নতুন করে মধ্যপ্রাচ্য সফরে আছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। গত বছরের ৭ অক্টোবরের পর আট মাসে অঞ্চলটিতে এটি তাঁর অষ্টম কূটনৈতিক সফর।
ব্লিঙ্কেন এমন এক সময়ে মধ্যপ্রাচ্য সফর করছেন, যখন ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে ‘অচলাবস্থা’ চলছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চাইছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া তাঁর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি ইসরায়েল কার্যকর করুক।
কিন্তু যুদ্ধবিরতির কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা নিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন তাঁর দুই মন্ত্রী। এমন পরিস্থিতে চাপে আছেন নেতানিয়াহু।
গাজা যুদ্ধের অবসান এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তির আলোচনা ইতিমধ্যে জটিল অবস্থায় রয়েছে।
নেতানিয়াহুর যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রিসভা থেকে বেনি গানৎসের পদত্যাগের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। গত রোববার তিনি রাজনৈতিক মিত্র গাদি আইসেনকৎকে সঙ্গে নিয়ে পদত্যাগ করেন। তাঁরা দুজনই অবসরপ্রাপ্ত সেনা জেনারেল। তাঁরা চিফস অব স্টাফ হিসেবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) নেতৃত্ব দিয়েছেন।
গানৎসের মাধ্যমে নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার সঙ্গে যোগাযোগে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত যুক্তরাষ্ট্র। এখন গানৎস বিরোধী দলে ফিরে গিয়ে আগাম নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন। জনমত জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো ইসরায়েলের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে এগিয়ে রাখছে।
তবে নেতানিয়াহু যত দিন জোট ধরে রাখতে পারবেন, তত দিন তিনি নিরাপদ। এখন দুই কট্টর জাতীয়বাদী নেতার সমর্থন ধরে রাখার ওপর নেতানিয়াহুকে নির্ভর করতে হচ্ছে। তাঁরা হলেন জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ।
তবে ইতামার ও বেজালেল হুমকি দিয়েছেন, হামাসকে নির্মূল না করে নেতানিয়াহু যদি কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হন, তবে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন মনে করেন, গাজা যুদ্ধের অবসান দরকার। ইতিমধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে তাঁর এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। বাইডেনের এই চাওয়া পূরণের চেষ্টা করাই এখন ব্লিঙ্কেনের কাজ।
ইতামার ও বেজালেল—দুজনই কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদী। তাঁরা চান, হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চলুক। তাঁরা মনে করেন, ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী সব এলাকার মতো গাজাও একটি ইহুদি ভূখণ্ড। আর এটি ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। তাই ফিলিস্তিনিদের স্বেচ্ছায় গাজা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা উচিত।
আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছিল। কিন্তু এখন বাইডেন প্রশাসন যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য উন্মুখ।
গত ৩১ মে বাইডেন একটি নতুন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণের জন্য হামাসের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রস্তাবটি তিন ধাপের। এর আওতায় শুরুতে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি, গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানো ও ফিলিস্তিনি বন্দীদের বিনিময়ে কিছু ইসরায়েলি জিম্মির মুক্তির বিষয় আছে। গতকাল নিরাপত্তা পরিষদে এই প্রস্তাবই পাস হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়েছে ১৪টি। ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল রাশিয়া।
বাইডেন ও তাঁর উপদেষ্টারা জানেন, সামনে সংকট আছে।
হামাস জোর দিয়ে বলছে, গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারসহ যুদ্ধ অবসানের নিশ্চয়তার চুক্তিতেই কেবল তারা সম্মত হবে।
সম্প্রতি চার জিম্মিকে মুক্ত করতে গাজার নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে অভিযান চালায় ইসরায়েলে।
গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, এই অভিযানে ২৭৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর দাবি, নিহত মানুষের সংখ্যা এক শর কম।
অভিযানের পর বাইডেনের প্রস্তাবটি আরও দৃঢ়তা পেয়েছে। বাইডেন এটা স্বীকার করেছেন যে ইসরায়েলের কিছু ক্ষমতাশালী পক্ষ এ ব্যাপারে আপত্তি জানাতে পারে।
এক বক্তব্যে বাইডেন বলেন, যেকোনো ধরনের চাপ উপেক্ষা করে প্রস্তাব সমর্থনের জন্য তিনি ইসরায়েলের নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন।
ইতামার ও বেজালেল অবশ্য চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে দেরি করেননি। নেতানিয়াহু সরকারের এই দুই জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বাইডেনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। চুক্তিতে রাজি হলে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তাঁরা।
বাইডেন যে চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছেন, তা নিয়ে হামাস ও ইসরায়েল এখনো প্রকাশ্যে সম্মতি জানায়নি।
গাজায় হামাসের নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার এই প্রস্তাবের পক্ষে থাকার মতো কোনো ইঙ্গিত দেননি। গত ৭ অক্টোবর থেকে তিনি যে পথে হাঁটছেন, সে পথেই অবিচল আছেন বলে মনে হচ্ছে।
কিছু খবরে বলা হচ্ছে, নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরের ঘটনায় ইসরায়েলের পাশাপাশি হামাসের প্রতিও ফিলিস্তিনিরা ক্ষুব্ধ; যদিও বিবিসি বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, ইসরায়েলের চলমান হামলায় ৩৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে এত দিন ধরে চলা এই যুদ্ধে হামাসের স্থিতিস্থাপকতা দুর্বল হয়নি। তাদের কাছে সংগঠন ও নেতাদের টিকে থাকা বিজয়ের শামিল। যুদ্ধে এত মানুষের প্রাণহানি নিয়ে ইসরায়েল যে তীব্র সমালোচনার মধ্যে আছে, সেটাকে তারা সামনে টেনে আনবে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরে নেতানিয়াহু নানামুখী চাপে আছেন। তাঁর যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রিসভার দুই সদস্য পদত্যাগ করেছেন। তাঁরা চাইছিলেন, জিম্মিদের মুক্ত করতে যুদ্ধবিরতি হোক।
অন্যদিকে ইসরায়েল দুই কট্টরপন্থী নেতা (ইতামার ও বেজালেল) নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি না করার জন্য চাপ দিচ্ছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন এখন হয়তো নেতানিয়াহুকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে তিনি যেন ইতামার-বেজালেল আহ্বানে সাড়া না দেন। তিনি যেন যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে সম্মতি দেন। ব্লিঙ্কেন তাঁকে আরও বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করলে ইসরায়েলি জনগণও খুশি হবে। কারণ, তারা জিম্মিদের ফেরত পেতে চায়। তারা চায়, আর কোনো জিম্মির মৃত্যু না হোক।
যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ শুনলে নেতানিয়াহুর জোট সরকার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। নতুন নির্বাচনে তাঁর পরাজয় ঘটলে তাঁকে হয়তো তদন্ত কমিশনের মুখোমুখি হতে হবে। ৭ অক্টোবরের ঘটনায় তাঁর রাজনৈতিক, গোয়েন্দা ও সামরিক ব্যর্থতা আছে কি না, সে বিষয়ে তখন তাঁকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে।
আবার নেতানিয়াহু এ ক্ষেত্রে তাঁর দীর্ঘসূত্রতা ও প্রচারণার পুরোনো কৌশলকেও কাজে লাগাতে পারেন।
আগামী ২৪ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন নেতানিয়াহু। সেদিন হয়তো তিনি তাঁর নিজের জন্য ‘ভালো’ কিছু করার চেষ্টা করবেন।