দক্ষিণ কোরিয়ার ‘ফোর বি’ আন্দোলন কী, যুক্তরাষ্ট্রেও কেন তা শুরু হয়েছে
দক্ষিণ কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে নারীবাদীদের আন্দোলন। আন্দোলনটি পরিচয় পেয়েছে ‘ফোর বি’ নামে। এ আন্দোলনে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে যেকোনো ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ‘না’ বলছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর এখন এই আন্দোলন শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেও।
চলুন জেনে নিই ‘ফোর বি’ আন্দোলন কী এবং যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা কেন এই আন্দোলনের দিকে ঝুঁকছেন—
‘ফোর বি’ আন্দোলন কী
২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার নারীবাদীদের মধ্যে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি আন্দোলন হয়েছিল। তখন দেশটির নারীদের ওপর বেশ কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল। আন্দোলনের অন্যতম আরেকটি কারণ ছিল দেশটির সামাজিক বৈষম্য।
মূলত সেই আন্দোলনের ছায়া থেকেই ‘ফোর বি’ আন্দোলন শুরু হয়েছে। ‘ফোর বি’তে লুকিয়ে আছে মোট চারটি শব্দ। সেগুলো শুরু ‘বি’ দিয়ে। কোরীয় ভাষায় এর অর্থ হলো ‘না’। শব্দগুলো হলো ‘বিহন’—বিপরীত লিঙ্গের কোনো ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে নয়, ‘বিচুলসান’—সন্তানের জন্মদান নয়, ‘বিইয়েওনায়’—প্রেমিকের সঙ্গে সময় কাটানো (ডেটিং) নয় এবং ‘বিসেকসেউ’—বিপরীত লিঙ্গের কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক নয়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় কেন এই আন্দোলনের শুরু
দক্ষিণ কোরিয়ার নারীর বিরুদ্ধে পুরুষদের সহিংসতার মাত্রা নিয়ে ক্ষুব্ধ দেশটির নারীরা। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগের ৯ বছরে দেশটিতে অন্তত ৮২৪ জন নারী তাঁদের ঘনিষ্ঠ পুরুষ সঙ্গীদের সহিংসতার কারণে নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আরও ৬০২ জন মৃত্যুর ঝুঁকিতে ছিলেন।
এটাই আন্দোলনের অন্যতম কারণ। এর নেপথ্যে অর্থনৈতিক কারণও রয়েছে। যেমন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ার পুরুষেরা গড়ে নারীর চেয়ে ৩১ দশমিক ২ শতাংশ বেশি অর্থ উপার্জন করেন। এ ছাড়া পারিবারিক বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজও রক্ষণশীল।
কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আয়ো ওয়ালবার্গের ভাষ্যমতে, দক্ষিণ কোরিয়ায় পরিবারে সন্তান পালন, প্রবীণদের দেখাশোনার পাশাপাশি গৃহস্থালির কাজকর্ম একজন নারীকে করতে হয়। এদিকে দেশটিতে মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে। ফলে নারীদের কাঁধে অর্থ উপার্জনের দায়িত্বও চেপেছে। দ্বিগুণ চাপে পড়ে তাঁরা বিরক্ত হয়ে উঠছেন।
কেন এই আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে
নির্বাচনে ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের অনেক তরুণী টিকটক ও এক্সের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্য নারীদের ‘ফোর বি’ আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার উৎসাহ দিচ্ছেন।
ভোট গ্রহণের পরপর সিএনএনের বুথফেরত জরিপে দেখা যায়, ট্রাম্পের পাওয়া ভোটের মধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা ৪৬ শতাংশ। অপর দিকে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ৫৪ শতাংশ ভোট। আর ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। কমলা পুরুষদের ভোট পেয়েছেন ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মার্কিন তরুণীরা বলছেন, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের নিয়ে হতাশ। কারণ, এই তরুণেরা এমন একজন প্রার্থীকে (ট্রাম্প) ভোট দিয়েছেন, যিনি তাঁদের শরীরের অধিকারে বিশ্বাস করেন না।
এ পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছেন ট্রাম্পেরই কয়েকজন সমর্থক। যেমন বলা চলে কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক কর্মী নিক ফিউয়েন্টেসের কথা। তিনি এক্সে পোস্ট করেছেন, ‘ইয়োর বডি, মাই চয়েস।’ মানে ‘তোমার শরীর, আমার পছন্দ।’ নারীবাদীরা সাধারণত নিজেদের অধিকার রক্ষা প্রসঙ্গে—‘আমার শরীর, আমার পছন্দ’ (মাই বডি, মাই চয়েস) স্লোগান দিয়ে থাকেন।
নারী অধিকার মার্কিন নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলেছে
এবারের মার্কিন নির্বাচনে অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল গর্ভপাতের অধিকার। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস গর্ভপাতকে একটি বড় ইস্যু করে নির্বাচনে প্রচার চালিয়েছেন। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল, এটা কমলার পক্ষে ততটা কাজে লাগেনি। বরং এর বিপরীতে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন মার্কিন ভোটাররা।
