মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: আত্মবিশ্বাসী কমলার কঠিন যাত্রা
‘সেই সব আমেরিকান, যারা তাদের স্বপ্নপূরণে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে, যারা একে অপরের পাশে দাঁড়ায়, যাদের গল্প শুধু আমেরিকাতেই সম্ভব, তাদের সবার পক্ষে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন আমি গ্রহণ করছি।’
গত বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর ইউনাইটেড সেন্টারে ২২ হাজার উৎফুল্ল ও সহর্ষ ডেমোক্র্যাট সমর্থকের সামনে এ কথা বলে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নিজের নির্বাচনী প্রচারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করলেন কমলা হ্যারিস।
কমলা নিজেকে একজন সাধারণ আমেরিকান হিসেবে তুলে ধরেন, যিনি এক শ্রমজীবী অভিবাসী পরিবারে জন্ম নিয়ে শুধু কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার লড়াইয়ে এত দূর হেঁটে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের মতোই একজন আমেরিকান।’
কমলা বলেন, ‘ক্যালিফোর্নিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হিসেবে বিচারকের সামনে সওয়াল-জবাব শুরুর সময় আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বলতাম, কমলা হ্যারিস জনগণের পক্ষে হাজির। বস্তুত আমার পেশাদারি জীবনে আমি বরাবর জনগণের পক্ষেই লড়াই করে এসেছি।’
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, পিতার অঢেল সম্পদে যাঁর লালন, তাঁর পক্ষে সাধারণ আমেরিকানদের দৈনন্দিন লড়াই বোঝা ও তাঁদের লড়াইয়ে শামিল হওয়া সম্ভব নয়। কমলা বলেন, ‘সারা জীবন ট্রাম্প শুধু একজনের জন্যই লড়ে গেছেন, আর সে হলো ট্রাম্প নিজে।’
রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নিজের প্রভেদ চিহ্নিত করতে কমলা বারবার নিজের পরিশ্রমী শৈশবে ফিরে যান। তিনি সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মাননি। তাঁর বিজ্ঞানী মা ভারত থেকে এসেছিলেন ক্যানসার রোগের নিরাময় আবিষ্কারের স্বপ্ন নিয়ে। জ্যামাইকা থেকে আগত স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর একাই সংসার সামলেছেন, নিজের দুটি মেয়েকে এই আত্মবিশ্বাসে লালন করেছেন যে পরিশ্রম ও একাগ্রতার কোনো কিছুই বৃথা যায় না।
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, পিতার অঢেল সম্পদে যাঁর লালন, তাঁর পক্ষে সাধারণ আমেরিকানদের দৈনন্দিন লড়াই বোঝা ও তাঁদের লড়াইয়ে শামিল হওয়া সম্ভব নয়। কমলা বলেন, ‘সারা জীবন ট্রাম্প শুধু একজনের জন্যই লড়ে গেছেন, আর সে হলো ট্রাম্প নিজে।’
এর এক দিন আগে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন কমলার রানিং মেট হিসেবে দলীয় মনোনয়ন গ্রহণ করেন মিনেসোটার গভর্নর টিম ওয়ালজ। এই মনোনয়নের ভেতর দিয়ে কমলা-ওয়ালজ জুটি আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্প-জে ডি ভ্যান্সের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইয়ে শামিল হলেন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিসের মনোনয়ন এক মাস আগেও অভাবিত ছিল। এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ছিল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের, যিনি দুই মাসের বেশি সময় ধরে অনুষ্ঠিত দলীয় বাছাইপর্বে জয়ী হয়ে দলীয় মনোনয়ন গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু ৮২ বছরের বাইডেন এই পদে দায়িত্ব পালনে সক্ষম কি না, এই প্রশ্নে মার্কিন নাগরিকদের মনে দ্বিধা ক্রমেই বাড়ছিল। ২৭ জুন ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম বিতর্কে নিদারুণ ব্যর্থতার পর দলের ভেতরেই তাঁর প্রার্থিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। জনমত জরিপের ভিত্তিতে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে শুধু তিনি একা আগামী নির্বাচনে পরাস্ত হবেন তা–ই নয়, তাঁর কারণে কংগ্রেসে ও সিনেটেও ডেমোক্র্যাটদের ভরাডুবি হবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির পরামর্শ শুনে, স্পষ্টতই প্রবল অনাগ্রহে, বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ান। ২১ জুলাই দলীয় প্রার্থী হিসেবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন কমলা হ্যারিস।
