ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত বৃহস্পতিবার রাতে এসব হামলা চালানো হয়েছে।
মার্কিন বিমানবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, ইরান-সমর্থিত হুতিদের ১৬টি অবস্থানের ৬০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়েছে। এসব লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে রয়েছে তাদের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র, যুদ্ধাস্ত্রের ডিপো, উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা, (অস্ত্র) উত্পাদন কারখানা ও বিমান প্রতিরক্ষা রাডার সিস্টেম।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যৌথভাবে চালানো এ হামলার অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা লোহিত সাগরে চলা জাহাজে হুতিদের হামলা ‘সহ্য করবে না’। মার্কিন এ অভিযানে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন ও নেদারল্যান্ডসের সমর্থন রয়েছে। ইসরায়েলের বন্দরগামী বা ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট জাহাজ লক্ষ্য করে হুতিদের চালানো হামলার প্রতিক্রিয়ায় এটাই পশ্চিমাদের প্রথম বড় সামরিক পদক্ষেপ।
হুতিদের হামলা বৈশ্বিক শিপিং ব্যবস্থার জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে। এর জেরে এরই মধ্যে মায়ের্স্কের মতো বৃহৎ কোম্পানি লোহিত সাগরে তাদের জাহাজ চলাচল স্থগিত করেছে।
তবে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান—উভয় দলের বেশ কয়েক আইনপ্রণেতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এ পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, বাইডেন মার্কিন সংবিধানের ১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছেন।
মার্কিন সংবিধানের ১ অনুচ্ছেদে আসলে কী বলা আছে এবং আসলেই কি বাইডেন তা লঙ্ঘন করেছেন?
মার্কিন সংবিধানের ১ অনুচ্ছেদে কী বলা আছে
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যেকোনো যুদ্ধের জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন নিতে হবে। তবে ইয়েমেনে চালানো হামলার ক্ষেত্রে বাইডেন কংগ্রেসকে জানিয়েছেন, তবে তিনি কোনো অনুমোদন চাননি। অনুচ্ছেদটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুদ্ধে জড়ানোর ক্ষমতার পরিমাপ ও নিয়ন্ত্র্রণের উপায় হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিবেচিত হয়ে আসছে।
অনুচ্ছেদ ১-এর ধারা ৮ কংগ্রেসকে যুদ্ধ ঘোষণা করার ক্ষমতা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধ ঘোষণা করার ক্ষমতা থাকবে কংগ্রেসের...।’
অনুচ্ছেদটির সুনির্দিষ্ট একটি অংশে সামরিক পদক্ষেপের জন্য সুস্পষ্টভাবে কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে। সেটি এর ১০-এর তৃতীয় ধারা।
কী বলছেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা
ডেমোক্রেটিক পার্টির আইনপ্রণেতা প্রমিলা জয়াপাল এ হামলাকে ‘সংবিধানের লঙ্ঘন’ উল্লেখ করেছেন। তাঁরা মতে, এটা ‘অগ্রহণযোগ্য’। গত শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে প্রমিলা এ কথা বলেছেন।
একই কথার প্রতিধ্বনি করেছেন আরেক ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা কোরি বুশ। তিনি লিখেছেন, ‘জনগণ চায় না যে আমাদের আরও করের টাকা অন্তহীন যুদ্ধের পেছনে ব্যয় হোক এবং বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি হোক। বোমাবাজি বন্ধ করুন এবং আমাদের জন্য ভালো কিছু করুন।’
সংবিধানের ১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের প্রশ্নে অন্য প্রগতিশীল আইনপ্রেণেতারাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইয়েমেনে চালানো সামরিক অভিযানের নিন্দা করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রশিদা তালিব, মার্ক পোক্যান ও রো খান্না।
যাহোক, কেবল ডেমোক্র্যাটরাই বাইডেনের সাম্প্রতিক এ হামলার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। রিপাবলিকান মাইক লি ডেমোক্র্যাট রো খান্নার এক্স পোস্ট শেয়ার করে লিখেছেন, ‘সংবিধানের বিষয়, দলমত–নির্বিশেষে সবার।’
রিপাবলিকান টেক্সাসের কংগ্রেসম্যান চিপ রয় লিখেছেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ শিপিং চ্যানেল রক্ষায় ও আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় ইয়েমেনে চালানো হামলার ক্ষেত্রে আমার দ্বিমত নেই।’ কিন্তু কংগ্রেসের অনুমোদন না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তাঁর সোজাসুজি জিজ্ঞাসা, ‘কোন কর্তৃপক্ষের অধীন এটি করা হয়েছিল?’