নারীর গর্ভপাতের অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৭৩ সালে যুগান্তকারী এক রায় দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট, যা ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলা নামে পরিচিত। ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট সেই রায় উল্টে দেন, যার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একজন নারীর গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এর বদলে গর্ভপাতের বিষয়ে প্রতিটি অঙ্গরাজ্য নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। এ রায়ের পর এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
ট্রাম্পের দাবি, ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার রায় উল্টে দেওয়ার কৃতিত্ব তাঁর। এটা সম্ভব হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল বিচারপতিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে সুপ্রিম কোর্টে তিনজন রক্ষণশীল বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাঁরাই এ রায় উল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখেন।
যুগান্তকারী এ রায় উল্টে দেওয়ার কারণে নারী ভোটারদের ভোট কমলা বেশি পাবেন—এ বিশ্বাস থেকে নির্বাচনে প্রচার চালিয়েছেন ডেমোক্র্যাটরা। কিন্তু বিষয়টি কমলার জয় এনে দেওয়ার মতো নারী ভোট টানতে পারেনি।
গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেসের পাশাপাশি ১০ অঙ্গরাজ্যে গর্ভপাতের অধিকার বিষয়েও ভোট দিয়েছেন মার্কিন ভোটাররা। ভোটারদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, গর্ভপাতের বিষয়টিকে তাঁরা সংবিধানে স্বীকৃতির পক্ষে নাকি বিপক্ষে। ফলাফলে দেখা গেছে, সাতটি অঙ্গরাজ্যের ভোটাররা গর্ভপাতকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন।
গর্ভপাত নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান কী হবে
ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে গর্ভপাত নিয়ে কোনো বিল আনা হলে তাতে ভেটো (বাধা) দেবেন বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, গর্ভপাতের বিষয়টি নিয়ে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে তিনি।
কিন্তু নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মধ্যে এই আশঙ্কা বাড়ছে যে ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশজুড়ে গর্ভপাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবেন। এ ক্ষেত্রে চাপ দিয়ে রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের বাধ্য করবেন তিনি। সেই সুযোগও তাঁর আছে।
কেননা মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের নিয়ন্ত্রণ রিপাবলিকান পার্টি পেয়েছে। পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতি রক্ষণশীল হওয়ায় সর্বোচ্চ আদালতের নিয়ন্ত্রণও দলটির হাতে। এদিকে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণও পেতে যাচ্ছেন রিপাবলিকানরা।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, ট্রাম্প দেশজুড়ে গর্ভপাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেই ক্ষান্ত দেবেন না। কমস্টক নামে ১৮৭৩ সালে একটি আইন প্রণয়ন করে যুক্তরাষ্ট্র। এ আইনের অধীন গর্ভপাত–সংক্রান্ত ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রি আইনত দণ্ডনীয়। তবে বহু বছর ধরে আইনটির প্রয়োগ নেই যুক্তরাষ্ট্রে। ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে এই আইন আবার কার্যকর করতে পারেন বলে অনেকের আশঙ্কা।
নারীরা কেন ট্রাম্পের ওপর ক্ষুব্ধ
অনেকের মতে, ট্রাম্প বছরের পর বছর ধরে নারীদের প্রতি যেসব মন্তব্য করেছেন, সেসবই নারীর প্রতি তাঁর মনোভাব কেমন, তা তুলে ধরে। ২০২৩ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতে প্রমাণিত হয় যে লেখক ও সাংবাদিক ই জ্যঁ ক্যারলকে যৌন নিপীড়নের জন্য দায়ী ট্রাম্প। এ ঘটনায় আদালত ট্রাম্পকে ৮ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার জরিমানা করেন।
২০১৮ সালে বব উডওয়ার্ড নামের বর্ষীয়ান একজন সাংবাদিক তাঁর স্মৃতিচারণামূলক বইয়ে ট্রাম্প ও তাঁর এক বন্ধুর কথোপকথন তুলে ধরেন। তাতে দেখা যায়, ট্রাম্প একজন নারীবিদ্বেষী। নারীদের অধিকার ও সম্মানের বিষয়টি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং নারীর অধিকার খর্ব হয়, এমন অনেক মন্তব্য করেন ট্রাম্প।
নারীদের নিয়ে অসংখ্য বিতর্কিত মন্তব্য রয়েছে ট্রাম্পের। গত নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে নিয়ে নানা সময়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করতে দেখা গেছে ট্রাম্পকে। হ্যারিসের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁকে ‘বেকুব’ ও ‘নির্বোধ’ বলে বর্ণনা করেন ট্রাম্প।
নারীদের নিয়ে অসংখ্যবার বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। ২০০৪ সালের জুনে ট্রাম্প তাঁর মেয়ে ইভাঙ্কাকে নিয়ে এক মন্তব্য করে বিতর্কে জড়ান। ট্রাম্প বলেন, ‘ইভাঙ্কা একজন সুদর্শন নারী। মেয়ে না হলে আমি হয়তো তাঁর প্রেমে পড়তাম।’ ট্রাম্প যখন এ মন্তব্য করেন, ইভাঙ্কার বয়স তখন ২৩ অথবা ২৪।
নারী ইস্যুতে ট্রাম্পের অবস্থান ও নানা সময়ে করা বিতর্কিত মন্তব্যে ক্ষুব্ধ নারীরা যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফোর বি’ আন্দোলনে সক্রিয় হচ্ছে।