৮২ বছরের বাইডেন এই পদে দায়িত্ব পালনে সক্ষম কি না, এই প্রশ্নে মার্কিন নাগরিকদের মনে দ্বিধা ক্রমেই বাড়ছিল।
কমলার পক্ষে ট্রাম্পকে পরাস্ত করা সম্ভব কি না, এ নিয়ে আমেরিকানদের মনে বিস্তর দ্বিধা ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নির্বাচনী ভাষায়, তাঁর ‘অ্যাপ্রুভাল’ বা সমর্থন বাইডেনের চেয়েও কম ছিল। বাইডেন সরে দাঁড়াচ্ছেন, এ কথা ঘোষিত হওয়ামাত্রই রাতারাতি বদলে যায় পরিস্থিতি। দলের মধ্যে যে প্রবল হতাশা ও অনাগ্রহ কাজ করছিল, তার বদলে সারা দেশে অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য সঞ্চারিত হয়। এক মাসে প্রায় ৩০ কোটি ডলার চাঁদা তোলেন কমলা, যার অধিকাংশ আসে সাধারণ আমেরিকানদের কাছ থেকে। হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নাম লেখান। ডেমোক্রেটিক পার্টির কৌশলবিদ ডেভিড এক্সেলরডের ভাষায়, যেন এক তড়িৎপ্রবাহে সংবিৎ ফিরে পায় ডেমোক্রেটিক পার্টি। তাঁরা এই বিশ্বাস ফিরে পান যে ট্রাম্পকে হারানো সম্ভব। শুধু সম্ভব নয়, তাঁকে হারাতে হবে। কারণ, অন্যথায় আমেরিকার গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ ভয়াবহ হুমকির সামনে পড়ে যাবে।
গত এক মাসে জনমত জরিপে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এসেছেন কমলা। বাইডেন যেখানে ৫-৭ পয়েন্টে পিছিয়ে ছিলেন, সেখানে কমলা এ মুহূর্তে জাতীয় পর্যায়ে ট্রাম্পের চেয়ে ২ পয়েন্টে এগিয়ে। মার্কিন নির্বাচনের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী, মোট ভোটের হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো ইলেকটোরাল ভোটে অন্যূন ২৭০টি ভোট পাওয়া। এই সংখ্যক বা তার চেয়ে বেশি ভোট পেতে হলে ট্রাম্প বা কমলাকে ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ হিসেবে পরিচিত সাতটি অঙ্গরাজ্যের অধিকাংশে জয় পেতে হবে। এর প্রতিটিতেই বাইডেন বড় ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলেন। কমলা সে ব্যবধান কমিয়ে এনেছেন, কোনো কোনোটিতে তিনি এগিয়েও গেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট তিনি নিশ্চিত করেছেন, তা বলা যাবে না। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সফল দলীয় সম্মেলনের পর সারা দেশের মানুষ কমলা হ্যারিস ও টিম ওয়ালজকে আগের চেয়ে ভালোভাবে জানতে পেরেছেন। ফলে যে হারে জনসমর্থনের সিঁড়ি ভেঙে তাঁরা এগোচ্ছেন, তাতে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব নয়।
রিপাবলিকান অথবা নিরপেক্ষ ভোটার এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন, তাঁদের লক্ষ্য করে সাবেক রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য এডাম কিনজিঙ্গার অনুরোধ করেছেন, দলের ঊর্ধ্বে দেশ, সে কথা ভুলবেন না। রিপাবলিকান হলেও আরও অনেকের মতো তিনিও কমলাকে সমর্থন করছেন।
