ডারা জাকার যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের কেনোশা শহরের কার্থেজ কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী। ২৮ বছর বয়সী এই তরুণী বলছিলেন, তাঁর জীবন আটকে গেছে। পড়াশোনার খরচ চালাতে তিনি ঋণ নিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি করেন। এর পর থেকে মাসে মাসে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে চলেছেন। কিন্তু ঋণ শোধ হওয়ার নাম নেই; তা শুধু বেড়েই চলেছে।
‘আমার মনে হয়, জীবনটা বাঁধা পড়ে গেছে’—জাকার বলছিলেন আল–জাজিরাকে। তিনি আরও বলেন, পড়াশোনার জন্য তিনি ৩৫ হাজার ডলার ঋণ নিয়েছিলেন। প্রতি মাসে কিছু কিছু করে শোধ করেও এখন তিনি ৩৯ হাজার ডলারের ঋণী।
‘দ্য এডুকেশন ডেটা ইনিশিয়েটিভ’ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চার বছর মেয়াদি কোর্স করার টিউশন ফি ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে।
এমন অবস্থা শুধু ডারা জাকারের নয়, যুক্তরাষ্ট্রে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা অনেক শিক্ষার্থীরই। সেন্ট লুইসের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শিক্ষার্থীদের ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ৭৫ ট্রিলিয়ন (১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি) ডলার; ২০০৬ সালে যা ছিল ৪৮১ বিলিয়ন (৪৮ হাজার ১০০ কোটি) ডলার। মার্কিন শিক্ষার্থীদের এ ঋণের পরিমাণ বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ।
যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের ঋণসংকট বাড়তে থাকায় ঋণগ্রহীতা, নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদেরা এ বিষয়ে একমত যে কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু ঠিক কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে।
কোভিড–১৯ মহামারির শুরুর দিকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ঋণের ওপর সুদ স্থগিত করে। পরে লকডাউনের কবলে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে ঋণ পরিশোধ স্থগিত করা হয়। এরপর প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য ‘১০ হাজার ডলার পর্যন্ত তাৎক্ষণিক ঋণ মওকুফের’ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কয়েক দফায় এর মেয়াদ বাড়ানো হয়।
যাহোক, ঋণ পরিশোধের ওপর স্থগিতাদেশ চলতি আগস্ট মাসে শেষ হচ্ছে। বাইডেন যদি মেয়াদ আর না বাড়ান, তবে ৪ কোটি ৫৪ লাখ (৪৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন) ঋণগ্রহীতা শিক্ষার্থীকে আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে মাসিক ভিত্তিতে ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে একজন শিক্ষার্থীকে মাসে গড়ে ৩৯৩ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪০ হাজার) শিক্ষাঋণ পরিশোধ করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে একজন শিক্ষার্থীকে মাসে গড়ে ৩৯৩ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪০ হাজার) শিক্ষাঋণ পরিশোধ করতে হয়।
জাকার বলেন, ঋণ পরিশোধ স্থগিতাদেশের ওই সুযোগ তিনি প্রতিবন্ধী মা–বাবার মুদিসামগ্রী কেনাকাটায় সহায়তা করার কাজে লাগিয়েছেন। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা উন্নয়ন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। সম্প্রতি তাঁর পদোন্নতি হয়েছে। এতে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। এখন ঋণ পরিশোধ আবার শুরু করার অর্থ, তাঁর বেতননির্ভর মাসিক ঋণ পরিশোধ দ্বিগুণ বেড়ে হবে ২২০ ডলার (প্রায় ২২ হাজার টাকা)।
এক সাক্ষাৎকারে জাকার বলেন, ‘আমি আমার চাকরি ও বেতনের জন্য কৃতজ্ঞ। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হলো, এখন আমি ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হলেও একজন সামর্থ্যবান হিসেবে আমি একটা ঘর কিনতে বা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারব না।’
বৃহৎ পরিসরে চিত্র
গবেষণা গ্রুপ ‘দ্য এডুকেশন ডেটা ইনিশিয়েটিভ’ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চার বছর মেয়াদি কোর্স করার টিউশন ফি ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। যদিও অনেক দেশ যেমন: জার্মানি, আইসল্যান্ড ও সুইডেনে টিউশন ফি হয় নির্ধারিত, না হয় সম্পূর্ণ ফ্রি। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চার বছরের কোর্স করতে বছরে একজন শিক্ষার্থীর খরচ হয় গড়ে ৩৫ হাজার ৫৫১ ডলার। খরচের খাতের মধ্যে আছে টিউশন, বিবিধ ফি, আবাসিক হল ফি, বই, অন্যান্য খরচ—বলছে ন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস।
যুক্তরাষ্ট্রে একজন শিক্ষার্থী যে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আবেদন করে, সে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার কতটুকু উপযুক্ত, সেটি নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ তাঁর পড়াশোনার ব্যয় বহনের ব্যক্তিগত সক্ষমতা, পরিবারের সামর্থ্য ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে থাকে। পরে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী ফেডারেল অনুদান, ভর্তুকিতে ঋণ, কাজের সুযোগ পাওয়ার যোগ্য হতে পারেন। এরপরই পড়াশোনার অবশিষ্ট খরচ মেটাতে ঋণের আবেদন করতে পারেন শিক্ষার্থী।
