কানাডার সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর উত্থান ও পতন কীভাবে
কানাডায় কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিকভাবে নানা সমস্যা মোকাবিলা করছিলেন জাস্টিন ট্রুডো (৫৪)। এ প্রেক্ষাপটে গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করবেন বলে তিনি যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা একরকম প্রত্যাশিতই ছিল।
এরপরও ট্রুডোর ওই ঘোষণাকে তাঁর বিস্ময় জাগানো পতন হিসেবে ধরা যায়। কেননা, একসময় তিনি এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে কোনো কূটনৈতিক বৈঠকেও তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলতে লাইন ধরতেন ভক্তরা।
প্রায় ২৫ বছর ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা ট্রুডোর উত্থান-পতন নিয়ে সংক্ষেপে কিছু তথ্য জানা যাক—
২০০০
১৯৭১ সালের ক্রিসমাস ডে’তে জন্মগ্রহণ করার সময় থেকেই তারকা হয়ে উঠেছিলেন জাস্টিন ট্রুডো। এ সময় তাঁর বাবা পিয়েরে এলিয়ত ট্রুডো ছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তী সময় তাঁর তারকাখ্যাতির অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে ওঠেন সাবেক টেলিভিশন উপস্থাপিকা স্ত্রী মার্গারেট (পরে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে)। তবে ২০০০ সালে বাবার স্মরণানুষ্ঠানে তাঁর প্রশংসা করে দেওয়া এক ভাষণ ট্রুডোর নিজস্ব রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত দেয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ২৮ বছর। গির্জাভর্তি শোকার্ত মানুষের উদ্দেশে তাঁর বার্তা ছিল, ‘এটাই শেষ নয়।’
২০০৮
ট্রুডো ছিলেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেখান থেকে ২০০৮ সালে পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৬ বছর।
২০১২
এ বছর এক চ্যারিটি বক্সিং (মুষ্টিযুদ্ধ) ম্যাচে ট্রুডো তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ দলের এক নেতাকে পরাজিত করেন; যিনি ছিলেন কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া। এ ঘটনা তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও জনপ্রিয়তাকে আরও গতিশীল করে।
২০১২ সালে এক চ্যারিটি বক্সিং ম্যাচে ট্রুডো তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ দলের এক নেতাকে পরাজিত করেন; যিনি ছিলেন কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া। এ ঘটনা তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও জনপ্রিয়তাকে আরও গতিশীল করে।
২০১৩
বাবা এলিয়ত ট্রুডোর ১৫ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠা লিবারেল পার্টির নেতা নির্বাচিত হন জাস্টিন ট্রুডো। লিবারেলকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণকালে অন্তর্কোন্দলে জর্জরিত ছিল দলটি।
২০১৫
তুলনামূলক কম বয়সে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাক লাগিয়ে দেন। গড়ে তোলেন লিঙ্গসমতাভিত্তিক মন্ত্রিসভা। নিজেকে পরিচিত করে তোলেন একজন নারীবাদী, পরিবেশবাদী এবং শরণার্থী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকারকর্মী হিসেবে।
২০১৬
ট্রুডো জাতীয় কার্বন ট্যাক্স কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচিতে কর ছাড় পাওয়া ভোক্তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি ছিল দেশের অর্থনৈতিক খাতে এক বড় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ও তাঁর অন্যতম লক্ষ্যপূরণের ঘটনা। তবে রাজনৈতিক বিরোধীরা এ ব্যবস্থার বিরোধিতা করে বলেন, এটি প্রত্যেক কানাডীয়র ওপর বোঝা চাপাবে।
২০১৭
কিছু কেলেঙ্কারি ট্রুডোর ভাবমূর্তিকে ধীরে ধীরে ক্ষুণ্ন করতে শুরু করে। এ বছর নৈতিকতাবিষয়ক একটি কমিশন জানায়, বিনা মূল্যে জাঁকজমকপূর্ণ এক ছুটি কাটিয়ে ও বিষয়টি প্রকাশ না করে ২০১৬ সালে স্বার্থসংঘাত সংশ্লিষ্ট নিয়ম ভেঙেছেন তিনি।
২০১৮
