ইসরায়েলকে নিয়ে হতাশ কেন জো বাইডেন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলকে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিছু সূত্র মার্কিন গণমাধ্যমগুলোকে এ কথা জানিয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলের যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে সম্প্রতি ব্যাপক নিন্দার মুখে পড়েছেন বাইডেন।
তবে মার্কিন সংবাদপত্র দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ১১ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছে, ইসরায়েল গাজায় তার সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে জো বাইডেনের সম্পর্ক ‘ফাটলের’ সম্মুখীন।
বাইডেন অতি-ডানপন্থী ইসরায়েলি এই নেতার প্রতি ক্রমেই আরও বেশি ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছেন। এমনকি সাম্প্রতিক কয়েকটি অনুষ্ঠানে বাইডেন তাঁকে খুব খারাপভাবে সম্বোধন করেছেন। মার্কিন টেলিভিশন এনবিসি নিউজ এ কথা জানিয়েছে।
নেতানিয়াহুকে নিয়ে দৃশ্যত বাইডেনের হতাশা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এসব মন্তব্য ‘অর্থহীন’, যদি না তিনি ইসরায়েলকে গাজায় প্রাণঘাতী সামরিক হামলা বন্ধে চাপ দেন।
আমি মনে করি ‘‘আমরা কী করতে পারি?’’এ ধারণা শুধুই একটি রসিকতা। ফিলিস্তিনিদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের ঘাটতি নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যা ঘটছে, বিশেষ করে ইসরায়েলি সরকার যা করছে, তা এই দায়-দায়িত্বের ঘাটতির প্রমাণ।ইউএস ক্যাম্পেইন ফর প্যালেস্টাইন রাইটস’–এর পরামর্শ ও সংগঠনবিষয়ক পরিচালক ইমান আবিদ-থম্পসন
ওয়াশিংটন ডিসির গবেষণা ও বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান আরব সেন্টের পরিচালক ইমাদ হারব বলেছেন, একটুখানি বিবেক আছে এমন যে কারও জন্য ইসরায়েলের এ যুদ্ধ হতাশা ও ক্রোধ তৈরি করবে। তবে বাইডেনের ক্ষেত্রে এটি এখনো তাঁকে ফিলিস্তিনিদের জীবন বাঁচাতে পারে এমন আবশ্যকীয় কোনো যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে বাধ্য করতে পারেনি।
ইমাদ হারব আল–জাজিরাকে বলেছেন, ইসরায়েলের নীতি ও আচরণ পরিবর্তন করতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন চাপ দেওয়ার অনেক উপায় রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত ও বাস্তবতা হলো, ইসরায়েল এখনো চালকের আসন ধরে রেখেছে।
রাফায় ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলা
নেতানিয়াহুর প্রতি বাইডেনের ক্রমবর্ধমান হতাশা নিয়ে খবরগুলো এমন সময় এসেছে, যখন জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে সম্ভাব্য ইসরায়েলি স্থল আক্রমণের ব্যাপারে সতর্কতা-উদ্বেগ জানিয়েছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে ঘনবসতিপূর্ণ এ শহরে ইসরায়েলি বাহিনীর বোমাবর্ষণে শিশুসহ অন্তত ৬৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েল রাফাকে আগে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। শহরটিতে এখন ১৪ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। তাঁদের অনেকেই গাজার অন্য এলাকা থেকে এসেছেন এবং তাঁবুতে থাকছেন।
ওয়াশিংটন এমন একটি নীতি অনুসরণ করে, যা আমরা মনে করি, ইসরায়েল কীভাবে তার সামরিক অভিযান পরিচালনা করে, তা প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে সফলতার সর্বোচ্চ সক্ষমতা এটি আমাদের দেয়।মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার
রাফায় ইসরায়েলের পরিকল্পিত আক্রমণ সম্পর্কে নেতানিয়াহুর সঙ্গে বাইডেন কথা বলার ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে ওই হামলা চালানো হয়। ইসরায়েল বলেছে, তারা দুই ইসরায়েলি বন্দীকে মুক্ত করার অভিযানের অংশ হিসেবে এ হামলা চালায়।
