কমলা–ট্রাম্পের কথার লড়াই হবে সমানে সমান

ট্রাম্প বনাম কমলা ৯০ মিনিটের বিতর্ক প্রচারিত হবে বাংলাদেশ সময় বুধবার সকাল সাতটায়।

কমলা হ্যারিস (বাঁয়ে), ডোনাল্ড ট্রাম্প (ডানে)ফাইল ছবি

মাত্র দেড় মাস আগে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছেন কমলা হ্যারিস। এখনো তাঁর ‘মধুচন্দ্রিমা’ চলছে, যার সুবাদে সারা দেশে জনসমর্থনের দৌড়ে সামান্য হলেও ট্রাম্পের তুলনায় এগিয়ে তিনি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ (কে জিতবে তা অনিশ্চিত) অঙ্গরাজ্যগুলোর পাঁচটিতেই কমলা ভালো অবস্থায় রয়েছেন। এতে অবশ্য স্বস্তি পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এগিয়ে থাকার পরিমাণ এত সামান্য যে সামান্য পা হড়কে গেলে তিনি পিছিয়ে পড়তে পারেন।

ট্রাম্পের সামনে এখন বড় ভরসা ১০ সেপ্টেম্বরে তাঁদের মধ্যে নির্ধারিত টেলিভিশন বিতর্ক। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে এটি তাঁর তৃতীয় প্রচারাভিযান। গত ১০ বছরে তিনি সব মিলিয়ে ১৬টি প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। কোনোটিতেই হয়তো তেমন উজ্জ্বল সাফল্য দেখাননি, কিন্তু বড় কোনো বিপদেও পড়েননি।

সিনেটের সদস্য থাকাকালে রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ তাঁর ছুরির মতো ধারালো জিবকে রীতিমতো ভয়ই করতেন। অনেকেই আশা করছেন, এবারের বিতর্কে সেই ক্ষুরধার কমলার দেখা মিলবে।

অন্যদিকে কমলার জন্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে এটি প্রথম বিতর্ক। ২০২০ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রত্যাশী হিসেবে বাছাইপর্বে তিনি অবশ্য আরও অনেকের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, কৌঁসুলি হিসেবেও তাঁর দক্ষতা সুবিদিত। সিনেটের সদস্য থাকাকালে রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ তাঁর ছুরির মতো ধারালো জিবকে রীতিমতো ভয়ই করতেন। অনেকেই আশা করছেন, এবারের বিতর্কে সেই ক্ষুরধার কমলার দেখা মিলবে।

এমনিতে প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কে নির্বাচনের ফলাফলের ওপর খুব বড় ধরনের প্রভাব পড়ার কথা নয়। কারণ, অধিকাংশ ভোটার কাকে ভোট দেবেন, সে বিষয়ে অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছেন। শুধু মন ঠিক করে ওঠেননি এমন ‘নিরপেক্ষ’ ভোটারদের জন্য এই বিতর্ক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করবে বলে ভাবা হচ্ছে। জনমত জরিপকারীরা জানাচ্ছেন, মন ঠিক করে ওঠেননি, এমন ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১৫ শতাংশ। যেহেতু জনসমর্থনের দিক দিয়ে এই দুই প্রার্থীর ব্যবধান খুবই সামান্য, ফলে মাত্র কয়েক হাজার ভোটের হেরফের হলেই নির্বাচনের ফলাফল উল্টে যেতে পারে। বস্তুত ২০২০ সালে অ্যারিজোনা, জর্জিয়া ও উইসকনসিন—এই তিন রাজ্যে মাত্র ৪৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে ট্রাম্পকে পরাস্ত করেন জো বাইডেন। তারও আগে ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প হিলারি ক্লিনটনকে পরাস্ত করেছিলেন ৭৭ হাজার ভোটে, পেনসিলভানিয়া, মিশিগান ও উইসকনসিনে জয়ের সুবাদে।

প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের কার কত ইলেকটোরাল ভোট, তা পূর্বনির্ধারিত। যে রাজ্যে যত কংগ্রেস সদস্য ও সিনেটর রয়েছেন, তাঁর তত ইলেকটোরাল ভোট। যেমন পেনসিলভানিয়ার রয়েছে ১৭ জন কংগ্রেস সদস্য ও ২ জন সিনেটর, সব মিলিয়ে ১৯টি ইলেকটোরাল ভোট।

