যেসব ছাড় দিয়ে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারের আসনে ম্যাকার্থি
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এমন ঘটনা গত ১০০ বছরে ঘটেনি। বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার নির্বাচনে নাটকীয়তার কথা। যে নির্বাচন গত মঙ্গলবারেই শেষ হওয়ার কথা ছিল, তা গড়িয়েছে শনিবার পর্যন্ত। অবশেষে ১৫ দফা ভোটাভুটির পর স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী কেভিন ম্যাকার্থি। দেশটিতে সবশেষ এমন ঘটনা ঘটেছিল ১৯২৩ সালে।
প্রতিনিধি পরিষদে স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার জন্য দরকার কমপক্ষে ২১৮ ভোট। পরিষদে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সে হিসেবে ম্যাকার্থির সহজ জয় পাওয়ার কথা ছিল। তবে বাদ সাধেন পরিষদে তাঁর দলের ২০ জন সদস্য। শুরু থেকেই ম্যাকার্থিকে ভোট না দেওয়ার বিষয়ে একাট্টা ছিলেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত তাঁদের অনেকের মান ভাঙিয়ে নিজের পক্ষে টানতে পেরেছেন ম্যাকার্থি।
এই মান ভাঙানো অবশ্য একেবারেই সহজ ছিল না। এ জন্য ম্যাকার্থিকে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে, ছাড় দিতে হয়েছে অনেক বিষয়ে। এতে করে প্রতিনিধি পরিষদে ম্যাকার্থির ক্ষমতা কমেছে, প্রভাব বেড়েছে রক্ষণশীলদের। স্পিকারের চেয়ারে বসতে কোন কোন বিষয়ে তিনি ছাড় দিয়েছেন আর কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
স্পিকারের পদত্যাগের প্রস্তাব
স্পিকার নির্বাচনে বিরোধী রিপাবলিকান সদস্যদের নিজের পক্ষে টানতে তাঁদের বড় একটি দাবি মেনে নিতে হয়েছে ম্যাকার্থিকে। সেটি হলো, প্রতিনিধি পরিষদের যেকোনো সদস্য চাইলেই স্পিকারের পদত্যাগের জন্য ভোটাভুটির প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবেন। ফলে বিষয়টি এমন দাঁড়াচ্ছে, যেকোনো সময় এই ভোটাভুটি শুরু হয়ে যেতে পারে। আর কপাল খারাপ থাকলে হেরেও যেতে পারেন ম্যাকার্থি।
স্পিকারের পদত্যাগের জন্য একজন সদস্য ভোটের আহ্বান করতে পারবেন—এই আইন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে আগেও ছিল। স্পিকারের ক্ষমতা বাড়াতে গত কয়েক বছরে এই সংখ্যাটা বাড়িয়ে পাঁচজন করা হয়। প্রতিনিধি পরিষদের বিদ্রোহী রিপাবলিকান সদস্যরা অবশ্য বলেছেন, নতুন করে যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তার অপব্যবহার করবেন না তাঁরা।
কঠিন হচ্ছে বিলের অনুমোদন
প্রতিনিধি পরিষদে কোনো বিল অনুমোদনের একটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথমে পরিষদের একজন আইনপ্রণেতা কোনো বিল অনুমোদনে প্রস্তাব করেন। তারপর সেটি একটি কমিটির মাধ্যমে পর্যালোচনা করা হয়। কমিটির অনুমোদনের পর সেটি আরও সংশোধনের জন্য পরিষদের সব সদস্যের সামনে আনা হয়। সবশেষে সেটির অনুমোদনের জন্য ভোটাভুটির আয়োজন করা হয়।
তবে দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই নিয়মেও বদল এসেছে। আজকের দিনে বড় বড় বিলগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। তারপর সেগুলো অল্প সময়ে নোটিশে অনুমোদন দেওয়া হয়। ম্যাকার্থি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এখন থেকে বিলগুলো আগের প্রক্রিয়া মেনে অনুমোদন দেওয়া হবে। এতে করে বিল নিয়ে পরিষদের সব সদস্য নিজেদের অভিমত দিতে পারবেন।
এখন কথা হচ্ছে, ম্যাকার্থির এই প্রতিশ্রুতির ফল কী দাঁড়াবে। এমনিতেই প্রতিনিধি পরিষদের একটি বিলের অনুমোদন একটি জটিল প্রক্রিয়া। তারপর ম্যাকার্থির প্রতিশ্রুতির ফলে এখন পরিষদের ভিন্নমতের সদস্যরা চাইলেই বিল অনুমোদন রদ করতে পারবেন। বিল অনুমোদনে পুরোনো প্রক্রিয়া মেনে চলা হয়তো ভালো একটি পদক্ষেপ। তবে তা শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়ন করা ম্যাকার্থির জন্য হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে।
রক্ষণশীলদের দখলে যেতে পারে আইন প্রণয়ন
প্রতিনিধি পরিষদের বিভিন্ন বিধিবিধান ঠিক করে থাকে হাউস রুলস কমিটি। পরিষদে উত্থাপন করা বিলগুলো নিয়ে কখন ভোটাভুটি হবে, কতক্ষণ এটি নিয়ে বিতর্ক চলবে বা এসব বিলে কোনো পরিবর্তন আনা হবে কি না, তা ঠিক করা ক্ষমতাধর এই কমিটির কাজ। ম্যাকার্থির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, এই কমিটিতে অন্তত একটি পদ তিনি কট্টর রক্ষণশীলদের হাতে তুলে দেবেন।
পদ একটি হলেও এর গুরুত্ব কিন্তু ব্যাপক। এই পদের মাধ্যমে হাউস রুলস কমিটিতে রক্ষণশীলদের প্রতিনিধিত্ব ও সক্ষমতা আরও বাড়বে। এতে করে প্রতিনিধি পরিষদ থেকে অনুমোদন পাওয়া আইনগুলো কেমন হবে, সে বিষয়ে তারা ভূমিকা রাখতে পারবে।
সমর্থকদের দূরে ঠেলে দেবেন ম্যাকার্থি?