এক সাংবাদিকের সঙ্গে ২০০০ সালে ট্রুডো অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে, তবে অভিযোগ নাকচ করেন তিনি।
২০১৯
নৈতিকতাবিষয়ক একজন ফেডারেল কমিশনার এক আদেশে বলেন যে ট্রুডো মন্ট্রিয়লভিত্তিক বহুজাতিক প্রকৌশল ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালনির বিরুদ্ধে করা এক মামলায় তাঁর সাবেক বিচারমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রতারিত, অবজ্ঞা ও সম্মানহানি করার চেষ্টা করেন। এটি তাঁর ভাবমূর্তিতে আরেক কলঙ্ক লেপন করে। এ বছর তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। তবে তাঁর দল লিবারেল পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়।
২০২০
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলাকালে স্ত্রী সোফি গ্রেগরি ট্রুডো এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জাস্টিন ট্রুডো নিজেই আইসোলেশনে যান। এখন তাঁরা বিচ্ছিন্ন। করোনাকালে এ মহামারি ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে নানা রকম কড়াকড়ি আরোপ করেন তিনি।
২০২১
এ বছর জনসমর্থন তুলনামূলক ভালো থাকলেও ট্রুডো আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন। বলেন, করোনাকালীন ও অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে কানাডাকে নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে দলের পক্ষে জোরাল সমর্থন আদায় করতে চান তিনি। পরে নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। কিন্তু এবারও তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আদায়ে ব্যর্থ হয়।
২০২২
করোনার টিকা নিয়ে বিক্ষোভে অচল হয়ে পড়ে রাজধানী অটোয়া ও কয়েকটি সীমান্ত ক্রসিং। জনশৃঙ্খলা রক্ষায় ট্রুডো জরুরি অবস্থা জারি করেন। শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অনুমতি দেন কর্তৃপক্ষকে। নিষিদ্ধ করা হয় সমাবেশ, ভ্রমণের ওপর আরোপ করা হয় বিধিনিষেধ। এ পদক্ষেপ রক্ষণশীলদের মধ্যে তাঁর ব্যাপারে ক্ষোভের সঞ্চার করে। এরই মধ্যে বাড়িভাড়া বেড়ে যাওয়া ও মূল্যস্ফীতির চাপ সব রাজনৈতিক ঘরানার মানুষের মধ্যে জন্ম দেয় হতাশার।
২০২৩
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে এ বছর এক আলাপচারিতায় ট্রুডো বলেন, ‘তাঁর জনগণ খেপেছেন। এ ক্ষোভ সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। আমাদের নম্র-ভদ্র হওয়া দরকার। কিন্তু মানুষ পাগল হয়ে গেছে। বাসাভাড়া ও বেকারত্বের বৃদ্ধি নিয়ে তিনি যখন দেশবাসীর ক্ষোভের মুখে, ঠিক তখন ভারতের সঙ্গেও জড়ান বিবাদে।’
২০২৪
সেপ্টেম্বরে ট্রুডোর ক্ষমতা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। ওই সময় আইন পাসের ক্ষেত্রে লিবারেলদের প্রয়োজনীয় সমর্থন দেওয়ার নিশ্চয়তা থেকে বঞ্চিত করে বামপন্থী নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি। পরের মাসে ট্রুডো জানান, তিনি কানাডার অভিবাসন নীতি কঠোর এবং স্বাস্থ্য ও অন্যান্য পরিষেবা খাতে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। এসব পদক্ষেপ এটাই তুলে ধরে যে তাঁর নীতি ভালোভাবে কাজ করছে না।
গত ডিসেম্বরে উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড আচমকা পদত্যাগ করেন। এটি ছিল ট্রুডো সরকারের জন্য এক বড় ধাক্কা। ক্রিস্টিয়া ছিলেন ট্রুডোর মন্ত্রিসভার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের একজন। তিনি ট্রুডোর দেওয়া ব্যয়বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করার পর তাঁর বিরাগভাজন হয়ে পড়েন।
ফ্রিল্যান্ড পদত্যাগ করে যে চিঠি লেখেন, তাতে অভিযোগ করা হয়, ট্রুডো দেশের জন্য ভালো কিছু করার দিকে মনোযোগ না দিয়ে ‘রাজনৈতিক ছলচাতুরী’র আশ্রয় নিচ্ছেন।
২০২৫
পদত্যাগের জন্য বিরোধীদের পাশাপাশি নিজ দলের মধ্য থেকে চাপ বাড়তে শুরু করে ট্রুডোর ওপর। শেষমেশ গতকাল পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন তিনি।