ইলেকটোরাল কলেজ

মোট ভোটের হিসাবে নয়, হিলারির পরাজয় ছিল ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের হিসাবে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যবস্থার নিজস্বতার কারণে মোট ভোটের জায়গায় যে প্রার্থী প্রথমে অন্যূন ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট সংগ্রহে সক্ষম হবেন, জয় তাঁরই। ২০২০ সালে বাইডেন ও ট্রাম্প যথাক্রমে পেয়েছিলেন ৩০৬ ও ২৩২ ইলেকটোরাল ভোট, যদিও মোট ভোটের হিসাবে বাইডেন ৭০ লাখ বেশি ভোট পেয়েছিলেন। ২০১৬ সালের ঘটনাটি আরও কৌতূহলোদ্দীপক। সে বছর ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েও কম ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাওয়ায় পরাজিত হন হিলারি ক্লিনটন।

প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের কার কত ইলেকটোরাল ভোট, তা পূর্বনির্ধারিত। যে রাজ্যে যত কংগ্রেস সদস্য ও সিনেটর রয়েছেন, তাঁর তত ইলেকটোরাল ভোট। যেমন পেনসিলভানিয়ার রয়েছে ১৭ জন কংগ্রেস সদস্য ও ২ জন সিনেটর, সব মিলিয়ে ১৯টি ইলেকটোরাল ভোট।

অনেকেই মানেন, এই ইলেকটোরাল ভোটের ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক, লাখ লাখ ভোটারের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে গুটিকয় ইলেকটোরাল ভোটের মাধ্যমে যে ফলাফল, তা কোনোভাবেই নাগরিক ইচ্ছার প্রতিফলন নয়। মার্কিন সংবিধানে এই ইলেকটোরাল ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সাংবিধানিক সংশোধন ছাড়া এই নিয়মের পরিবর্তন সম্ভব নয়। কংগ্রেসের উভয় কক্ষে অনুমোদিত হওয়ার পর দেশের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের অন্তত তিন-চতুর্থাংশের সমর্থন পাওয়া গেলে তবেই কোনো সংশোধনী গ্রহণ সম্ভব। ১৮ শতকে যখন মার্কিন সংবিধান লিখিত হয়, তখন ভাবা হয়েছিল ইলেকটোরাল ব্যবস্থার কারণে প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণা শুধু বড় বড় অঙ্গরাজ্যে সীমিত না করে সারা দেশেই পরিচালনা করবেন। কিন্তু রাষ্ট্রের আদি পিতারা যে আশঙ্কা করেছিলেন, এখন ঠিক তা-ই ঘটছে। চলতি হিসাবে গুটিকয় ‘অনিশ্চিত’ রাজ্য ছাড়া বাকি সব রাজ্যই হয় লাল (রিপাবলিকান) বা নীল (ডেমোক্রেটিক) রাজ্য হিসাবে স্বীকৃত, সে কারণে কোনো দলের প্রার্থীই ‘অনিশ্চিত’ রাজ্যগুলোর বাইরে তেমন একটা প্রচারণায় আসেন না, সেই রাজ্যগুলোর পেছনে বড় রকমের নির্বাচনী ব্যয়ও করেন না।

এবারের বিতর্কে উভয় প্রার্থীর মাথায় থাকবে ঠিক কোন কথা বললে, কীভাবে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করলে ‘অনিশ্চিত’ রাজ্যগুলোর ভোটাররা প্রভাবিত হবেন। বিতর্কের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে পেনসিলভানিয়া, যা এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘অনিশ্চিত’ অঙ্গরাজ্য।

