পুরোনো কৌশলে আগাম প্রস্তুতি ট্রাম্পের
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর মিত্ররা আবারও পুরোনো কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। চার বছর আগের মতো এবারও তাঁরা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন। তবে এবার অভিযোগ তুলছেন নির্বাচনের আগেই। এবার আরও কোমর বেঁধে নেমেছেন তাঁরা। বাইরের বিভিন্ন গোষ্ঠী এনে দল ভারী করছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভোটে হারলে কারচুপির অভিযোগ তুলে আবারও ঝামেলা পাকাবেন ট্রাম্প।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য আগামী মঙ্গলবার ভোট দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা। তবে ট্রাম্প ইতিমধ্যে ডেমোক্র্যাটদের ‘প্রতারকের দল’ বলে উল্লেখ করেছেন। এদিকে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে ট্রাম্পের মিত্ররা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন। এর মাধ্যমে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির একটি বয়ান তৈরি করতে চাইছে ট্রাম্প শিবির।
ট্রাম্প ও তাঁর সবচেয়ে পরিচিত সমর্থকেরা আজগুবি সব দাবি করতে শুরু করেছেন। তাঁদের দাবি, ট্রাম্প এবার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হবেন। ট্রাম্পের অন্যতম মিত্র মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক বলেছেন, ‘নিরঙ্কুশ বিজয়’ পেতে যাচ্ছেন ট্রাম্প। এদিকে ট্রাম্পের জয় নিয়ে বাজি ধরাও চলছে হরদম। ট্রাম্প হেরে গেলে তাঁর সমর্থকদের মধ্যে যেন ক্ষোভ তৈরি হয়, সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে এর মাধ্যমে।
ট্রাম্পের প্রভাবশালী উপদেষ্টাদের কারও কারও ইঙ্গিত, এবারও সব ভোট গণনা হওয়ার আগেই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করবেন ট্রাম্প। ২০২০ সালের নির্বাচনে হেরে কারচুপির অভিযোগ তুলে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন তৎকালীন এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানিয়ে সমর্থকদের উসকানিও দিয়েছিলেন। ট্রাম্পের উসকানিতে কংগ্রেস ভবনে (দ্য ক্যাপিটল) ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি হামলা করেছিলেন তাঁর সমর্থকেরা।
নির্বাচনে আস্থা বাড়ানো নিয়ে কাজ করা অলাভজনক সংস্থা স্টেটস ইউনাইটেড ডেমোক্রেসির প্রধান নির্বাহী জোয়ানা লিডগেট এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর ধরে নির্বাচন নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জ করতে স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে যেখানে–সেখানে মামলা করা হয়েছে। এত দিন ধরে নানাভাবে যে অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে তারই ফল এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
ডোনাল্ড ট্রাম্প যে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন তাতে অবাক হয়নি ডেমোক্র্যাট শিবির। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসের প্রচারশিবিরের অন্যতম আইনজীবী ডানা রেমাস বলেছেন, ‘নির্বাচন চলমান এবং মূল ভোট গ্রহণের দিন আসার আগেই ট্রাম্প যে নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। তিনি ২০২০ সালে এই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, এবারও ব্যর্থ হবেন।’
যেসব দাবি করতে পারেন ট্রাম্প
ট্রাম্প প্রথম যে কাজটি করতে পারেন তা হলো, ভোটগণনার আগে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করা। ট্রাম্পের শীর্ষ উপদেষ্টা স্টিফেন কে ব্যানন গত নির্বাচনের সময় কংগ্রেসে হামলার ঘটনায় কারাগার থেকে গত মঙ্গলবার মুক্তি পেয়েছেন। কারামুক্ত হয়েই তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের দিন ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করবেন। এর মানে এই নয় যে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। তিনি শুধু নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করবেন।’