গত বৃহস্পতিবার অর্থাৎ যেদিন কমলা মনোনয়ন গ্রহণ করেন, তাঁর জন্য একটি সুখবর দেয় নির্ভরযোগ্য জনমত জরিপ সংগঠন গ্যালপ পোল। তাদের গৃহীত সর্বশেষ জরিপ অনুসারে, আগস্ট মাসে কমলার জনসমর্থন ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে কমলা ও ট্রাম্পের আনুপাতিক সমর্থন ৪৭% ও ৪১%। এই নাটকীয় পরিবর্তনের প্রধান কারণ, অধিকাংশ আমেরিকান ট্রাম্পকে তাঁদের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান না। নিজস্ব অতি-অনুগত সমর্থকদের বাইরে অধিকাংশ আমেরিকান মনে করেন, এই পদের জন্য ট্রাম্প মোটেই যোগ্য নন। যেসব রিপাবলিকান অথবা নিরপেক্ষ ভোটার এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন, তাঁদের লক্ষ্য করে সাবেক রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য এডাম কিনজিঙ্গার অনুরোধ করেছেন, দলের ঊর্ধ্বে দেশ, সে কথা ভুলবেন না। রিপাবলিকান হলেও আরও অনেকের মতো তিনিও কমলাকে সমর্থন করছেন।
তবে হেসে–খেলে জয় ছিনিয়ে নেবেন কমলা-ওয়ালজ জুটি, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। ট্রাম্প ইতিমধ্যে তাঁদের অতি উদারনৈতিক ও বামপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কমলা নির্বাচিত হলে আমেরিকা কিউবা বা ভেনেজুয়েলার মতো হতদরিদ্র এক দেশে পরিণত হবে। লক্ষ লক্ষ বহিরাগত সীমান্ত ডিঙিয়ে এ দেশে প্রবেশ করবে, যার ফলে শুধু দেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। শুধু তা–ই নয়, আমেরিকার চিরাচরিত মূল্যবোধ হারিয়ে যাবে। বিদ্রূপ করে ট্রাম্প কমলার নাম দিয়েছেন কমরেড কমলা (তাঁর উচ্চারণে কামালা)।
কমলা হ্যারিসের চ্যালেঞ্জ
কমলার প্রধান চ্যালেঞ্জ দুটি—অর্থনীতি ও অভিবাসন। উভয় প্রশ্নেই অধিকাংশ আমেরিকান মনে করেন, একমাত্র ট্রাম্পের পক্ষেই অবস্থা সামাল দেওয়া সম্ভব। এ দেশের শ্বেতকায় পুরুষদের অধিকাংশ এখনো একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত নন। কমলাকে সেই বাধাও অতিক্রম করতে হবে। তবে তাঁর জন্য বড় সহায় গর্ভপাতের প্রশ্নটি। এ দেশের অধিকাংশ নারী ও পুরুষ মনে করেন, গর্ভপাতের প্রশ্নে রাষ্ট্র নয়, প্রতিটি নারী যাঁর যাঁর সিদ্ধান্ত নেবেন। ২০২২ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের এক সিদ্ধান্তে এত দিন পর্যন্ত বহাল গর্ভপাতের অধিকার রদ হয়। ট্রাম্পের মনোনীত তিনজন রক্ষণশীল বিচারপতির ভোটেই এই রদ সম্ভব হয়। কমলা গর্ভপাতের অধিকার রদের জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করেছেন। আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সে অধিকার ফিরিয়ে দেবেন।
কমলার অন্য আরেক চ্যালেঞ্জ গাজায় অব্যাহত যুদ্ধ। অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন, এই প্রশ্নে মতভেদকে কেন্দ্র করে ডেমোক্রেটিক পার্টির সম্মেলনে বড় রকমের বিতণ্ডার সৃষ্টি হবে। সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হলেও সম্মেলনের কার্যক্রমে কোনো বাধার সৃষ্টি হয়নি। কমলা জানেন, যুদ্ধবিরোধী মুসলিম ও আরব ভোটের বিরোধিতার কারণে তিনি মিশিগান, জর্জিয়া ও উইসকনসিনের মতো অঙ্গরাজ্যে পরাজিত হতে পারেন, যা ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পেতে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠতে পারে। সে কথা মাথায় রেখে তিনি ইসরায়েলের নিরাপত্তা সমর্থনের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের জনগণের স্বার্থরক্ষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। তিনি শুধু অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির কথাই বলেননি, ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পক্ষেও দাবি তোলেন।
কমলার জন্য আশু শিরপীড়া ১০ সেপ্টেম্বর ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি টেলিভিশন বিতর্ক। তিনি একজন অভিজ্ঞ কৌঁসুলি, তাঁর নিজের কথায়, ট্রাম্পের মতো আরও অনেক প্রতারক ও নারী লাঞ্ছনাকারীকে তিনি জেলের ভাত খাইয়ে ছেড়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই চরিত্রের লোকদের আমি ভালো করে চিনি।’
শুধু আমেরিকা নয়, সারা পৃথিবী অপেক্ষায় থাকবে কমলা তাঁর এই আত্মবিশ্বাস কীভাবে, কতটা প্রমাণ করেন।