জলবায়ু ইস্যুতে দুই মেরুতে ট্রাম্প-কমলা, তাঁদের এ অবস্থানের বৈশ্বিক প্রভাব কী

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসফাইল ছবি: রয়টার্স ও এএফপি

‘ড্রিল, বেবি, ড্রিল’ (বেশি বেশি তেল–গ্যাসকূপ খনন সমর্থন করে রিপাবলিকানদের নেওয়া একটি স্লোগান) নাকি সবুজ জ্বালানিকে উৎসাহিত করা—বৈশ্বিক জলবায়ুসংক্রান্ত এমন দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্রেটিক পার্টির কমলা হ্যারিস।

দুই প্রার্থীর এমন দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। কেননা এ নির্বাচনের ফলাফল ক্রমেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে ওঠা আমাদের এ পৃথিবীর উষ্ণায়নের গতিপথ নির্ধারণ করে দিতে পারে।

জলবায়ু ইস্যুতে ট্রাম্প ও কমলা বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করলেও তাঁদের কেউই এ নিয়ে কোনো সমন্বিত রূপরেখা তুলে ধরেননি। এ ছাড়া এবারের নির্বাচনী প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে অনেকটা দূরে থাকছে জলবায়ু ইস্যুটি। অথচ চীনের পর যুক্তরাষ্ট্রই হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ।

অবশ্য, দুই প্রার্থীর দৃষ্টিভঙ্গিতে রহস্যের কিছু নেই। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনকে বহু আগেই ‘ধাপ্পাবাজি’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নির্বাচনে আবার জিতলে বাইডেন–কমলা প্রশাসনের জলবায়ুবান্ধব নীতিগুলো উল্টে দেওয়ার।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে সবুজ জ্বালানি–সবুজ পৃথিবীতে উত্তরণের পথ বিশেষভাবে মন্থর হয়ে পড়তে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যগুলো পূরণের আশায়ও পড়তে পারে ছেদ। তা ছাড়া জলবায়ু কূটনীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পিছুহটায় জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা হ্রাসে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ক্ষুণ্ন হতে পারে।

দুই প্রার্থীর দৃষ্টিভঙ্গিতে রহস্যের কিছু নেই। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনকে বহু আগেই ‘ধাপ্পাবাজি’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নির্বাচনে আবার জিতলে বাইডেন-কমলা প্রশাসনের জলবায়ুবান্ধব নীতিগুলো উল্টে দেওয়ার।

মার্কিন নির্বাচনের মাত্র ছয় দিন পর শুরু হতে যাচ্ছে ‘কপ২৯’ জাতিসংঘ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন। ট্রাম্প জিতলে শীর্ষ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারীদের প্রভাবও দুর্বল হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সমর্থন গতিশীল করতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী রাষ্ট্রগুলোর আরও শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি অপরিহার্য বলে ধরা হয়। এ বছরের জলবায়ু সম্মেলনে যেসব বিষয়ের ওপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হবে, এটি তার অন্যতম।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প জলবায়ু নিয়ে ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি থেকে তাঁর দেশকে সরিয়ে নেন। ডেমোক্র্যাট নেতা জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে নেন। তবে, পুনরায় নির্বাচিত হলে নিজের আগের অবস্থানে ফেরার অঙ্গীকার করেছেন ট্রাম্প।

প্যারিস চুক্তির বাধ্যবাধকতা পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ অর্ধেকে নামিয়ে আনার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। নিরপেক্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান রোডিয়াম গ্রুপের তথ্যমতে, বাইডেনের প্রেসিডেন্ট মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সাল পর্যন্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ১৮ শতাংশ কমাতে সমর্থ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমিয়ে আনার ধারা আসলেই ধরে রাখতে হবে। কিন্তু ট্রাম্প জিতলে এটি সম্পূর্ণ উল্টে যেতে পারে। মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল পুরো পৃথিবীর ওপরই প্রভাব ফেলবে।
—লিহ স্টোকস, ইউনিভর্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা বারবারার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী

ইউনিভর্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা বারবারার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লিহ স্টোকস বলেন, ‘গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনার এ ধারা আমাদের আসলেই ধরে রাখতে হবে। কিন্তু ট্রাম্প জিতলে এটি সম্পূর্ণ উল্টে যেতে পারে।’

লিহ স্টোকস এএফপিকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল পুরো পৃথিবীর ওপরই প্রভাব ফেলবে।’

এদিকে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কমলার নির্বাচনী প্রচারশিবিরের ওয়েবসাইটে বলা হয়, ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা গতবারের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে (কপ২৮) যোগ দিয়েছিলেন। কার্বন গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে ওই সম্মেলনে একটি চুক্তি সইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র (বাইডেন–কমলা প্রশাসন)।

কমলার প্রচারশিবির আরও বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা ও যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু নেতৃত্বের আসনে বসাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তারা।

প্যারিস চুক্তির বাধ্যবাধকতা পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ অর্ধেকে নামিয়ে আনার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। নিরপেক্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান রোডিয়াম গ্রুপের তথ্যমতে, বাইডেনের প্রেসিডেন্ট মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সাল পর্যন্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ১৮ শতাংশ কমাতে সমর্থ হয়েছে।

‘গ্রিন নিউ ডিল’ নামের একটি প্রস্তাবেরও সহপৃষ্ঠপোষক কমলা। প্রস্তাবটিতে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার আহ্বান জানানো হয়েছে। অথচ এ প্রস্তাবকেই ‘গ্রিন নিউ স্ক্যাম’ নামে আখ্যায়িত করেছেন ট্রাম্প।

ইতিপূর্বে ২০১৯ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে রাখা বক্তৃতায় কমলা ‘ফ্র্যাকিং’ নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানান। ‘ফ্র্যাকিং’ একটি বিতর্কিত ও পরিবেশের উচ্চ দূষণ সৃষ্টিকারী প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে অন্যতম শীর্ষ প্রাকৃতিক গ্যাস ও অশোধিত জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

তবে নির্বাচন সামনে রেখে কমলা জলবায়ু ইস্যুতে সুর পাল্টেছেন। বিশেষ করে পেনসিলভানিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ অবস্থান নিয়েছেন তিনি। মার্কিন নির্বাচনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যটির অর্থনীতিতে ফ্র্যাকিং শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আবার দেশজুড়ে নির্বাচনী প্রচারেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় কমই উচ্চারণ করছেন কমলা।

বিজ্ঞান ও জলবায়ু পরিবর্তন নীতিবিষয়ক যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওয়েবসাইট কার্বন ব্রিফের এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ট্রাম্প জিতলে ২০৩০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ৪ বিলিয়ন (৪০০ কোটি) টন কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণের সম্মুখীন হতে পারে বিশ্ব; যা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ও জাপানের বার্ষিক নিঃসরণের সমান।