দুই নেতার কথোপকথন নিয়ে হোয়াইট হাউসের বক্তব্য, বাইডেন ইসরায়েলি নেতাকে বলেছিলেন, রাফায় আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখের বেশি মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করার একটি গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা ছাড়া সেখানে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান এগিয়ে নেওয়া উচিত হবে না।
ফিলিস্তিনি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আল-শাবাকার মার্কিন নীতিবিষয়ক গবেষক তারিক কেনি-শাওয়া বলেন, নেতানিয়াহুর সঙ্গে বাইডেনের এ আলাপ রাফায় ওই দিনের প্রাণঘাতী বোমা হামলা চালানোর ‘একটি সবুজ সংকেত’ ছিল।
কেনি-শাওয়া আল–জাজিরাকে বলেন, নেতানিয়াহুর প্রতি বাইডেনের ক্ষুরধার কথাগুলো যদি সত্যিই বলা হয়ে থাকে, তবে সেগুলো কিছু শব্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। দিন শেষে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নীতি। বাইডেনের নীতি প্রতিটি পদক্ষেপে কোনো শর্ত ছাড়াই ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করেছে।
‘ইউএস ক্যাম্পেইন ফর প্যালেস্টাইন রাইটস’–এর পরামর্শ ও সংগঠনবিষয়ক পরিচালক ইমান আবিদ-থম্পসন বলেন, বাইডেন ও তাঁর প্রশাসন ‘কাপুরুষের’ পরিচয় দিয়েছে। কারণ, তারা বেশির ভাগ সমালোচনা করেছে পর্দার আড়ালে।
পরে আরেক সংবাদ সম্মেলনে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কিরবি মিলারের অবস্থানেরই পুনরাবৃত্তি করেন। রাফায় সম্ভাব্য স্থল অভিযান শুরুর আগে বাইডেন কখনো ইসরায়েলকে মার্কিন সামরিক সহায়তা কমানোর বিষয়ে হুমকি দিয়েছিলেন কি না প্রশ্ন করা হলে, কিরবি সরাসরি উত্তর না দিয়ে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক সমর্থন প্রকাশসূচক মন্তব্য করেন।
থম্পসন বলেন, তাদের এসব সমালোচনা প্রকাশ্যে ও উচ্চকণ্ঠে করা উচিত; যাতে প্রত্যেকে সেগুলো শুনতে পারে এবং তা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আবিদ-থম্পসন আল–জাজিরাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের ওপর যথেষ্ট চাপ না দেওয়ায় তারা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। তিনি বিশ্বাস করেন না যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বিশেষ করে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ইসরায়েলকে অন্তত ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন (৩৮০ কোটি) মার্কিন ডলার সামরিক সহায়তা প্রদান করে।
ইউএস ক্যাম্পেইন ফর প্যালেস্টাইন রাইটসের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি মনে করি ‘‘আমরা কী করতে পারি?’’এ ধারণা শুধুই একটি রসিকতা। ফিলিস্তিনিদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের ঘাটতি নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যা ঘটছে, বিশেষ করে ইসরায়েলি সরকার যা করছে, তা এই দায়-দায়িত্বের ঘাটতির প্রমাণ।’
ইসরায়েলের সামরিক অভিযান সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবিদ-থম্পসন আরও উল্লেখ করেন, ‘আমরা জানি, এটি (অভিযান) চলছে ও জোরালো হচ্ছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র নিঃশর্তভাবে ইসরায়েলকে অর্থায়ন করে চলেছে।’
চাপ প্রয়োগের উপায়
রাফায় ইসরায়েল তার অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে বাইডেন প্রশাসন দেশটিকে সহায়তা প্রদান বন্ধের বিষয়ে চিন্তা করবে কি না, সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাইলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, ‘ওয়াশিংটন এমন একটি নীতি অনুসরণ করে, যা আমরা মনে করি, ইসরায়েল কীভাবে তার সামরিক অভিযান পরিচালনা করে, তা প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে সফলতার সর্বোচ্চ সক্ষমতা এটি আমাদের দেয়।’
