লাতিন আমেরিকা কেন জিমি কার্টারকে মনে রাখবে

পানামা সিটিতে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন জিমি কার্টার (বাঁয়ে) ও জেরাল্ড ফোর্ড (ডানে)। ৫ মে ১৯৮৯
ফাইল ছবি: রয়টার্স

জিমি কার্টার মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্রের লাতিন আমেরিকা নীতিতে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও বদল এসেছিল। অঞ্চলটিতে দীর্ঘ সময় ধরে চলা মার্কিন হস্তক্ষেপের ধারার পরিবর্তে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন কার্টার, এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকেরা।

কার্টার গত রোববার ১০০ বছর বয়সে মারা যান। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মার্কিন রক্ষণশীলদের বিরোধিতা ও অসন্তোষ উপেক্ষা করে পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ পানামা সরকারের কাছে হস্তান্তরে চুক্তি সই করেছিলেন কার্টার। লাতিন আমেরিকার একাধিক কর্তৃত্ববাদী সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সহায়তা স্থগিত করে দিয়েছিল কার্টার প্রশাসন। এমনকি কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছিলেন ৩৯তম এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

আরও পড়ুন

কার্টারের গণতান্ত্রিক ও কূটনীতিক সংকল্প মধ্য আমেরিকা ও কিউবায় বড় ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে অঞ্চলটিতে কমিউনিজমের বিস্তারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কার্টারের ওপর প্রতিপক্ষের চাপ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর মানবাধিকারের অগ্রাধিকারের ভারসাম্য বজায় রাখতে বাধ্য হন।

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ইন্টার-আমেরিকান ডায়ালগের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাইকেল শিফটার এএফপিকে বলেন, কার্টারের বৈশ্বিক নীতি ছিল মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতাকেন্দ্রিক। তাঁর এই বৈশ্বিক নীতির আওতাভুক্ত ছিল লাতিন আমেরিকা অঞ্চল।

জেরাল্ড ফোর্ডের পর ও রোনাল্ড রিগ্যানের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ডেমোক্রেটিক পার্টির কার্টার। তাঁর সময়কালে লাতিন আমেরিকার ডানপন্থী একনায়কদের প্রতি সমর্থন থেকে সরে আসতে চেয়েছিল ডেমোক্র্যাটরা।

আরও পড়ুন

পানামা খাল

কার্টারের কূটনৈতিক অবস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হলো ১৯৭৭ সালে সই করা দুটি চুক্তি। পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ ১৯৯৯ সালে পানামা সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তরের জন্য এসব চুক্তি করা হয়েছিল।

কোস্টারিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লুইস গুইলারমো সোলিস বলেন, কার্টার বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি যদি খালটি পানামা সরকারকে ফিরিয়ে না দিতেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও পানামার মধ্যকার সম্পর্কে নতুন সংকট দেখা দিত। আর এই অস্থিতিশীলতার ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো হতো না।

আরও পড়ুন
কিউবার রাজধানী হাভানায় ফিদেল কাস্ত্রো ও জিমি কার্টার। ১৪ মে ২০০২
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কার্টারের পানামা খাল হস্তান্তরের সিদ্ধান্তটি সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক অজনপ্রিয় ছিল। এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, এটি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। এ সিদ্ধান্তের জন্য ২০১৬ সালে কার্টারকে সর্বোচ্চ সম্মাননা দিয়েছিল পানামা। গতকাল সোমবার পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে মুলিনো তাঁর দেশের পূর্ণাঙ্গ সার্বভৌমত্ব অর্জনে সহায়তার জন্য কার্টারের প্রশংসা করেছেন।

ক্ষমতায় থাকাকালে নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট আনাস্তাসিও সোমোজাকে সমর্থন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কার্টার। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে বামপন্থী স্যান্ডিনিস্তা ফ্রন্ট এই স্বৈরশাসককে উৎখাত করে। তবে এল সালভাদরের সরকারের সঙ্গে কার্টারকে অত্যন্ত অস্বস্তিকর একটি চুক্তি করতে হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাইকেল শিফটার।