ট্রাম্পের আরেকটি কৌশল হতে পারে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ফলাফল নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা। নির্বাচনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানবসৃষ্ট বা কারিগরি কিছু ত্রুটির ঘটনা ঘটে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব ত্রুটিকে নির্বাচনে কারচুপির সঙ্গে তুলনা করে এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন ট্রাম্প ও তাঁর মিত্র–সমর্থকেরা। এসব ভুলত্রুটিকে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের অপরাধ হিসেবে তুলে ধরতে চাইবে ট্রাম্প শিবির।
ট্রাম্প নিজেও ইতিমধ্যে এমন কথা বলেছেন। গত মঙ্গলবার পেনসিলভানিয়ায় এক নির্বাচনী সমাবেশে গিয়ে তিনি বলেন, সেখানে ইতিমধ্যে ভোট কারচুপি শুরু হয়েছে। পাশাপাশি তিনি আরও দাবি করেন, স্থানীয় কর্মকর্তারা ভুয়া ব্যালট জব্দ করেছেন। ট্রাম্প বলেন, ‘পেনসিলভানিয়ার নির্বাচনে কারচুপি করতে গিয়ে ধরা পড়ার ঘটনাও ঘটছে। এত বড় পরিসরে কারচুপি আগে তেমন দেখা যায়নি।’
গত নির্বাচনে কারচুপিসহ নানা দাবি করেও ব্যর্থ হয়ে ট্রাম্প শেষে নির্বাচনের ফলাফলে কংগ্রেসের স্বীকৃতিদানে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এটা করতে ট্রাম্প তাঁর কর্মী–সমর্থকদের ক্যাপিটলে হামলায় উসকানি দিয়েছিলেন। কংগ্রেসে যখন নির্বাচনের ফলাফলে চূড়ান্ত অনুমোদনের কার্যক্রম চলছিল তখনই হামলা হয়। এবারও ট্রাম্পের সমর্থকেরা নির্বাচনের ফল নিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, গতবারের তুলনায় এবারে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। গতবারের হামলার ঘটনার পর ভোটগণনা–সংক্রান্ত আইনে সংস্কার আনা হয়েছে। এতে করে গতবার ভোটের ফলাফল কংগ্রেসে চূড়ান্ত অনুমোদনে ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকেরা যেভাবে বাধা দিয়েছিলেন, এবার সেটা আরও কঠিন হবে। দ্বিতীয়ত, সেবার ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর হাতে অনেক ক্ষমতা ছিল। এবার যা নেই। এ ছাড়া পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে এবার নির্বাচনের কাজে যুক্ত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা আরও জোরদার করার পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ কারণে গত নির্বাচনের মতো সুযোগ পাবেন না ট্রাম্প।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত ডেমোক্র্যাট
ট্রাম্প যদি ২০২০ সালের মতো এবারও আগাম জয় দাবি করেন, তবে তা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন ডেমোক্র্যাটরাও। ডেমোক্রেটিক প্রার্থী ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের নির্বাচনী শিবির ও দলীয় কর্মকর্তারা রয়টার্সকে সেই প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন।
ট্রাম্প এ সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর আশা, ভোটের দিনই নিজের জয়ী হওয়ার বিষয়টি ঘোষণা করতে পারবেন তিনি। যদিও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ভোটের ফলাফল ঘোষণা করতে কয়েক দিন লেগে যেতে পারে। বিশেষ করে যদি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এলাকায় ভোট পুনর্গণনার দাবি ওঠে। আর এবার প্রায় সব জনমত জরিপে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী দাবি করলে কীভাবে সেটা মোকাবিলা করবেন এমন প্রশ্নে সম্প্রতি এবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কমলা বলেছেন, ‘দুঃখজনকভাবে হলেও আমরা প্রস্তুত। যদি তিনি (ট্রাম্প) নিজেকে (বিজয়ী) দাবি করেন এবং যদি আমরা জানতে পারি, তিনি সত্যি সংবাদমাধ্যমকে চালিত করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মতামতের ওপর হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন...আমরা জবাব দিতে প্রস্তুত।’
কী ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেননি কমলা হ্যারিস। তবে ডেমোক্রেটিক পার্টি ও কমলার নির্বাচনী শিবিরের ছয়জন কর্মকর্তা বলেছেন, ট্রাম্প যদি আগাম জয় ঘোষণা করেন, তবে প্রাথমিক লড়াই হবে জনগণের আদালতে। তাঁদের পরিকল্পনা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশনে বিজয়ীর নাম ঘোষণার আগে সব ভোট গণনার জোরালো দাবি জানাবেন।
এদিকে রিপাবলিকান পার্টির পুরোনো কৌশল নেওয়ার প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে নিউইয়র্ক টাইমসের পক্ষ থেকে ট্রাম্পের প্রচারশিবিরে ই–মেইল করা হয়। সেই ই–মেইলের জবাব দেয়নি ট্রাম্প শিবির।