যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ যুদ্ধনীতি কী হবে, প্রকাশ পাচ্ছে ইউক্রেনে

পোল্যান্ডের কিয়েলসে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ৩০তম আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রদর্শনীতে যুক্তরাষ্ট্রের এম১/এ২ আব্রামস ট্যাংক। যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম এই ট্যাংকও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাচ্ছে ইউক্রেন বাহিনী।
ছবি: রয়টার্স

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সমরাস্ত্রগুলো বিশেষ কার্যকর হয়েছে, বিশেষ করে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভাগ্যজনক প্রত্যক্ষ যুদ্ধের তুলনায়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলের দেওয়া এক বিবৃতিতে এর কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেনীয়রা কাউকে তাঁদের হয়ে যুদ্ধ করতে বলছেন না। তাঁরা আমেরিকান সেনা বা ব্রিটিশ, জার্মান, ফ্রান্স বা অন্য কেউ তাঁদের হয়ে যুদ্ধ করুক, সেটা চাইছেন না। ইউক্রেনীয়রা শুধু রুশ হামলাকারীদের থেকে নিজেদের রক্ষার পথ খুঁজছেন। আর যত দিন লাগবে, তত দিন যুক্তরাষ্ট্র এ সহায়তা দিয়ে যাবে।’ ইউক্রেন যাতে রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীকে দুর্বল করে দিতে পারে এবং ওই অঞ্চলে রাশিয়ার দখলে থাকা এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারে, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো উন্নত অস্ত্রশস্ত্র এবং নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে।

আরও পড়ুন

পক্ষান্তরে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ইউক্রেনে পূর্ণশক্তি নিয়ে আক্রমণ করতে উৎসাহ দিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তবে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো, সরাসরি মার্কিন সৈন্য মোতায়েন না করে সর্বোচ্চ সামরিক সহায়তা দেওয়া।

এটা শুধু ইউক্রেনকে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা এবং পুতিনকে হারানোর সর্বোত্তম উপায়ই নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সামরিক সম্পৃক্ততাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত, সেই মডেলও দাঁড় করিয়েছে। যদিও কেউ কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রভাব ব্যাপক কমে গেছে। এটা অতিরঞ্জিত হলেও অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা কিছুটা কমেছে। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামরিক শক্তিও একই ধারা অনুসরণ করবে। আর এটা বিদেশের মাটিতে সেনা মোতায়েন না করার একটি যৌক্তিক কারণ।

আরও পড়ুন

আগে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ছিল, যুদ্ধে অর্থপূর্ণ সফলতা পেতে চাইলে ময়দানে তাদের সৈন্য মোতায়েন করা দরকার, যা ১৯৮০-এর দশক থেকে বারবার দেখা গেছে। যদিও প্রায়ই ঘটেছে উল্টোটা। মার্কিন বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের যত জড়িয়েছে, যত সেনা মোতায়েন করেছে, ততটাই তা ব্যয়বহুল হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ হস্তক্ষেপের ফলাফল উল্টো হয়েছে। কিছু কিছু যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন সমাজে মেরুকরণ তৈরি হয়েছে। যেমন ভিয়েতনাম, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ।

ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানাতে যুদ্ধের বর্ষপূর্তির আগে কিয়েভ সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
ছবি: এএফপি

ইতিমধ্যে যুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিলেও আর্থিক সহায়তা, উন্নত প্রযুক্তি, গোয়েন্দা তথ্য এবং এমনকি কূটনৈতিক সমন্বয়ের ওপর নির্ভর করে এবং যেখানে যেখানে প্রভাব রাখা যায়, তা করে যুক্তরাষ্ট্র যা অর্জন করতে চাইছে, তা ভালোভাবেই করতে পারছে।

আরও পড়ুন

২০২১ সালের মধ্য আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে নিজেদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। এটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বড় পরাজয়গুলোর একটি। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের এই হস্তক্ষেপ ছিল সবচেয়ে ব্যয়বহুল। মার্কিন বাহিনী আফগান সেনাবাহিনীর পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু তালেবান যখন কাবুলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন মার্কিন বাহিনী নামমাত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিছু কিছু আফগান সেনা তখন নিজেদের অবস্থানও পাল্টে ফেলে। মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তালেবান ক্ষমতা দখল করে নেয়। রাশিয়াসহ অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকে হতাশ করেছে। এরপর এল ইউক্রেন যুদ্ধ, যেখানে রাশিয়ার বাহিনীকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

আরও পড়ুন

অনেকে মনে করেন, ইউক্রেনকে সহায়তা করাটা ভিত্তিহীন। কারণ, এই যুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনীতে সহায়তার মার্কিন প্রতিশ্রুতি রুশ হামলা বন্ধের ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে কোনো পার্থক্য তৈরি করবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে শুধু প্রাথমিক হামলা প্রতিরোধের জন্যই সাহায্য করছে না, রাশিয়ার বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করারও লক্ষ্য রয়েছে। ওয়াশিংটন ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীকে বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম, উচ্চ গতিসম্পন্ন আর্টিলারি রকেট সিস্টেমসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করেছে।

ইউক্রেন বাহিনীর সদস্যরা সীমান্তের বাইরে থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত সহায়তা পাচ্ছেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সামরিক সরঞ্জাম কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামত করতে হয়, তা শিখছেন।