ম্যাথু মিলার সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে (বাইডেন) প্রশাসন ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়েছে। তবে ওয়াশিংটন (ইসরায়েলকে) সহায়তা বন্ধ করলে তা ইতিমধ্যে আমাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হবে—এটি মূল্যায়ন করেনি।’
মিলার আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, কখনো কখনো লোকেরা এটি ভাবে যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন একটি জাদুর কাঠি রয়েছে, যেটি বিশ্বের যেকোনো পরিস্থিতিকে আমরা যেভাবে চাই, ঠিক সেভাবে তৈরি করতে পারে। কিন্তু এটি কখনোই হওয়ার নয়।’
পরে আরেক সংবাদ সম্মেলনে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কিরবি মিলারের অবস্থানেরই পুনরাবৃত্তি করেন। রাফায় সম্ভাব্য স্থল অভিযান শুরুর আগে বাইডেন কখনো ইসরায়েলকে মার্কিন সামরিক সহায়তা কমানোর বিষয়ে হুমকি দিয়েছিলেন কি না প্রশ্ন করা হলে, কিরবি সরাসরি উত্তর না দিয়ে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক সমর্থন প্রকাশসূচক মন্তব্য করেন।
কিরবি বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলকে দেওয়া সমর্থন অব্যাহত রাখব। তাদের হামাসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করার অধিকার রয়েছে। আমরা নিশ্চিত করব যে তাদের কাছে আত্মরক্ষা করার মতো যথেষ্ট সরঞ্জাম ও ক্ষমতা রয়েছে।’
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র শুধু তার নিজস্ব আইন মেনে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এগুলোর একটি হলো, তথাকথিত ‘লিহি’ আইন; যা মার্কিন সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে সামরিক সহায়তা দেওয়া থেকে বিরত রাখে।
কেনি-শাওয়া বলেছেন, বাইডেনের হতাশা অর্থহীন, যদি না তিনি নেতানিয়াহু ও ইসরায়েল সরকারের ওপর জোরালো ও সত্যিকারের চাপের সঙ্গে এটি যুক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, এর বদলে ওয়াশিংটন ইসরায়েলের হামলার ক্ষয়ক্ষতিকে ন্যূনতম রাখার প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছে।
সত্যের সামনে
গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠানোর বিষয়কে অনুমোদন দিয়েছে। যদিও ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগ ও গণহত্যা চালানোর ঝুঁকি তৈরি হওয়া নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
বাইডেন প্রশাসন এমন আইনও সমর্থন করেছে, যা ইসরায়েলকে অতিরিক্ত ১৪ বিলিয়ন (১ হাজার ৪০০ কোটি) ডলার মার্কিন নিরাপত্তা সহায়তা প্রদান করে। তারা গাজায় দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতির কথা বলতেও অস্বীকার করেছে ও যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের প্রচেষ্টা আটকে দিয়েছে।
ওয়াশিংটন ডিসির গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘ডেমোক্রেসি ফর দ্য আরব ওয়ার্ল্ড নাও’–এর আইনবিষয়ক পরিচালক রাইদ জারার বলেন, বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে সম্পর্ক কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
জারার মতে, এখন ওয়াশিংটন যদি ‘গাজায় গণহত্যার পরবর্তী অধ্যায়’ রাফায় পরিকল্পিত ইসরায়েলি সামরিক অভিযান থামাতে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়, তবে তা হতে পারে ওয়াশিংটনের আগের কর্মকাণ্ডগুলোর একটা প্রায়শ্চিত্ত।