এখন ইহুদি ভোট নিয়েও দুশ্চিন্তা বাইডেন শিবিরে
হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলা ও তার জবাবে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ঘিরে যে অস্থিরতা চলছে, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ডেমোক্র্যাট শিবিরে। এ যুদ্ধের কারণে বাইডেনের প্রতি তাঁর ইহুদি ভোটারদের সমর্থন কমে যায় কি না, সেটাই এখন ডেমোক্র্যাটদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগামী নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়েছে। ডেমোক্র্যাট নেতা বাইডেনকে লড়তে হবে তাঁর পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে।
নির্বাচনের এ ডামাডোলে সবার এখন মনোযোগ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোয় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ আরব বংশোদ্ভূত আমেরিকান ও প্রগতিশীল ইহুদি আমেরিকানদের মধ্যে বাইডেনের অবস্থান কতটা নড়বড়ে হয়েছে তার ওপরে। বিশেষ করে পেনসিলভেনিয়া, মিশিগান, জর্জিয়া, উইসকনসিন ও অ্যারিজোনার মতো গুরুত্বপূর্ণ (ব্যাটেলগ্রাউন্ড) রাজ্যগুলোয় ফল নির্ধারণে নিয়ামক হয়ে ওঠার মতো যথেষ্ট ভোটার রয়েছেন ইহুদি আমেরিকানদের মধ্যে।
বাইডেনের নির্বাচনী শিবির থেকে নিয়মিত অনলাইনে জুম কলের মাধ্যমে ‘জুইশ ওমেন ফর জো’ (জোর জন্য ইহুদি নারীরা) নামে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হচ্ছে। শিগগিরই তাঁরা একজন ‘ফেইথ এনগেজমেন্ট ডিরেক্টর’ নিয়োগ দেবেন, যার অনেক ইহুদি ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। যদিও বেশ কয়েকজন ইহুদি নেতা ব্যক্তিগতভাবে সিএনএনের কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, তাঁরা তেমন যোগাযোগ দেখতে পাচ্ছেন না।
জুইশ ডেমোক্রেটিক কাউন্সিল অব আমেরিকার (জেডিসিএ) একাধিক নেতা ও ডেমোক্রেটিক ভোটাররা সিএনএনকে তাঁদের হতাশার কথা জানিয়ে বলেছেন, প্রগতিশীল মিত্ররা তাঁদের পরিত্যাগ করছেন। সে কারণে তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিকভাবে ‘গৃহহীন’ মনে হচ্ছে। কারণ, তাঁদের মনে হচ্ছে, বাইডেন যথেষ্ট করছেন না এবং তিনি তাঁর দলের বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।
সিএনএন মিশিগানের কয়েকজন ইহুদি ভোটারের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁদের একজন মিশিগান জুইশ ডেমোক্র্যাটসের ওয়েস্ট মিশিগান প্রধান ট্রয় জুকোস্কি। তিনি বলেন, ‘আমাকে বেশ কয়েকজন সরাসরি বলেছেন, কেন কোনো ইহুদি একজন ডেমোক্র্যাটকে ভোট দেবেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘যাঁরা ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারেন, সেসব ইহুদিকে নিয়ে আমি চিন্তিত নই; বরং আমি ওই সব ইহুদিকে নিয়ে বেশি চিন্তিত, যাঁরা হয়তো ভোট নষ্ট করতে তৃতীয় কোনো প্রার্থীকে ভোট দেবেন বা ভোটই দেবেন না।’
রোজ গার্ডেনে ‘জুইশ আমেরিকান হেরিটেজ মান্থ’ উদ্যাপন সামনে রেখে গত মাসের শেষ দিকে হোয়াইট হাউসে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন হয়েছিল। সেখানেই ইহুদি ভোটারদের নিয়ে বাইডেন শিবিরের উদ্বেগ বোঝা যায়। ওই সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলেজান্দ্রো মায়োরকাস ও অভ্যন্তরীণ নীতিবিষয়ক উপদেষ্টা নীরা ট্যান্ডেন দেশে বাড়তে থাকা ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলেন। এ ছাড়া সেখানে জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপ-উপদেষ্টা জন ফিনের ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কারবি ইসরায়েলের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন।
সেখানে একজন জন কারবিকে প্রশ্ন করেন, কেন কলেজে এনএসসির একজন কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি কি ফিলিস্তিনিদের ন্যায়বিচারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের করা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন? জবাবে কারবি বলেন, এনএসসির ওই কর্মকর্তা সেখানে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের দীর্ঘ সমর্থন
সপ্তাহ কয়েক আগে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের স্বামী ডগলাস এমহফ নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের জন্য ইহুদিকেন্দ্রিক একটি প্রচারে নেতৃত্ব দেন। ম্যানহাটানের শহরতলি লোয়ার ইস্ট সাইডের মাছের দোকান রাস অ্যান্ড ডটার্সের কাছে দাঁড়িয়ে তিনি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কী তাঁকে আশা দিচ্ছে?
