যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিভাজনের প্রভাব পরিবারগুলোতেও

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি: এএফপি

থ্যাংকস গিভিং ডে উদ্‌যাপনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বাসিন্দা ইরিনার বাড়িতে নানা আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু খাবার টেবিলে একটি আসন ফাঁকা। স্বামীসহ ইরিনা তাঁর স্বামীর ভাইকে এ আয়োজনে আমন্ত্রণ না জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, ওই ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভক্ত। গত ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।

ইরিনা বলেন, ‘খাবার টেবিলে সে ট্রাম্পের বিজয়ের মহিমাকীর্তন করবে, এটা আমি মেনে নিতে পারব না। আমার স্বামী এতে বাধা দিলে দুজনের বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হবে, যেটা আমরা এড়াতে চেয়েছি।’

যুক্তরাষ্ট্রে বড়দিনের পর সবচেয়ে বড় উৎসব বলা হয় থ্যাংকস গিভিং ডেকে। দিনটি ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রবাসীর থাকে অনেক পরিকল্পনা। থাকে সরকারি ছুটি। দিনটিতে দেশজুড়ে থাকে নানা আয়োজন। ধর্মীয় হলেও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার বাইরে দিনটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। এ বছর দিনটি ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তিন সপ্তাহ পরে, গত ২৮ নভেম্বর।

থ্যাংকস গিভিং ডের পর এসেছে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন। বড়দিন সামনে রেখে কোটি কোটি আমেরিকান দিনটি উদ্‌যাপনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রাজনীতিতে মেরুকরণ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিভাজিত প্রচারণার একটি বছরের শেষ প্রান্তে হচ্ছে এই উৎসব। এবার রাজনৈতিক মতানৈক্যের মধ্যেও পরিবারগুলো কীভাবে এই উৎসবে এক হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে স্পষ্টতই দুটি পক্ষ দেখা গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ৭ কোটি ৭৩ লাখ ভোট বা মোট ভোটের ৪৯ দশমিক ৯ শতাংশ। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ৭ কোটি ৫০ লাখ বা ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট। গত বছর পিউ রিচার্সের করা এক জরিপ অনুযায়ী, ভিন্নমতের লোকের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা করাকে ক্লান্তিকর ও হতাশাজনক মনে করেন ৬১ শতাংশ আমেরিকান।

ইরিনা ও তাঁর স্বামী এবার থ্যাংকস গিভিং ডের আয়োজন করেছিলেন স্বল্প পরিসরে। সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল শুধু ইরিনার মা ও তাঁদের দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। সেই আয়োজনে আলাপচারিতায় তেমন তিক্ততা তৈরি হয়নি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পরিবার জানিয়েছে, এ ধরনের পারিবারিক আয়োজনে তারা ‘রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা করা হবে না’ এমন নীতি নিয়েছে।

পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী অ্যান একজন হিসাবরক্ষক। অ্যান জানালেন, উৎসব উপলক্ষে কোনো আয়োজনে যদি রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, তাহলে তাঁর পরিবার ওই আয়োজন থেকে চলে আসবে বলে পরিবারের অন্য সদস্যদের জানিয়ে দিয়েছেন। কেননা, অ্যান ও তাঁর কাছের স্বজনেরা ডেমোক্র্যাট। তবে অন্যদের মধ্যে ট্রাম্প, অর্থাৎ রিপাবলিকানদের সমর্থক রয়েছেন।

অ্যান আরও জানালেন, তাঁদের পারিবারিক আয়োজনে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হতো না। ২০১৬ সাল থেকে পারিবারিকভাবে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, কোনো আয়োজনে রাজনৈতিক কথা–বার্তা হবে না। তবে এবার থ্যাংকস গিভিং ডেতে এর ব্যত্যয় ঘটেছে। এবার থ্যাংকস গিভিং ডে উপলক্ষে পারিবারিক আয়োজনে রাজনীতি ও ট্রাম্পকে নিয়ে আলোচনা শুরু হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বলে জানান অ্যান।

অ্যান বলেন, ‘আলোচনায় আমার ক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারে আমার বোন। এটা দেখে সে অন্যদের আলোচনার বিষয় বদলাতে বলে। সবাইকে বলে, রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে আলোচনা না করি।’

