মিশিগানে বাইডেনকে ‘শাস্তি’ দিতে চান আরব বংশোদ্ভূত মার্কিন ভোটাররা
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েট শহরতলির দোকান বা মসজিদে আসা লোকজনকে প্রায়ই ইংরেজির পাশাপাশি আরবি ভাষায় কথা বলতে শোনা যায়। সেসব ভবনের সামনে দুই ভাষার সাইনবোর্ডও প্রায়ই চোখে পড়ে।
তবে ভাষা যা–ই হোক না কেন, আরব বংশোদ্ভূত মার্কিন ও মুসলমানদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দারা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর বেশ নাখোশ। তাঁদের বিশ্বাস, বাইডেন গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের পাশে অনড় অবস্থানে আছেন এবং তাঁদের কথায় কান দিচ্ছেন না।
রাজনৈতিক সংগঠক সামারা লুকমান নামাজের পর মসজিদের বাইরে প্রচারপত্র বিলি করছিলেন। সেই সময় তিনি ইংরেজিতেই বলেন, ‘ফিলিস্তিনের জন্য ভোট করুন, বাইডেনের জন্য নয়।’ ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত এই অ্যাকটিভিস্ট আরবিতে বলেন, ‘বাইডেনকে ভোট দেবেন না।’ পথচারী অনেকেই তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলছেন, ‘অবশ্যই’।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিশিগানকে ‘সুইং স্টেট’ বা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে কে জিতবে, তা বলা কঠিন। ২০২০ সালের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গরাজ্যে মাত্র দেড় লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন বাইডেন। গাজা উপত্যকায় মৃত্যুর মিছিল বড় হতে থাকায় এখানকার বাসিন্দারা, যাঁরা একসময় ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে বেছে নিয়েছিলেন, তাঁরাই এখন বাইডেনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন।
অনেকে আশা করছিলেন, বাইডেনের ওপর চাপ দিয়ে তাঁকে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন থেকে সরিয়ে আনা যাবে এবং তিনি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাবেন। তবে লুকমানের মতো একটি পক্ষ সরাসরি বলেই দিয়েছেন, তাঁরা কখনোই বাইডেনকে ভোট দেবেন না।
‘বাইডেনকে ত্যাগ করো’—এমন একটি গ্রুপের পক্ষে প্রচারে নেতৃত্ব দেওয়া লুকমান বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, বাইডেন গণহত্যা করছেন। তিনি এতে অর্থায়ন করছেন।
‘বাইডেনকে ত্যাগ করো’ এমন একটি গ্রুপের পক্ষে প্রচারে নেতৃত্ব দেওয়া লুকমান বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, বাইডেন গণহত্যা করছেন। তিনি এতে অর্থায়ন করছেন।
আগামী সপ্তাহে এই অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক বাছাই হতে যাচ্ছে। অবশ্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় বাইডেনকে খুব একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে না। তবে সেখানে দলের ভোটারদের তাঁদের ব্যালটে প্রতীকী হিসেবে ‘অনিচ্ছুক’ বা ‘ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো’ লেখার আহ্বান জানিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন লুকমানসহ অন্যরা।
ক্যাপিটল হিলের সাবেক ডেমোক্রেটিক চিফ অব স্টাফ এবং লিসেন টু মিশিগান প্রচার গ্রুপের সদস্য আব্বাস আলাবিহ বলেন, ‘আমাদের প্রেসিডেন্টের ওপর চাপ তৈরির জন্য এই প্রচার চালানো হচ্ছে। কারণ, (গাজায়) শিশুদের যেভাবে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি কিছু করতে পারেন।’
লেবাননিজ বংশোদ্ভূত আব্বাস বলেন, এখানকার মানুষের অনেকেই এই যুদ্ধের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
আব্বাস বলেন, বাইডেন এই গোষ্ঠীর সমর্থন হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। শুধু আগামী নভেম্বরেই নয়, সম্ভবত আগামী এক প্রজন্মের সমর্থনও তিনি হারাবেন।
বাইডেন না হলে কি ট্রাম্প
গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালালে জবাবে গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ওই হামলায় ইসরায়েলে ১ হাজার ১৬০ জন নিহত হন বলে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে জানানো হয়। অবশ্য শুরুতে তারা ১ হাজার ২০০–এর বেশি মানুষের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল।
অন্যদিকে হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ইসরায়েলের পাল্টা নির্বিচার হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
