গাজা নিয়ে কমলা হ্যারিসের এই সুর বদলই কি যথেষ্ট
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা নিয়ে ‘চুপ না থাকার’ কথা সম্প্রতি জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। আগামী নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী তিনি।
কিন্তু কমলা হ্যারিসের এ বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির জন্য প্রকৃতপক্ষে কী অর্থ বহন করে, সেটি জানতে চান ফিলিস্তিনি অধিকারকর্মীরা।
ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা গত বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক শেষে গাজায় ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এরপরও ইসরায়েলের প্রতি তাঁর দেশের সমর্থনের বিষয়ে নিজের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন তিনি।
আপনি কারও মাথায় গুলি করছেন, আবার তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন—এমনটা প্রশংসার যোগ্য নয়। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আমাদের সহানুভূতি দেখানোর দরকার নেই; বরং প্রয়োজন ইসরায়েলকে অস্ত্র ও অর্থ দেওয়া বন্ধ করা, যা সক্রিয়ভাবে এ মানুষদের মেরে ফেলছে। আর এটি করা হলেই তাঁদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হবে।এমান আবদেলহাদি, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর সমাজবিজ্ঞানী
অধিকারকর্মীরা বলেন, ইসরায়েলকে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে শর্তহীন সমর্থন দেওয়ার মার্কিন নীতিতে অর্থপূর্ণ পরিবর্তন আনার চেষ্টা না করে ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে এমন সহানুভূতি প্রকাশের মধ্য দিয়ে কমলা ওই সব ভোটারের আস্থা ফেরাতে পারবেন না; যাঁরা গাজা যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর সমাজবিজ্ঞানী এমান আবদেলহাদি বলেছেন, ‘গাজার শিশুদের হত্যা বন্ধে সত্যিকার প্রতিশ্রুতি ছাড়া তাঁর (কমলা হ্যারিস) এ ধরনের সহানুভূতিতে আমার কিছু আসে যায় না।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যে নিষ্ঠুরতা চালানো হচ্ছে, এর দায় যুক্তরাষ্ট্রকেও বহন করতে হবে।
‘আপনি কারও মাথায় গুলি করছেন, আবার তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন—এমনটা প্রশংসার যোগ্য নয়। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আমাদের সহানুভূতি দেখানোর দরকার নেই; বরং প্রয়োজন, ইসরায়েলকে অস্ত্র ও অর্থ দেওয়া বন্ধ করা, যা সক্রিয়ভাবে এসব মানুষকে মেরে ফেলছে। আর এটি করা হলেই তাঁদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হবে’, বলেন এমান আবদেলহাদি।
উপরন্তু কমলা হ্যারিসের মন্তব্য গাজার বাসিন্দাদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বাগাড়ম্বর থেকে কিছুটা ভিন্ন হলেও সমালোচকেরা বলছেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নতুন নীতিগত অবস্থান খোলাসা করেননি।
কী বলেছিলেন কমলা হ্যারিস
নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৃহস্পতিবার বৈঠক শেষে কমলা ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক বিবৃতি দেন। সেখানে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ‘অবিচল প্রতিশ্রুতি’র ওপর পুনরায় গুরুত্বারোপ করেন তিনি। ব্যক্ত করেন ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ সব সময় নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিও।
ভাইস প্রেসিডেন্ট এরপর ইসরায়েলের নাম উল্লেখ না করে গাজার ভয়ানক পরিস্থিতি তুলে ধরার চেষ্টা চালান। অথচ সেখানকার মানবিক সংকটের জন্য যে দেশটি দায়ী, তা হলো ইসরায়েল।
