিয়ে বিজ্ঞানী ড. জাহিদ হাসান তাপসের গল্পকে সাজানোর উপায় নেই। কারণ একদম শৈশব থেকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্য তাঁকে ধরা দিয়েছে। এই তো বেশি দিন আগের কথা নয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক জাহিদ হাসানের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী ‘ভাইল ফার্মিয়ন’ নামে এক অধরা কণার আবিষ্কার করে সারা বিশ্বে হই চই ফেলে দিয়েছিলেন। ১৯২৯ সাল থেকে যে কণার সন্ধান করে বেড়াচ্ছিল বিজ্ঞানীরা, তা খুঁজে বের করেন একজন বাংলাদেশি পদার্থ বিজ্ঞানী। ৯১ বছর আগে ভারতীয় বাঙালি পদার্থ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ‘বোসন’ কণা আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানী জাহিদের নেতৃত্বে নতুন গ্রুপের এই কণা আবিষ্কৃত হয়।

পরিণত বয়সে অধরা কণা আবিষ্কার করে সবার মধ্যে সাড়া জাগানোর আগে কৈশোরে একই অঙ্ক বেশ কয়েক নিয়মে করে শিক্ষক ও সহপাঠীদের নজর কেড়েছিলেন জাহিদ। শিক্ষকেরা যে নিয়মে অঙ্ক করে দিতেন, সব সময় চেষ্টা করতেন নিজে আরও কয়েক নিয়মে তা সমাধান করার। শিক্ষকেরা বলতেন, মেধাবী বিস্ময়কর বালক জাহিদ একদিন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখবে এবং সারা পৃথিবীতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়বে। শ্রেণি কক্ষের চার দেয়াল ছাড়িয়ে আজ বিশ্বে অন্যতম প্রতিষ্ঠিত পদার্থ বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান।

জাহিদ হাসানের জন্ম ১৯৭১ সালের ২২ মে ঢাকায়। বাবা মো. রহমত আলী ও মা নাদিরা আলী তালুকদার দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে তিনি প্রথম। বাবা গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার শ্রীপুর আসন থেকে ছয়বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি ভীষণ আগ্রহ জাহিদের। বিজ্ঞানের প্রতি এই আগ্রহ গড়ে ওঠার পেছনে মার অবদানের কথা জানাতে মোটেই ভোলেননি তিনি। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার পাশাপাশি বিভিন্ন বই কেনার জন্যও মা নিয়মিত টাকা দিতেন। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ গড়ে ওঠার পেছনে শৈশবের একটা গল্প আছে। জন্মদিনে একবার তাঁর মা একটা ছোট্ট কম্পাস উপহার দিয়েছিলেন। কৌতূহলী জাহিদ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন কাঁটাকে যেভাবেই ঘোরানো হোক না কেন, সব সময়ই উত্তর-দক্ষিণ মুখ করে থাকে। কী এমন শক্তি কাঁটাকে সব সময় একমুখী করে রেখেছে—জানার আগ্রহ আর সামাল দিতে না পেরে এক সময় তিনি কম্পাসটিকে দুই টুকরো করে ফেলেন। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন এ টুকরাগুলো সব সময় উত্তর-দক্ষিণ মুখ করে থাকে। তখন থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন।

জাহিদ ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের এত বই পড়েছেন যে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালে তিনি নিজের লেখা বিজ্ঞানের বই ‘এসো ধূমকেতুর রাজ্যে’ প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষার বিজ্ঞান সাহিত্যের পথিকৃৎ আব্দুল্লাহ্ আল-মুতী শরফুদ্দীন তাঁর বইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

শুধু বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ আর অজানাকে জানার নেশা থাকলেই তো জীবনে সফল হওয়া যায় না। সে জন্য ভালো ফলাফল করেও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে হয়। এদিক দিয়ে তিনি যেন আরও এগিয়ে। ১৯৮৬ সালে গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় এবার নিজেকেই ছাড়িয়ে যান, সারা দেশে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি।

উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ইচ্ছা ছিল আইনস্টাইনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রিন্সটনে পড়ার। কিন্তু তখন সে সুযোগ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হলেও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ভাইনবার্গের সঙ্গে কাজ করার জন্য তিনি ভর্তি হন অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর মাস্টার্স ও পিএইচডি করতে পাড়ি জমান স্ট্যানফোর্ডে। স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় প্রিন্সটনে একবার বক্তৃতা দিতে গিয়ে বক্তৃতা শেষেই সেখানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে যান। ২০০২ সালে আরএইচডিকে ফেলো হিসেবে যোগ দেন প্রিন্সটনে। তারপর ২০১১ সালে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হয়ে যান তিনি।

