যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নিউ অরলিয়েন্স শহরে নববর্ষের অনুষ্ঠানে পিকআপ ট্রাক দিয়ে হামলাকারী নিজের পরিবারের সদস্যদেরও হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু পরে মত পরিবর্তন করেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন ইসলামিক স্টেটে (আইএসআইএস)। এসব বিষয় নিয়ে হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে একাধিক ভিডিও রেকর্ড করেছেন তিনি। ভিডিওগুলো দেখেছেন, এমন একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা এসব কথা বলেছেন।
শামসুদ-দীন জব্বার (৪২) অরলিয়েন্স শহরের বুরবোন স্ট্রিটে স্থানীয় সময় বুধবার দিবাগত রাত সোয়া তিনটার দিকে খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণের আনন্দ উৎসবে সমবেত মানুষের ওপর একটি পিকআপ ট্রাক তুলে দেন। এরপর তিনি লাফ দিয়ে নেমে একটি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলিবর্ষণ করেন। এতে অন্তত ১৫ জন নিহত হন। আহত হন কয়েক ডজন। পুলিশের পাল্টা গুলিতে জব্বারও নিহত হন।
তদন্তকারীরা জব্বারের কিছু ভিডিও খতিয়ে দেখেছেন। এসব ভিডিওতে তিনি নিজের পরিবারকে হত্যার পরিকল্পনা, আইএসে যোগদান, বিবাহবিচ্ছেদ ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছেন। টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের নিজের বাসা থেকে লুইজিয়ানায় আসার পথে তিনি এসব ভিডিও ধারণ করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
টেক্সাসে জন্মগ্রহণকারী জব্বার যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে ছিলেন। কিছুদিন আফগানিস্তানেও তিনি কাজ করেছেন।
ভিডিওতে কী বলেছেন জব্বার
ভিডিওগুলো খতিয়ে দেখেছেন, এমন দুই তদন্ত কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রথমে জব্বার তাঁর নিজের পরিবারকে ‘উদ্যাপনের’ জন্য একটি জায়গায় জড়ো করার পরিকল্পনা করেছিলেন। হত্যা করার জন্যই তিনি তাঁদের এক জায়গায় জড়ো করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পরিকল্পনা বাতিল করেন এবং আইএসে যোগ দেন। কেন তিনি আইএসে যোগ দেবেন, এ বিষয়ে ভিডিওতে তিনি একাধিক ‘স্বপ্নের’ কথা উল্লেখ করেছেন।
ভিডিওগুলো সিএনএন আলাদা করে যাচাই করে দেখতে পারেনি। এসব ভিডিও জব্বার টেক্সাসের বাসা থেকে লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যে আসার পথে করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু ভিডিওগুলো তৈরির সুনির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তারা নিশ্চিত হতে পারেননি।
জব্বারের ট্রাক থেকে কিছু ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) ও আইএসের একটি পতাকা উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষগুলো।
সেনাবাহিনীতে চাকরি
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো জব্বারের ভিডিওগুলো খতিয়ে দেখছে। একজন সাবেক সেনাবাহিনীর সদস্য কীভাবে এমন একটি ভয়াবহ হামলা চালালেন, তা বোঝার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র বুধবার সিএনএনকে বলেছেন, জব্বার এক দশকের বেশি সময় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি আফগানিস্তানে কাজ করেছেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি সক্রিয় দায়িত্ব থেকে অবসরে যান। তবে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত তিনি আর্মি রিজার্ভেই ছিলেন। সার্জেন্ট হিসেবে তিনি চাকরি থেকে অবসরে যান।