মাঠপর্যায়ে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে কিয়েভকে পৌঁছে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইউক্রেন বাহিনী রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লক্ষ্য করে দ্রুত ও কার্যকরভাবে হামলা চালাতে পারছে।

আরও পড়ুন

দারুণভাবে এবং কিছুটা বিস্ময়করভাবে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের সহায়তা ন্যাটোকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করছে। এক বছর আগে এই জোট মৃতপ্রায় অবস্থায় ছিল। সেখানে শিগগিরই এই জোটে নতুন সদস্য হতে যাচ্ছে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। এখন মনে করা হচ্ছে, ন্যাটোর সদস্য হওয়ার অর্থ, এর কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। যেমনটা ইউক্রেন এই জোটে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে।

ইউক্রেনকে দেওয়া পশ্চিমা সহায়তা এতটা কাজে দিয়েছে যে কেউ কেউ বলছেন, এখন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইউক্রেনের লাগাম কিছুটা টেনে ধরে আলোচনার টেবিলে আনা। না হলে এই যুদ্ধ পুতিনের জন্য লজ্জার হয়ে দাঁড়াবে। ইউক্রেন ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের যে ভিন্নতা, তা ভবিষ্যতে যুদ্ধক্ষেত্রে দেশটির ভূমিকা কী হতে পারে, সেই ইঙ্গিত দেয়। আর তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের যতটা সম্ভব বিদেশের মাটিতে সরাসরি যুদ্ধ এড়ানো এবং যেসব মানুষ বা জাতি নিজেদের জন্য যুদ্ধ করতে চায়, তাদের সহযোগিতা করা। ইউক্রেনের বাসিন্দারা তাঁদের দেশের জন্য দৃঢ়তা ও দক্ষতার সঙ্গে লড়াই করছেন, নিজস্ব উদ্যোগে জটিল অস্ত্রব্যবস্থা আয়ত্ত করেছেন এবং মনোবল বজায় রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন।

আরও পড়ুন

যদিও ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে সরাসরি সেনা মোতায়েন করে, তখন সেখানকার অনেকগুলো উপদল এটিকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু যতই সময় যেতে লাগল সেনা নিয়ন্ত্রণের চাপ মার্কিন বাহিনীর কাঁধে চেপে বসে। আফগান সেনাবাহিনী গড়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টার ফলে এমন একটি বাহিনী গড়ে উঠেছিল, যাদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও ভূমিকার ঘাটতি ছিল। মার্কিন-সমর্থিত আফগান সরকারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হয়। যারা মার্কিন সামরিক সহায়তা ছাড়া ক্ষমতা ধরে রাখতে অক্ষম ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাস থেকে নেওয়া শিক্ষা প্রায়ই ভুলে যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাদের কোণঠাসা করে এবং সেখানকার সরকারের বৈধতাকে অবমূল্যায়ন করে নিজেদেরই ক্ষতি করে। স্থানীয় বাহিনীকে কোণঠাসা করার ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণে মার্কিন সামরিক নেতারা যুক্তি দিয়েছিলেন, আরও বেশি মার্কিন সেনা এখানে নিয়ে এলে মূল লক্ষ্যগুলো অর্জিত হবে। অথচ এত বেশি মার্কিন সেনা মোতায়েন যে সংঘাতকে আবার আগের রূপে ফিরিয়ে নিতে পারে এবং জটিল করে তুলতে পারে, তা বিবেচনায় নেয়নি।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় সাফল্য এসেছে মার্কিন সেনাদের যুদ্ধে পাঠানোর পরিবর্তে এক পক্ষকে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে। ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর স্থানীয় মুজাহিদীনদের সহায়তা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যা রাশিয়ার প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত সামরিক শক্তিকে প্রতিহত করতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের বিরোধিতাকারী ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠীগুলোকে সাহায্য করে সুফল পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের এই সমর্থন ভাঙনের মুখে থাকা সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে পূর্ব ইউরোপে রাজনৈতিক অধিকারের সংগ্রামকে অসম্ভব করে তুলেছিল।

আরও পড়ুন

মার্কিন সেনাদের সরাসরি যুদ্ধে মোতায়েনের নেতিবাচক দিকগুলো যেমন একদিকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তেমনি অন্যদিকে নিজেরা যুদ্ধে না জড়িয়ে যেসব দেশ নিজেদের জন্য লড়াই করছে, তাদের সহায়তার সুফলগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। আফগানিস্তান ও ইউক্রেনের অভিজ্ঞতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী হতে পারে, এ সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। চীন যদি তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যেভাবে সহযোগিতা করেছে, সেভাবে সহযোগিতা করতে পারে।

ইউক্রেনীয়রা দেখিয়েছেন, মার্কিন যুদ্ধ সরঞ্জাম অন্য দেশের যুদ্ধাস্ত্রের তুলনায় কতটা উন্নত। যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে স্যাটেলাইট ও অন্যান্য গোয়েন্দা ডিভাইসের পেছনে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে এখন ইউক্রেনকে সুবিধা দিতে পারছে। ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমাণ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র সেনা পাঠানোর ওপর নির্ভর না করে অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর কৌশলগত সহায়তা দিতে সক্ষম।
অনুবাদ করেছেন লিপি রানী সাহা