ভাইল ফার্মিয়ন কণা সম্পর্কে অধ্যাপক জাহিদ জানান, ফার্মিয়ন কণা মূলত তিন ধরনের। যার মধ্যে ‘ডিরাক’ ও ‘ময়োরানা’ নামক ফার্মিয়ন কণার খোঁজ বিজ্ঞানীরা আগেই পেয়েছিলেন। তাই দীর্ঘদিন গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন, মৌল কণা নিউট্রনই সম্ভবত ভাইল ফার্মিয়ন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে জানা যায় নিউট্রনেরও ভর আছে। ১৯২৯ সালে গণিতবিদ ও পদার্থবিদ হারম্যান ভাইল ভর শূন্য ফার্মি-কণার ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। অবশেষে অধ্যাপক জাহিদের নেতৃত্বে সেই ভাইল ফার্মিয়নের সন্ধান মেলে।

জাহিদ মনে করেন, ভাইল ফার্মিয়ন ভর শূন্য হওয়ায় দ্রুতগতির ও অধিকতর দক্ষ ইলেকট্রনিকস যুগের সূচনা হবে। ভর শূন্য হওয়ায় ইলেকট্রনের মতো এদিক সেদিক না ছড়ানোর ফলে তৈরি হবে নতুন প্রযুক্তির কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস।

ভাইল ফার্মিয়ন আবিষ্কারের পাশাপাশি তাঁর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছেন ‘টপোলজিক্যাল ক্যাগোমে কোয়ান্টাম চুম্বক’ নামে নতুন এক চমক। তাঁর এই আবিষ্কারের কথা ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘নেচার’ এ প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত দ্রুতগতির কম্পিউটিংয়ের সহায়কের জন্য নতুন কোনো বস্তু কিংবা বস্তুর নতুন কোনো অবস্থার সন্ধান করে চলেছেন। এই চুম্বক আবিষ্কারের ফলে কম্পিউটার বর্তমানের চেয়ে শতগুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হবে এবং মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে যুক্ত হবে আরও অনেক নতুন প্রযুক্তি।

জীবনে এত এত সাফল্য অর্জন করেও জাহিদ হাসানের মধ্যে কোনো অহমিকা নেই। সম্প্রতি তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি থেকে আর্নেস্ট অরল্যান্ডো লরেন্স পুরস্কার-২০২০ এ ভূষিত হয়েছেন। ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কারটির মাধ্যমে জাতীয়, অর্থনৈতিক এবং আধুনিক জ্বালানি শক্তি গবেষণার বিকাশে ব্যতিক্রমী অবদানের জন্য বাছাইকৃত মার্কিন বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীদের সম্মানিত করা হয়।

জাহিদ হাসানকে ‘সর্বাধুনিক স্পিন-অ্যাঙ্গেল-রিসলভড ফটোঅ্যামিশন স্পেকট্রোস্কোপি’ ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন কোয়ান্টাম ফেইজ অব মেটার এবং ফার্মিওনিক কোয়াজি পার্টিকল আবিষ্কারের জন্য এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রত্যেক লরেন্স পুরস্কার বিজয়ীকে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি সচিবের স্বাক্ষরযুক্ত একটি প্রশংসাপত্র, আর্নেস্ট অরল্যান্ডো লরেন্সের প্রতিকৃতিযুক্ত একটি স্বর্ণপদক এবং ২০ হাজার মার্কিন ডলার সম্মাননা প্রদান করা হয়।

মাইক্রোসফট করপোরেশনে কর্মরত স্ত্রী প্রকৌশলী সারাহ আহমেদ, ছেলে আরিক ইব্রাহিম ও মেয়ে সারিনা মরিয়মকে নিয়ে জাহিদের সংসার। ঘোরাঘুরি করতে ও ছবি তুলতে তাঁর ভীষণ পছন্দ। সামুদ্রিক কোরালের প্রতিও তাঁর রয়েছে ভীষণ আগ্রহ। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানের আগ্রহ ছড়িয়ে দিতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ডের সঙ্গেও যুক্ত আছেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা একদিন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নাম আরও উজ্জ্বল করবে বলে তাঁর বিশ্বাস।