আবাসন খাতে চাকরি
টেক্সাসের বিউমন্ট শহরে জন্মগ্রহণকারী জব্বার ২০২০ সালে ইউটিউবে ‘পারসোনাল ইন্ট্রোডাকশন’ নামের একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। এতে তিনি নিজেকে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টন শহরভিত্তিক আবাসন খাতের একজন এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দেন। ওই ভিডিওতে জব্বার বলেছিলেন, ‘মহান সেবা বলতে কী বোঝায়, সেনাবাহিনী আমাকে তা শিখিয়েছে। কোনো বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারা ও সবকিছুকে গুরুত্বসহকারে নেওয়ার অর্থ কী, তা-ও আমি সেখান থেকে শিখেছি। কোনো কিছু যাতে নির্বিঘ্নে করা যায়, তা নিশ্চিত করার জন্য কোনো বিষয় বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখার ব্যাপারটিও আমি সেনাবাহিনী থেকে শিখেছি।’
ভিডিওটি অনলাইন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভিডিওতে তাঁকে বড় অক্ষরে ‘ডিসিপ্লিন’ লেখা একটি পোস্টারের পাশে বসে কথা বলতে দেখা গেছে। সেখানে তাঁর পাশে ‘লিডারশিপ’ শিরোনামের একটি বই ছিল।
অনলাইনের একটি জীবনবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, জব্বার সেন্ট্রাল টেক্সাস কলেজ থেকে ২০১০ সালে দ্বাদশ শ্রেণি (অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি) পাস করেন। জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক পাস করেন ২০১৭ সালে। তাঁর দুটো ডিগ্রিই কম্পিউটারবিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি–সংশ্লিষ্ট ছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি পরামর্শক সংস্থা ডেলয়েট ও অ্যাকসেঞ্চারে ব্যবসার উন্নয়ন এবং ডেটা ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কাজ করেছেন।
এক বিবৃতিতে ডেলয়েট বলেছে, ‘সন্দেহভাজন ব্যক্তি আমাদের সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তা জেনে আমরা হতবাক। সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে যে ব্যক্তির নাম বলা হয়েছে, তিনি ২০২১ সাল থেকে আমাদের এখানে কর্মকর্তা পর্যায়ে কাজ করছেন। সবার মতো আমরাও এই লজ্জাজনক ও অর্থহীন সহিংসতার জন্য ক্ষুব্ধ। আমরা কর্তৃপক্ষগুলোকে সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করছি।’
টেক্সাস রিয়েল স্টেট কমিশনের তথ্যমতে, জব্বার ২০১৯ সালে আবাসন খাতের লাইসেন্স পান, যার মেয়াদ ২০২৩ সালে শেষ হয়। তিনি ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আবাসন খাতের ক্লাসে চুক্তি আইন ও অর্থায়ন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।
বিবাহবিচ্ছেদ
আদালতের তথ্য থেকে জানা যায়, জব্বারের দুবার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম স্ত্রী ২০১২ সালে সন্তানের ভরণপোষণের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালত তাঁকে সন্তানের কত ভরণপোষণ দিতে হবে তা বেঁধে দেন, যা পরবর্তী সময়ে তাঁর আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। ২০২২ সালে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়।
দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে মামলা চলাকালে ২০২০ সালে তাঁর বিরুদ্ধে টেক্সাসের একজন বিচারক একটি রায় দেন। এতে আদালত দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তাঁকে সংযত আচরণের নির্দেশ দেন। রায়ে জব্বারকে তাঁর সাবেক দ্বিতীয় স্ত্রীকে হুমকি, শারীরিক ক্ষতি বা তাঁদের কোনো সন্তানের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। অনুরূপভাবে তাঁর সাবেক এই স্ত্রীকেও একই ধরনের নির্দেশ দেন আদালত।