এর আগের রাতেই একদল বিক্ষোভকারী লোয়ার ম্যানহাটানের স্মৃতিসৌধে কোফিয়েহ (ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে ওঠা কাপড়) মোড়ানো ‘৭ অক্টোবর দীর্ঘজীবী হোক’ লেখা ব্যানার ওড়ান। গত বছরের এই ৭ অক্টোবরে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ঢুকে নোভা সংগীত উৎসবে অংশ নেওয়া অনেক মানুষকে হত্যা করেন।
এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর ব্রুকলিনে একটি জাদুঘরের একজনের পরিচালকের (যিনি ইহুদি) বাড়িতে লাল রং ছিটানো হয় এবং তাঁর নাম উল্লেখ করে ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ইহুদি’ সাইন দেওয়া হয়।
ব্যক্তিগত নানা আলোচনায়ও ইসরায়েলের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাইডেনের কী করা উচিত বা বলা উচিত, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা গেছে। এ পরিস্থিতি তাঁর পুনর্নির্বাচনের প্রচারণাকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তা নিয়ে হামাসের হামলার পরদিন থেকেই হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইং ও তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
বাইডেন দিনের পর দিন ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছেন। ইহুদি নন এমন মানুষের মধ্যে অল্প কয়েকজনই হয়তো তাঁর মতো করে পুরো কর্মজীবনে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে এত সময় ব্যয় করেছেন। বাইডেন প্রায়ই ইসরায়েলের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি তুলে ধরতেন।
বাইডেন আরও একটি কথা প্রায়ই বলেন। ২০১৭ সালে ভার্জিনিয়ার শার্লটভিলে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের এক কর্মসূচি থেকে স্লোগান দেওয়া হয় ‘ইহুদিরা আমাদের জায়গা নিতে পারবে না’। হিটলারের সময় জার্মানিতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে এ স্লোগান দেওয়া হতো। এর প্রতিক্রিয়ায় তখন ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘উভয় পক্ষেই খুব ভালো মানুষেরা রয়েছেন।’ তাঁর এ বক্তব্য নিয়ে ক্ষোভ থেকেই ২০২০ সালে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার সিদ্ধান্ত নেন বলে উল্লেখ করেন বাইডেন।
এখন কীভাবে গাজা যুদ্ধের অবসান হবে, তা নিয়েও বাইডেনের ওপর চাপ বাড়ছে। যদিও বাইডেন এরই মধ্যে বলেছেন, এখন এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন কলেজ ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরেও নানা প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ইহুদিদের বিরোধিতা করা এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইডেনকে এখন এসবের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হচ্ছে। যেমন জুনের প্রথম সপ্তাহান্তে কয়েকজন বিক্ষোভকারী হোয়াইট হাউসের বাইরে ‘একজন ইহুদিবাদীকে হত্যা করুন’ বলে স্লোগান দিয়েছেন।
বাইডেন ও তাঁর মুখপাত্ররা প্রায়ই ‘ভয়ংকর’ ও ‘অসুস্থতার’ মতো শব্দ ব্যবহার করে এ ধরনের অনেক ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে নিয়মিত এ ধরনের শব্দের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। যেমনটা খুব কম রাজনীতিকই করছেন।
ট্রাম্প সমর্থকেরা ইহুদি ভোটারদের সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা দেখতে পাচ্ছেন
যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিবিদ্বেষ বাড়ার কারণে ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের দীর্ঘদিনের সমর্থন এবং তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে যেখানে উদ্বেগ বাড়ছে, সেখানে ট্রাম্প ইহুদি আমেরিকানদের প্রতি তাঁর অতীত বিরোধপূর্ণ মনোভাব ও মাঝেমধ্যেই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার অবস্থান থেকে সরে আসার চেষ্টা করছেন বলেই মনে হচ্ছে।