কৌঁসুলি বনাম অপরাধী

একাধিক মামলায় ফেঁসে আছেন ট্রাম্প, একটি মামলায় ৩৪ দফা অপরাধে দোষীও প্রমাণিত হয়েছেন। বিতর্কে তাঁকে মুখোমুখি হতে হবে এমন একজন বিতার্কিকের, যিনি কৌঁসুলি হিসেবে ট্রাম্পের মতো অপরাধীর মামলা পরিচালনা করে সফল হয়েছেন। কমলা উপহাস করে বলেছেন, ট্রাম্পের মতো লোকের ‘টাইপ’ তাঁর জানা। কমলাকে প্যাঁচে ফেলতে ট্রাম্প তাঁর জানা ছলাকলার সবই প্রয়োগ করবেন, সন্দেহ নেই। ভোটারদের মনে সন্দেহ জাগাতে তিনি কমলার বর্ণ ও লিঙ্গ থেকে বুদ্ধিমত্তার খামতি নিয়ে আক্রমণ করবেন। সাম্প্রতিক নানা ভাষণে তিনি কমলাকে অনভিজ্ঞ, নির্বোধ, এমনকি খবিশ বলেও ভর্ৎসনা করেছেন। ভাবা হচ্ছে, বিতর্কে ট্রাম্প কমলাকে একজন অতি উদারনৈতিক বা লিবারেল প্রার্থী হিসেবে উপস্থিত করবেন। অভিবাসন ও অর্থনীতি প্রশ্নে বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতার দায়ভারও চাপাবেন তাঁর ওপর।

৯০ মিনিটের বিতর্কটি প্রচারিত হবে এবিসি টিভিতে, ১০ সেপ্টেম্বর রাত নয়টায় (বাংলাদেশে সময় বুধবার সকাল সাতটা)। ইন্টারনেটে একাধিক ওয়েবসাইটে ও ফেসবুকেও এই বিতর্ক দেখা যাবে।

অন্যদিকে কমলা দর্শকদের মনে করিয়ে দেবেন, গণতন্ত্রের জন্য ট্রাম্প কেন বড় হুমকি। ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, নির্বাচিত হলে তিনি একদিনের জন্য হলেও ‘একনায়কের’ ভূমিকা নেবেন। ‘প্রজেক্ট ২০২৫’ নামে যে নীলনকশা দক্ষিণপন্থী হেরিটেজ ফাউন্ডেশন পরবর্তী ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য তৈরি করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে প্রচলিত রীতিনীতি উপেক্ষা করে ট্রাম্প হয়ে উঠবেন সব ক্ষমতার কেন্দ্র। শিক্ষা বিভাগকে বাতিল করবেন। বিচার বিভাগকে তিনি ব্যবহার করবেন ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা পূরণের জন্য। অনুমান করি, কমলা এসবই তথ্য ও যুক্তি দিয়ে উত্থাপন করবেন। গর্ভপাত নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ট্রাম্পের অবস্থানকেও তিনি কঠোর সমালোচনা করবেন। সেটিই তাঁর ট্রাম্প কার্ড। 

ভোটারদের মনে সন্দেহ জাগাতে তিনি কমলার বর্ণ ও লিঙ্গ থেকে বুদ্ধিমত্তার খামতি নিয়ে আক্রমণ করবেন। সাম্প্রতিক নানা ভাষণে তিনি কমলাকে অনভিজ্ঞ, নির্বোধ, এমনকি খবিশ বলেও ভর্ৎসনা করেছেন।

বিতার্কিক হিসেবে ট্রাম্পকে খাটো করে দেখায় বিপদ রয়েছে। ডেমোক্র্যাট ভাষ্যকার ডোনা ব্রাজিল কমলাকে সতর্ক করে বলেছেন, ট্রাম্পকে হালকাভাবে নেবেন না। ও জাত শো-ম্যান, মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে দর্শকদের মাতাতে তাঁর জুড়ি নেই। অন্যদিকে হিলারি ক্লিনটন ট্রাম্প ক্ষিপ্ত হয়, এমন প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তাঁকে কুপোকাত করার পরামর্শ দিয়েছেন। ২০১৬ সালের এক বিতর্কে তাঁকে ‘পুতিনের পুতুল’ বলায় কথার খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন ট্রাম্প, তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

ট্রাম্প ও কমলা—দুজনেই বিতর্কের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁরা উভয়েই তাঁদের ঘুঁটি ঝালিয়ে নিতে ব্যস্ত। তাঁরা জানেন, জনমতে এগিয়ে যেতে হলে এটাই মোক্ষম সুযোগ।

৯০ মিনিটের বিতর্কটি প্রচারিত হবে এবিসি টিভিতে, ১০ সেপ্টেম্বর রাত নয়টায় (বাংলাদেশে সময় বুধবার সকাল সাতটা)। ইন্টারনেটে একাধিক ওয়েবসাইটে ও ফেসবুকেও এই বিতর্ক দেখা যাবে।