অধিকারকর্মীরা বলেন, ইসরায়েলকে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে শর্তহীন সমর্থন দেওয়ার মার্কিন নীতিতে অর্থপূর্ণ পরিবর্তন আনার চেষ্টা না করে ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে এমন সহানুভূতি প্রকাশের মধ্য দিয়ে কমলা ওই সব ভোটারের আস্থা ফেরাতে পারবেন না; যাঁরা গাজা যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
গাজা যুদ্ধকে ‘বিধ্বংসী’ আখ্যায়িত করে কমলা হ্যারিস বলেন, ‘গাজায় বিপুলসংখ্যক নিরীহ বেসামরিক লোকজনের প্রাণহানিসহ মানুষের দুর্দশার কথাও প্রধানমন্ত্রীর (নেতানিয়াহু) কাছে ব্যক্ত করেছি আমি।’
ভাইস প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘মৃত শিশুদের ছবি এবং নিরাপদ স্থানের খোঁজে মরিয়া, ক্ষুধার্ত মানুষের পালানোর দৃশ্য—কখনো দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার তাঁদের বাস্তুচ্যুত হওয়া—এসব মর্মান্তিক ঘটনা থেকে আমরা নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে পারি না। এসব দুর্দশা দেখে আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারি না এবং আমি নীরব থাকব না।’
গাজায় যুদ্ধ অবসানে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কয়েক স্তরের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ও সেখান থেকে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির বিষয়েও জোরালো সমর্থন জানান কমলা। গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় ইসরায়েল ও হামাস উভয় পক্ষ কয়েক মাস ধরেই পরোক্ষভাবে সমঝোতা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান অধরা রয়ে গেছে।
কমলা আক্ষরিকভাবেই ইসরায়েলকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে যাবেন। এমনকি ইসরায়েলও দায়মুক্তি নিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাবে। অন্যদিকে নির্বাচনে জেতার চেষ্টায় যা বলার, তা বলে যাবেন কমলা।সামরা’য়া লুকম্যান, আরব আমেরিকান অধিকারকর্মী
অন্তত বাহ্যিক দৃষ্টিতে হলেও গাজা নিয়ে কমলার সুর বাইডেনের ইসরায়েলপন্থী বক্তব্য–বিবৃতি থেকে আলাদা। ভাইস প্রেসিডেন্টের মন্তব্যের পর ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘ফিলিস্তিনিদের দুর্দশায় জোর দিয়ে বাইডেন থেকে দূরত্ব তৈরি করলেন হ্যারিস’।
যাহোক, গাজা পরিস্থিতি নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে বিক্ষোভের আয়োজনকারীদের একজন হাজামি বার্মাডা বলেন, ‘গাজার বাসিন্দাদের বিষয়ে ভাইস প্রেসিডেন্টের সহানুভূতি প্রদর্শনে আলাদা কিছু নেই।’
এ নিয়ে বার্মাডা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের এক মন্তব্য ও তাঁর দেশের বাস্তব কর্মকাণ্ডের প্রতি ইঙ্গিত করেন। তাঁর কথায়, ব্লিঙ্কেন বলেন, গাজার শিশুদের মুখে তিনি নিজের সন্তানদেরই মুখ দেখতে পান। বার্মাডা বলেন, ‘অথচ ব্লিঙ্কেনের দপ্তর এখনো ইসরায়েলকে শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র দেওয়ার প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে।’
বার্মাডা আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমি মনে করি, গাজাবাসীর প্রতি সহানুভূতি দেখানোই যথেষ্ট নয়। আমরা ৭৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনে জাতিগত হত্যা, বর্ণবাদ, অবৈধ দখলদারী, সহিংসতা, সব ধরনের নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড ঘটতে দেখছি। আমাদের এখন যা প্রয়োজন, তা হলো অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই সহানুভূতিকে বাস্তব পদক্ষেপে রূপ দেওয়া।’
মার্কিন নির্বাচনে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর একটি মিশিগান। সেখানকার আরব–আমেরিকান অধিকারকর্মী সামরা’য়া লুকম্যানের মন্তব্য, ‘কমলা আক্ষরিকভাবেই ইসরায়েলকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে যাবেন। ইসরায়েলও দায়মুক্তি নিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাবে। অন্যদিকে নির্বাচনে জেতার চেষ্টায় যা বলার, তা বলে যাবেন কমলা।’