মামলার নথিতে জব্বারের দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁদের বিয়ে না টেকার কারণ হিসেবে ‘মতবিরোধ বা ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বের’ কথা উল্লেখ করেছেন।
চুরির মামলা
টেক্সাসের হ্যারিস কাউন্টি আদালতের নথি থেকে জানা যায়, জব্বার ২০০২ সালে একটি চুরির ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। এ ধরনের মামলায় ৫০ থেকে ৫০০ ডলার জরিমানা দিতে হয়। ৯ মাস ‘কমিউনিটির পর্যবেক্ষণে’ থাকতে হয়।
মাদক মামলা
নর্থ ক্যারোলাইনার ডিস্ট্রিক্ট আদালতের নথি থেকে জানা যায়, সেনাবাহিনীর স্থানীয় ঘাঁটি ফোর্ট ব্র্যাগে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর অভিযোগে ২০১৫ সালে জব্বার অভিযুক্ত হয়েছিলেন। নর্থ ক্যারোলাইনার ওই সামরিক ঘাঁটি বর্তমানে ফোর্ট লিবার্টি নামে পরিচিত।
ওই নথি থেকে আরও জানা যায়, ২০১৪ সালের নভেম্বরে জব্বার ক্ষতিকর পদার্থ গ্রহণ করেছিলেন। তখন তাঁর রক্তে অ্যালকোহলের পরিমাণ বৈধ মাত্রার চেয়ে বেশি ছিল।
তখন জব্বার ‘লেভেল ফাইভ ডিডব্লিউআই’-এ অভিযুক্ত হয়েছিলেন। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর দায়ে নর্থ ক্যারোলাইনায় এটি সবচেয়ে কম শাস্তি।
নথিপত্র থেকে আরও জানা যায়, জব্বারের গাড়ির লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছিল। ১২ মাস তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। জরিমানা করা হয়েছিল ২০০ ডলার। একই সঙ্গে তাঁকে ২৪ ঘণ্টা কমিউনিটি সেবা দিতে বলা হয়েছিল।
জব্বারকে মাদকের অপব্যবহারের মূল্যায়ন ও চিকিৎসা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশন অফিসের একটি অ্যালকোহল বা মাদকসংক্রান্ত পুনর্বাসন কর্মসূচিতে অংশ নিতে বলা হয়েছিল।
অর্থকষ্ট
৪২ বছর বয়সী জব্বার সম্প্রতি অর্থকষ্টে ছিলেন। বিবাহবিচ্ছেদের মামলার অংশ হিসেবে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের এক ই–মেইলে তিনি লিখেছেন, ‘আমি আমার বাসার বন্ধকের অর্থ পরিশোধ করতে পারছি না। তখন বাসা বন্ধক বাবদ তাঁর বাকি ছিল ২৭ হাজার ডলারের বেশি।’
একই ই–মেইলে জব্বার এটাও লিখেছেন, ‘ব্লু মেডো প্রপার্টিজ নামে আমি যে ব্যবসা শুরু করেছিলাম, তাতে আগের বছর (২০২১ সালে) আমার প্রায় ২৮ হাজার ডলার লোকসান হয়েছে। অন্যান্য ব্যবসাও সফলতার মুখ দেখেনি। আমার ক্রেডিট কার্ডে ঋণ হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ডলার।’
একই ওয়েবসাইটের গাড়ি
জব্বার যে গাড়ি দিয়ে হামলা চালিয়েছেন, সেটি ফোর্ড এফ-১৫০ মডেলের। বৈদ্যুতিক ট্রাকটি তিনি ‘টুরো’ নামের একটি ওয়েবসাইট থেকে ভাড়া করেছিলেন। এই ওয়েবসাইট থেকে গাড়ির মালিকেরা অন্য মানুষকে নিজেদের গাড়ি ভাড়া দিতে পারেন। ওই গাড়ির মালিক টুরোর মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া দেওয়ার কথা সিএনএনকে নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে নিউইয়র্কের লাস ভেগাস শহরে ট্রাম্প হোটেলের সামনে গতকাল বুধবার টেসলার একটি সাইবারট্রাক বিস্ফোরিত হয়ে চালক মারা গেছেন। এতে অন্তত সাতজন পথচারী আহত হয়েছেন। এই সাইবারট্রাকের সঙ্গেও টুরো ওয়েবসাইটের সম্পর্ক রয়েছে। কর্তৃপক্ষ এখনো নিহত চালকের নাম প্রকাশ করেনি। এটা সন্ত্রাসী হামলা কি না, তা তাঁরা খতিয়ে দেখছেন।