আরও পড়ুন

এল সালভাদরে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা গ্রহণ ঠেকাতে কার্টার জান্তার জন্য পুনরায় মার্কিন সামরিক সহায়তা দেওয়া শুরু করেন। সহায়তা পেয়ে এই জান্তা আরও বেশি উগ্র হয়ে পড়ে। তারা বেসামরিক গণহত্যায় লিপ্ত হয়। এল সালভাদরকে একটি দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আর্জেন্টিনা, চিলি, উরুগুয়ে ও প্যারাগুয়ের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন কার্টার। তিনি এই দেশগুলোতে অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করে দেন। ক্ষেত্রবিশেষে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেন। তবে কার্টারের এসব প্রচেষ্টা দেশগুলোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকরণের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি বলে মনে করেন আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রোসেন্দো ফ্রাগা।

কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা

ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের ১৫ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসিডেন্ট কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৬২ সাল থেকে কার্যকর থাকা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেন তিনি। গোপন সংলাপে তিনি সমর্থন দেন। দুই দেশের মধ্যে সীমিত পরিসরে কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব চালু করেন।

কিউবার সাবেক কূটনীতিক জেসুস আরবোলিয়া এএফপিকে বলেন, তাঁর (কার্টার) সময়ে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক সম্পর্কের কাঠামো হিসেবে দ্বন্দ্বের পরিবর্তে সংলাপের সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮০ সালে কিউবার ১ লাখ ২৫ হাজার নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে পড়লে একটি অপ্রত্যাশিত সংকট তৈরি হয়। জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জেনিফার ম্যাককয় বলেন, অপ্রত্যাশিতভাবে একঝাঁক অভিবাসীর আগমনের কারণে রাজনৈতিকভাবে ধাক্কা খান কার্টার।

কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো সোভিয়েত-সমর্থিত আফ্রিকার সরকারগুলোকে সমর্থন-সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সেনা মোতায়েন করেন। এসবের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ার অবসান ঘটে। এর ২০ বছরের বেশি সময় পর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্টার কিউবায় ঐতিহাসিক সফরে যান। ১৯৫৯ সালের পর তিনি ছিলেন প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন রাজনীতিক, যিনি কিউবার মাটিতে পা রেখেছিলেন।

আরও পড়ুন

জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জেনিফার ম্যাককয় বলেন, ২০০২ সালে কিউবা সফরকালে কার্টার দেশটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য সাহসী আহ্বান জানান। তবে এ সময় তিনি ফিদেল কাস্ত্রোকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালুর আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই সফরে কার্টারের প্রতিনিধিদলে ছিলেন জেনিফার ম্যাককয়। গতকাল কিউবার বর্তমান নেতা মিগুয়েল দিয়াজ-ক্যানেল বলেছেন, তাঁর দেশের নাগরিকেরা ওয়াশিংটন ও হাভানার মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে কার্টারের প্রচেষ্টাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।

কার্টারের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন রোনাল্ড রিগ্যান (১৯৮১-১৯৮৯)। তাঁর সময়ে কিউবার সঙ্গে পুরোদমে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব-বিরোধ আবার শুরু হয়। কয়েক দশক পর বারাক ওবামার সময় (২০০৯-২০১৭) দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় (২০১৭-২০২১) তা আবার ভেস্তে যায়।

বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিউবার বিষয়ে মার্কিন নীতি পর্যালোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০২১ সালে কিউবা সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন অভিযান চালায়। এর জেরে কিউবার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেন বাইডেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ম্যাককয় বলেন, কার্টার দেখিয়েছিলেন যে আলাপ-আলোচনা-সম্পৃক্ততা ও কূটনীতি বিচ্ছিন্নতার চেয়ে বেশি ফলপ্রসূ।