‘লিসেন টু মিশিগান’ চাপ তৈরির প্রচার শুরু করেছে। কিন্তু কিছু ভোটার বলছেন, প্রেসিডেন্টকে নিয়ে তাঁদের হতাশা স্থায়ী। ইরাকি বংশোদ্ভূত ২৩ বছরের মেডিকেল শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আলেমারা বলেন, ‘বাইডেনকে ভোট দেওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আপনি আমাদের ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা না করলে আমাদের কাছে ভোট আশা করতে পারতেন।’
মুসলিম ও আরবরা কী করবেন? তাঁরা কি ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছেন? মুসলিম নিষিদ্ধের অভিবাসননীতির পেছনে এই রিপাবলিকানরা, যাঁদের সমর্থকেরা ‘খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদ’-এর সমর্থক।
বাইডেনকে বাদ দিতে আরব বংশোদ্ভূত মার্কিনদের যে দৃঢ় মনোভাব, তা প্রায়ই উদারপন্থী রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বিভ্রান্ত করে।
মুসলিম ও আরবরা কী করবেন? তাঁরা কি ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছেন? মুসলিম নিষিদ্ধের অভিবাসননীতির পেছনে এই রিপাবলিকানরা। যাঁদের সমর্থকেরা ‘খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদ’-এর সমর্থক।
লুকমান বলেন, ‘আমরা বোকা নই। আমি মুসলিম নিষেধাজ্ঞা থেকে বেঁচে গেছি, কিন্তু গাজার ওই শিশুরা জো বাইডেনের হাত থেকে বাঁচেনি।’ তিনি বলেন, ‘ইসলামভীতি ছড়ায়, এমন কাউকে আমার ভোট দেওয়া উদ্দেশ্যে নয়। বাইডেন যদি কেবল গাজায় মৃতদের পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন, তাহলেই কেবল আমি তাঁকে ভোট দেব, যা আদতে সম্ভব নয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় ভোটারদের প্রায়ই কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন, তা নিয়ে চিন্তায় পড়তে হয়। কারণ, দেখা গেল তাঁরা কোনো প্রার্থীকেই শতভাগ সমর্থন করেন না।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ২৭ বছর বয়সী নার্স ফাতিমা এলজাঘির বলেন, ট্রাম্প তুলনামূলক কম খারাপ।
তবে আব্বাসের মতো অনেকে এই প্রশ্নটাকেই বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আপনি কীভাবে আমাকে এমন প্রশ্ন করেন।’ একটু পর আবার তিনি বলেন, ‘ওহ, ট্রাম্প হবে আপনার ভ্রম।’
আব্বাস বলেন, ‘আপনার প্রতিনিধিদের ডাকুন। তাঁদের বলুন, আপনি যুদ্ধবিরতি চান...রক্তপাত বন্ধ করলেই আমরা রাজনৈতিক পরিণতি নিয়ে কথা বলতে পারি।’
ইউনিয়ন বিভক্ত
বাইডেনকে মিশিগানের ইউনিয়নগুলোর সঙ্গেও লড়তে হবে। যারা শ্রমিকবান্ধব প্রেসিডেন্ট–শিবির থেকে সরে যাচ্ছে।
অনেক ইউনিয়ন ও শ্রমজীবী ভোটার ইতিমধ্যেই রিপাবলিকানদের রক্ষণশীল সামাজিক নীতিতে আকৃষ্ট হয়ে তাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
একজন কারখানাশ্রমিক ও ইউনাইটেড অটোওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সদস্য মারওয়ান বেদউন বলেন, গাজা ছিল ব্রেকিং পয়েন্ট।
বাইডেনের ওপর ‘ক্ষিপ্ত’ মারওয়ান ইউনিয়নের রাজনৈতিক শাখায় তৎপরতা বন্ধ করে দিয়েছেন। অথচ ইউনাইটেড অটোওয়ার্কার্স ইউনিয়ন বাইডেনকে সমর্থন করে।
মারওয়ান নভেম্বরে কীভাবে ভোট দেবেন, সে বিষয়ে কিছু না বললেও ডেমোক্রেটিক অনেক নীতির প্রতি তাঁর এখনো আস্থা আছে বলে জানিয়েছেন। তবে তিনি বলেন, তাঁর ভোট পেতে হলে বাইডেনের ‘জেগে ওঠা’ এবং ‘তাঁর পথ পরিবর্তন’ জরুরি।
বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের হতাশা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে মুসলিম ভোটারদের উদ্বেগ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করেছে।
কিন্তু ৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় দফায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় ওয়াশিংটন। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে আলজেরিয়ার তোলা প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে তা আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
লুকমান বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য হলো, বাইডেন এখন যা করছেন, সে জন্য তাঁকে শাস্তি দেওয়া। তিনি আমার সঙ্গে, আমার সম্প্রদায়ের যাঁরা তাঁকে ভোট দিয়েছেন, সবার সঙ্গে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।’