গত ১৮ জুন ওয়াশিংটনে আমেরিকান ইহুদিদের এক সম্মেলনে শত শত ইহুদি যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে মঞ্চে জুইশ ডেমোক্রেটিক কাউন্সিল অব আমেরিকানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হেইলি সোফিয়ের সঙ্গে বিতর্কের সময় মরগান ওরটাগাস ইহুদিদের উদ্দেশে বলেন, ‘যদি আপনি সুন্দর সুন্দর টুইট দেখতে চান, বাইডেনকে ভোট দিন। যদি আপনি আর মৃত ইসরায়েলিদের দেখতে না চান, তাহলে ট্রাম্পকে ভোট দিন।’ ওরটাগাস ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০২০ সালের নির্বাচনের সময় এপির বুথফেরত জরিপে বলা হয়েছিল, ট্রাম্প ৩০ শতাংশ ইহুদি ভোটারের সমর্থন পেয়েছেন; যা ছিল গত কয়েক দশকের মধ্যে কোনো রিপাবলিকান প্রার্থীর জন্য ইহুদিদের সর্বোচ্চ সমর্থন।
ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকার সময় ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তারপরও খুব বেশি ইহুদি ভোটারের সমর্থন না পেয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন; যা নিয়ে ট্রাম্প অনেকবার কথাও বলেছেন। যেমন গত এপ্রিলে ট্রাম্প বলেছিলেন, কোনো ইহুদির বাইডেনকে ভোট দেওয়ার অর্থ তিনি ইসরায়েলকে ভালোবাসেন না এবং এটা নিয়ে সরাসরি কথা বলা উচিত।
ট্রাম্পের আমলেই আব্রাহাম চুক্তি হয়েছে। যে চুক্তির অধীন বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথ তৈরি হয়। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফেরাতে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বলে বিবেচনা করা হয়। তবে ৭ অক্টোবরের হামলার পর কয়েক দিনের মধ্যে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ হামাসকে আটকাতে ব্যর্থ হওয়ায় কারণে যথাযথভাবে নেতানিয়াহুর সমালোচনা করা উচিত।
ট্রাম্প ইহুদিবিদ্বেষমূলক কোনো ঘটনার সমালোচনাও করেননি এবং তিনি মাঝেমধ্যেই হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের সঙ্গে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ক্যাপিটল দাঙ্গায় জড়িত থাকার কারণে কারাদণ্ড পাওয়া ব্যক্তিদের তুলনা করেন।
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ, ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি ও ক্যাম্পাসগুলোয় ইহুদি শিক্ষার্থীদের হেনস্তা হওয়ার ঘটনা বাইডেনের জন্য রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করেছে বলে মনে করেন সাবেক রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান লি জেলডিন। যিনি নিজে একজন ইহুদি।
লি জেলডিন বলেন, এ মুহূর্তে ডেমোক্রেটিক পার্টি এমন একটি মুহূর্তে রয়েছে, যেখানে তাদের এসব শক্তির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে বরং সেগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হবে। তা না হলে (ফিলিস্তিনি আমেরিকান ক্যাংগ্রেসওমেন) রাশিদা তালাইব ও মিশিগানে ‘বাইডেনকে পরিত্যাগ করুন’ স্লোগান তোলা ভোটারদের নানা ধরনের অরুচিকর কর্মকাণ্ডের ফলে ডেট্রোয়েট শহরতলিতে বসবাস করা ইহুদি ভোটাররা নিজেদের আরও বিচ্ছিন্ন ভাবার ঝুঁকি তৈরি হবে।
যেসব রাজ্যে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় জয়-পরাজয়ের ব্যবধানের চেয়ে ইহুদি ভোটারের সংখ্যা বেশি আছে, সেসব এলাকায় ট্রাম্প এবং অন্যান্য রিপাবলিকান প্রার্থীদের প্রতি সমর্থন বাড়াতে অন্তত ১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছে রিপাবলিকান জুইশ কোয়ালিশন। জেলডিন নিজে এই বোর্ডের একজন সদস্য।
এ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত একজন জানান, তাঁদের মূল বক্তব্য হবে ‘একজন ইহুদি আমেরিকান হিসেবে চার বছর আগে আপনি যতটা নিরাপদ বোধ করতেন, এখন কী তার থেকে বেশি নিরাপদ বোধ করছেন?’