প্রতিনিধি পরিষদে প্রভাবশালী বিভিন্ন কমিটির পদের দিকে নজর রয়েছে স্পিকার নির্বাচনের প্রথম দিকে ম্যাকার্থির বিরোধিতা করা রিপাবলিকান সদস্যদের। বলা যায়, মেরিল্যান্ডের সদস্য অ্যান্ডি হ্যারিসের কথা। তিনি পরিষদের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এই উপকমিটির মাধ্যমে মার্কিন সরকারের শত শত কোটি ডলারের খরচ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
অ্যান্ডি হ্যারিস স্পিকার নির্বাচনের প্রথমে ম্যাকার্থির বিরোধিতা করলেও শুক্রবার এসে তাঁকে ভোট দিয়েছেন। অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই সমর্থনের বিনিময়ে ম্যাকার্থি হ্যারিসকে স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির প্রধান বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কি না। এ বিষয়ে এখনো জনসমক্ষে কিছু বলেননি ম্যাকার্থি। এমন কিছু হলে তা শিগগিরই জানা যাবে।
অ্যান্ডি হ্যারিস যদি ওই উপকমিটির প্রধান হন, তাহলে বিষয়টি ম্যাকার্থির জন্য নেতিবাচক হবে। কারণ, একে তো হ্যারিস একসময় ভোটে বিরোধিতা করেছিলেন, অপর দিকে ম্যাকার্থির সমর্থকদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে যাঁর এই পদ পাওয়ার কথা ছিল, তিনি বঞ্চিত হবেন। এতে করে ম্যাকার্থির কাছের মানুষদের মধ্যেই নতুন শত্রু তৈরি হতে পারে।
নির্বাচনে বিরোধী রিপাবলিকান সদস্যদের অগ্রাধিকার
স্পিকার নির্বাচনে যে ২০ জন রিপাবলিকান সদস্য প্রথম দিকে ম্যাকার্থির বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরা কংগ্রেস সদস্যদের মেয়াদের সীমাবদ্ধতা ও সীমান্তের নিরাপত্তা নিয়ে প্রায়ই কথা তুলেছেন। ম্যাকার্থি তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, চলতি বছরের শুরুতেই এই দুই বিষয়ে ভোটাভুটির আয়োজন করবেন।
প্রতিনিধি পরিষদে বিরোধী রিপাবলিকানরা চান আর না চান, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের বিষয়টি প্রতিনিধি পরিষদে তোলা হতো। কারণ, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ২০১৫ সালে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, তখন থেকেই এটি রিপাবলিকানদের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। একইভাবে সীমান্তের সুরক্ষার বিষয়টিও তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তবে কংগ্রেস সদস্যদের মেয়াদের সীমাবদ্ধতার বিষয়ে ম্যাকার্থি কিছু করতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সংশোধন আনার প্রয়োজন পড়তে পারে। আর মার্কিন সুপ্রিম কোর্টও এক আদেশে বলেছেন, কংগ্রেস সদস্যদের মেয়াদ সীমিত করে দেওয়ার যে রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা, তা অসাংবিধানিক।
খরচ কমানো
যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর রক্ষণশীল রাজনীতিকদের একটা অভিযোগ রয়েছে যে বিভিন্ন খাতে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাট সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ লাগামহীন পর্যায়ে চলে গেছে। প্রতিনিধি পরিষদে স্পিকার নির্বাচনের সময়ও ম্যাকার্থির বিরোধিতাকারী রিপাবলিকানরা একই কথা তুলেছিলেন। তাঁরা দাবি করেছিলেন ব্যয়ের পরিমাণ একটি সীমার মধ্যে আনার। এ বিষয়ে ম্যাকার্থি তাঁদের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তাঁরা সমঝোতার ভিত্তিতে যেকোনো অঙ্কের বাজেট পাস করতে পারবেন। তবে ম্যাকার্থি অতিরক্ষণশীলদের দাবির পক্ষে দাঁড়ানোয় প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাট সদস্যরা ভয় পাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেট ব্যাপক হারে কমানো হতে পারে। যদিও কতটা বাজেট অনুমোদন করা হবে, তা সিনেটে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হয়। তবে রক্ষণশীলদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির ফলে ম্যাকার্থির জন্য সরকারের অচলাবস্থ ঠেকাতে এই সমঝোতা আলোচনায় তাঁর যতটুকু ছাড় দিয়ে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে সেটা হয়তো সীমিত হয়ে পড়বে।