এ নিয়ে আল–জাজিরার সঙ্গে আলাপচারিতায় অনেক অর্থনীতিবিদই একমত যে শিক্ষাঋণ ও স্নাতক শেষ করার পর সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের বিভিন্ন ধরন আসলে কেমন হবে—সে সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানাতে বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে জাকারের। তিনি শিক্ষাঋণের কিস্তি পরিশোধের যে ধরন বেছে নিয়েছেন, সেটি ঋণগ্রহীতার আয়কেন্দ্রিক। এ ধরনের কিস্তি নির্ধারণ করা হয় ঋণগ্রহীতার বেতনের ওপর ভিত্তি করে। তবে এতে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বেড়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাড়ে সুদের পরিমাণ।
নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘মুডিস’–এর অর্থনীতিবিদ ক্রিশ্চিয়ান ডেরিটিসের ভাষায়, ‘আমার মনে হয় তরুণ–তরুণীরা আসলেই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। তাঁদের অনেকেরই ঋণের বোঝা আসলে কেমন ও স্নাতক শেষে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে ছয় অঙ্কের বেতনের স্বপ্ন কতটা বাস্তবসম্মত, সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নেই।’
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীরা মনে করেন, প্রথম চাকরিতে তাঁরা বছরে মোটামুটি ১ লাখ ৩ হাজার ৮৮০ ডলার বেতন পাবেন। তবে প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। দেখা গেছে, স্নাতক শেষে চাকরিতে ঢোকার পর বছরে একজন গড়ে ৫৫ হাজার ২৬০ ডলার বেতন পেয়ে থাকেন।
নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের হিসাব বলছে, পকেটে টান পড়লে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের নির্ভরশীলতা দিন দিন বাড়ছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে দেশটিতে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের লেনদেন হয়েছে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে করোনার সময় জমানো অর্থে হাত দিয়েছে মানুষ।
এমন পরিস্থিতিতে খুব শিগগির ঋণখেলাপি বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ক্রিশ্চিয়ান ডেরিটিস। তাঁর ভাষ্যমতে, সরকার যখন শিক্ষাঋণ পরিশোধ স্থগিত করল, তখনই অনেক ঋণগ্রহীতা সমস্যার মধ্যে ছিলেন। ভবিষ্যতে তাঁদের ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
‘এই ঋণ উধাও হবে না’
জাকারের বিশ্বাস ছিল, বাইডেন তাঁর শিক্ষাঋণের আংশিক মওকুফ করবেন। এ কারণে তিনি বাইডেনকে সমর্থন করতেন। আল–জাজিরাকে জাকার বলেন, তিনি চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেন তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নিয়ে আরও কিছু করেন।
এই তরুণী শিক্ষার্থীর দাবি, বাইডেনকে সব শিক্ষাঋণের ওপর সুদও মওকুফ করতে হবে। আর এত দিন তিনিসহ অন্যান্য শিক্ষার্থী ঋণের ওপর যে পরিমাণ সুদ দিয়েছেন, তা হিসাব করে মূল ঋণ থেকে বাদ দিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মেজরওয়ান–এর দেওয়া তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিক্ষাঋণের ৯০ শতাংশ দিচ্ছে ফেডারেল সরকার। এর অর্থ, শিক্ষাঋণের মূল দাতা হলো সরকার। যেহেতু সরকারি কোষাগার থেকে এই অর্থ যাচ্ছে, তাই বলা যায় এই ঋণ আসলে দিচ্ছেন মার্কিন করদাতারা। ফলে যখন ঋণ খেলাপ হয় অথবা মওকুফ করা হয়, তখন তার বোঝা নিতে হয় করদাতাদেরই।
শিক্ষার্থীদের ঋণ মওকুফের এই সিদ্ধান্তে ভুল রয়েছে বলে মনে করেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সেন্টার ফর এডুকেশন পলিসির পরিচালক লিন্ডসে এম বার্ক। তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারি সবাইকে ভুগিয়েছে। মহামারির সময় স্নাতকধারীদের বেকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম ছিল, বড়জোর তাঁদের বাসা থেকে কাজ (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) করতে হয়েছে। তাই যাঁরা আরও বড় ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন, তাঁদের এড়িয়ে শিক্ষার্থীদের ঋণ মওকুফের পরিকল্পনা একেবারেই রাজনৈতিক।’
লিন্ডসে এম বার্ক বলেন, শিক্ষার্থীদের ঋণ মওকুফ করা হলে তা উধাও হয়ে যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের কাছে এ ঋণ মওকুফের অর্থ, তাঁদের আরও বেশি কর দিতে হবে অথবা মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এখন মওকুফের আশায় শিক্ষার্থীরা আরও বেশি ঋণ নেবেন ও ব্যয়বহুল কলেজগুলোতে ভর্তি হবে চাইবেন।
অর্থনীতিবিদ ক্রিশ্চিয়ান ডেরিটিস মনে করেন, শিক্ষার্থীরা কীভাবে ঋণ পাবেন, তা নিয়ে অনেক কিছুই করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘আপনি বলতে পারেন, মার্কিন সরকার শিক্ষার্থীদের ঋণের ওপর বিধিনিষেধ দিতে পারে ও নির্দিষ্ট একটি পরিমাণের বেশি ঋণ না দিতে পারে। যেমন সর্বোচ্চ ৩০ হাজার ডলার পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যাবে বা কম ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হবে কিংবা পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করতে হবে।’
মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী জাকার বলেন, ‘একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে আমার বেশি সময় লাগেনি যে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাঋণ অন্য সব ঋণের মতো নয়। আমি মনে করি, লোকজন এটি এড়িয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে ঋণের চাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে; কিন্তু শিক্ষাঋণ কাউকে ছাড়ে না।