যুক্তরাষ্ট্রে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যক্তিদের একটা অংশ একে অপরকে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের নাগরিক নয়; বরং শত্রু মনে করেন। গত অক্টোবরে বিষয়টি নিয়ে একটি জরিপ করে নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজ। তাতে দেখা যায়, ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের ২০ শতাংশ ট্রাম্পের সমর্থকদের শত্রু মনে করেন। অপর দিকে রিপাবলিকান সমর্থকদের ১৬ শতাংশ কমলা হ্যারিসের সমর্থকদের শত্রু ভাবেন।

ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা ২২ বছরের তরুণ হেক্টর ট্রাম্পকে সমর্থন করেন। রাজনীতি নিয়ে তাঁর পরিবার দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশ উদারপন্থীদের সমর্থকদের। অন্যদের সমর্থন রক্ষণশীলদের ওপর।

হেক্টর জানান, সম্প্রতি তাঁদের বাড়িতে কিছু আত্মীয় আসেন। ‘ট্রাম্পের বিজয় বিশ্বের বিপর্যয় ডেকে এনেছে’ বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। গত জুলাইয়ে এক নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টায় গুলি করা হয়। কিন্তু গুলি তাঁর কানের খুব কাছ দিয়ে চলে যায়। এ নিয়ে পারিবারিক আয়োজনে আত্মীয়দের কারও কারও ‘গুলিটা ঠিক জায়গায় আঘাত করা উচিত ছিল’ মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হন বলে জানালেন হেক্টর।

ম্যাসাচুসেটসের ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা চেটের মতে, পরিবারসহ কাছের মানুষজনের সঙ্গে কোনো একটি বিষয়ে একমত হওয়া দিনের পর দিন কঠিন হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, ‘এখন আমরা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলি।’ এতে ভাইয়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে জানালেন তিনি। চেট বলেন, ‘তাঁদের মতাদর্শিক অবস্থানের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো কঠিন হয়ে উঠছে। কিন্তু আমি তাদের ভালোবাসি।’

রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে পরিবারগুলোতে বিভাজনের আরেকটি উদাহরণ দেন হেলেন। তিনি বলেন, তাঁর জন্ম রিপাবলিকান সমর্থক একটি পরিবারে। কিন্তু একবার রাজনীতি নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার কারণে তাঁর এক চাচা অনেক বছর ধরে বড়দিন পরিবারের সঙ্গে করেন না। এ ঘটনার পর থেকে তাঁর চাচি পারিবারিক আয়োজনে রাজনীতি অথবা ধর্ম নিয়ে কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।

রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে অনেক পরিবারে দূরত্ব তৈরির বিষয়টি উঠে এল কারও কারও কথায়। তাঁদের একজন ওহাইও অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা রিটা (৬৬)। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে প্রথমবার ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার আগে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অনেক বেশি সৌহার্দ্যপূর্ণ। কিন্তু ওই নির্বাচনের প্রচারের পর থেকে তাঁদের পরিবারের মধ্যে ফাটল ধরতে শুরু করে বলে জানান তিনি।

রিটা বলেন, ‘আমরা তখন পরিবারের সদস্যরা মিলে ছুটিতে এক হতে পারতাম। রাজনীতি বা কোনো কিছু নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তা কঠিন হয়ে উঠতে থাকে। এরপর ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের হেরে যাওয়া ও তাঁর উসকানিতে ট্রাম্প সমর্থকেরা ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলা চালানোর পর পরিবারের এক হওয়াটা একেবারে অসম্ভব হয়ে ওঠে।’

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ফাটল ধরেছে জানিয়ে রিটা বলেন, ‘এখন আমাদের মধ্যে মারাত্মক বিভাজন তৈরি হয়েছে। আমাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন না। মতপার্থক্য বেড়ে পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে যাঁরা পারিবারিক আয়োজনে রাজনীতি ছাড়া কথা বলতে পারেন না, তাঁদের সঙ্গে কথা বলাকে সময়ের অপচয় মনে করা হয়।’