তবে মিচ ম্যাককনেল, জনি আর্নস্ট, রজার উইকার, রিক স্কট, লিন্ডসে গ্রাহামসহ আরও কিছু রিপাবলিকান নেতা বাইডেনের সিদ্ধান্তের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, এ হামলা ‘প্রাপ্য’ ছিল।
হামলার পক্ষে যাঁরা, তাঁরা কী বলছেন
ইয়েমেনে চালানো এ হামলার পক্ষে যৌথভাবে বিবৃতি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। দেশগুলোর দেওয়া ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘স্বতন্ত্র ও সম্মিলিতভাবে থাকা আত্মরক্ষার অধিকারের ভিত্তিতে এ হামলা চালানো হয়েছে। এই পদক্ষেপ জাতিসংঘ সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’
হামলার ন্যায্যতা তুলে ধরতে বাইডেন প্রশাসন ও এর সহযোগীরা যুদ্ধের ক্ষমতা আইনের (ওয়ার পাওয়ার অ্যাক্ট) আরেকটি ধারা সম্ভবত উদ্ধৃত করতে যাচ্ছে।
যুদ্ধের ক্ষমতা আইন কী
১৯৭৩ সালের নভেম্বরে মার্কিন কংগ্রেসে ‘দ্য ওয়ার পাওয়ারস রেজল্যুশন’ পাস হয়। এটিই ‘যুদ্ধের ক্ষমতা আইন’ নামে পরিচিত।
এ আইন অনুসারে সামরিক পদক্ষেপের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট তা কংগ্রেসকে জানাবেন এবং কংগ্রেস যদি আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা না করে বা সামরিক পদক্ষেপের অনুমোদন না দেয়, তাহলে ওই সামরিক পদক্ষেপ শুরুর ৬০ দিনের মধ্যে তার সমাপ্তি টানতে হবে।
বাইডেন এক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিলেন, তিনি যদি ২০২৪ সালে নির্বাচিত হন, তবে তিনি বড় কোনো যুদ্ধ শুরুর জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন চাইবেন। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, ‘কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই বিদেশে সীমিত মার্কিন সামরিক অভিযান পরিচালনা করার ক্ষমতা তিনি রাখেন, যখন তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।’ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বাইডেনের এ প্রতিক্রিয়ার ওপর নিউইয়র্ক টাইমস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল।
বাইডেনের এই অবস্থান ছিল ২০০৭ সালের সম্পূর্ণ বিপরীতে। ওই সময় মার্কিন দৈনিক বোস্টন গ্লোবের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘সংবিধানে পরিষ্কার বলা আছে: কোনো হামলা বা আসন্ন হামলার হুমকির প্রতিক্রিয়া ছাড়া শুধু কংগ্রেস যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের অনুমোদন দিতে পারে।’
মার্কিন প্রেসিডেন্টরা কি সব সময় হামলার জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন চেয়েছেন
না। এমনটা অনেকবারই ঘটেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টরা কংগ্রেসের অনুমোদন না নিয়েই সামরিক হামলা চালিয়েছেন।
গত ডিসেম্বরে ইরাকের তিনটি স্থানে হামলা চালায় মার্কিন সামরিক বাহিনী। এ হামলার লক্ষ্য ছিল ইরান-সমর্থিত প্রধান সশস্ত্র গোষ্ঠী কাতাইব হিজবুল্লাহ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নামহীন গোষ্ঠী। বাইডেন এ হামলার আগে কংগ্রেসের অনুমোদন চাননি।
এর আগে কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ায় বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন বাইডেন, যা নিয়ে ওই সময় আইনপ্রণেতারা সমালোচনা করেছিলেন।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই ইরানের সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ আদেশের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ডেমোক্র্যাটরা।
২০১১ সালের মার্চে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়াই লিবিয়ায় বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওবামা এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, লিবিয়ায় ওই লড়াই কোনো ‘শত্রুতা’ থেকে নয়, যাতে কংগ্রেসের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন আছে।
আরেক সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও একই পথে হেঁটেছিলেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন ১৯৯৯ সালে তিনি কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়াই কসোভোয় সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর বোমা হামলাকে জোরদার করেছিলেন।