ট্রাম্পকে মাটিতে নামাতে পারেন যে ব্যক্তি
সাবেক এক মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দুটি পৃথক ফৌজদারি অপরাধের তদন্তের তত্ত্বাবধান করছেন তিনি। বড় ধরনের মামলার ক্ষেত্রে তাঁর নাম একেবারে অপরিচিত নয়। তিনি জ্যাক স্মিথ।
দুই দশক ধরে স্মিথ (৫৪) দেশে-বিদেশে অনেককে বিচারের আওতায় আনতে কাজ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্যের মিশ্র রেকর্ড রয়েছে।
অভিজ্ঞ এই কৌঁসুলিকে মার্কিন বিচার বিভাগ কর্তৃক দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দুটি তদন্তে বিশেষ কৌঁসুলি নিযুক্ত করার পর থেকে অনেকটা নিভৃতে কাজ করছেন। তবে ট্রাম্প তাঁকে বারবার নানাভাবে আক্রমণ করছেন।
গত বছরের নভেম্বরে স্মিথকে এই পদে নির্বাচিত করার কথা ঘোষণা করা হয়।
তখন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড বলেছিলেন, এসব বিষয় একহাতে ও জরুরি ভিত্তিতে সুসম্পন্ন করার জন্য স্মিথই সঠিক ব্যক্তি।
তবে ট্রাম্প ইতিমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অগ্রভাগে থাকা ব্যক্তিদের একজন হিসেবে স্মিথকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি একই সঙ্গে স্মিথকে একজন ‘উন্মত্ত’ ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বিশেষ এই কৌঁসুলি আগেই ট্রাম্পকে সরকারি গোপন নথির অপব্যবস্থাপনার জন্য ৪০টি অপরাধমূলক অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।
সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে ট্রাম্পকে আলাদাভাবে অভিযুক্ত করেছেন স্মিথ। এ ক্ষেত্রে তিনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ এনেছেন।
বিশেষ এই আইনি পরামর্শকের পুরো নাম জন লুমান স্মিথ। তিনি নিউইয়র্কের বাসিন্দা।
হার্ভার্ড ল স্কুল থেকে স্নাতক করেছেন স্মিথ। তিনি ১৯৯৪ সালে ম্যানহাটান ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অফিসে সহকারী ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন।
পরে ব্রুকলিনের মার্কিন অ্যাটর্নি অফিসে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয় স্মিথের। সেখানে তিনি সহিংস গ্যাং, আর্থিক অপরাধ ও দুর্নীতির মামলা নিয়ে কাজ করেন।
বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পারিবারিক সহিংসতার এক মামলায় এক নারীকে সাক্ষী হতে রাজি করাতে নাছোড়বান্দার মতো লেগে ছিলেন স্মিথ। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের করিডরে এক সপ্তাহ কাটিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৯৭ সালে হাইতিয়ান অভিবাসী আবনার লুইমা নিউইয়র্ক পুলিশের হাতে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হন। বহুল আলোচিত ওই ঘটনা যাঁরা তদন্ত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে স্মিথ ছিলেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্য অনুসারে, স্মিথ দলগত (টিমওয়ার্ক) কাজে অভিজ্ঞ। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলায় তাঁকে বিশেষ কৌঁসুলি হিসেবে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে তাঁর এই অভিজ্ঞতার বিষয়টি বিবেচনায় ছিল।
২০০৮ সালে স্মিথ নেদারল্যান্ডসের হেগে যান। সেখানে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের জুনিয়র তদন্তকারী হিসেবে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত তদারক করেন।
দুই বছর পরে মার্কিন বিচার বিভাগের কাজে ফেরেন স্মিথ। তিনি মার্কিন বিচার বিভাগের পাবলিক ইন্টেগ্রিটি ইউনিটের প্রধানের দায়িত্ব পান। এই ইউনিট ঘুষ, নির্বাচনী জালিয়াতির মতো অপরাধের বিরুদ্ধে কাজ করে।
২০১০ সালে বার্তা সংস্থা এপিকে এক সাক্ষাৎকারে স্মিথ নেদারল্যান্ডসের হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাজ ছেড়ে কেন মার্কিন বিচার বিভাগে ফিরে এসেছিলেন, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্তকে তিনি দেশের মঙ্গলের জন্য নিজের স্বপ্নের চাকরি ছেড়েছেন বলে জানিয়েছিলেন।
স্মিথ যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পাবলিক ইন্টেগ্রিটি ইউনিটটি একটি আইনগত পরাজয়ের ধাক্কা সামলে ওঠার চেষ্টা করছিল।
ইউনিটটি মার্কিন কংগ্রেসের কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত করে আসছিল। এই তদন্ত বন্ধ করার মধ্য দিয়ে ইউনিটে স্মিথের পথচলা শুরু হয়। এরপর তিনি অন্য প্রচেষ্টা নিয়ে অগ্রসর হন।
ইউনিটটিতে স্মিথের মেয়াদকালে প্রসিকিউটররা ভার্জিনিয়ার সাবেক গভর্নর বব ম্যাকডোনেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করেন। রিপাবলিকান ববের বিরুদ্ধে করা মামলাটি ২০১৬ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতভাবে বাতিল করেন।
ইউনিটটি সাবেক ডেমোক্র্যাট ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন এডওয়ার্ডসকে বিচারের মুখোমুখি করেছিল। কিন্তু একটি জুরি এডওয়ার্ডসকে একটি অভিযোগে খালাস দেন। বাকি অভিযোগগুলো ঝুলে ছিল। তাঁর আর কখনো বিচার হয়নি।
স্মিথকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে ট্রাম্প এসব উদাহরণকেই ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, স্মিথ অনেকের জীবন ধ্বংস করেছেন। একটি ট্যাক্স কেলেঙ্কারিতে তিনি জড়িত ছিলেন বলেও অভিযোগ ট্রাম্পের। এ জন্য তিনি স্মিথকে তিরস্কার করেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, স্মিথ যা করেছেন, তা ভয়ংকর। এটি ক্ষমতার অপব্যবহার, আইনি অসদাচরণ।
পেশাজীবনে স্মিথের উল্লেখযোগ্য সাফল্যও আছে। এর মধ্যে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য অ্যাসেম্বলির সাবেক স্পিকার শেলডন সিলভারকে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে পাঠানোর ঘটনা রয়েছে।
রিপাবলিকান পার্টির অ্যারিজোনার সাবেক কংগ্রেসম্যান রিক রেনজি দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন স্মিথের প্রচেষ্টায়। রেনজি অবশ্য পরে ট্রাম্পের আমলে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে ক্ষমা পান।
২০১৫ সালে স্মিথ টেনেসির নাশভিলে ফেডারেল প্রসিকিউটরের অফিসে যোগ দেন। পরিবারের কাছাকাছি থাকতে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
ট্রাম্পের শাসনামলে স্থায়ী নিয়োগ না পেয়ে ২০১৭ সালে একটি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা সংস্থায় যোগ দেন স্মিথ।
২০১৮ সালে স্মিথ আবার হেগে ফিরে যান। সেখানে তিনি গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কসোভোয় সংঘাতকালে সংঘঠিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগসংক্রান্ত মামলায় আদালতের প্রধান প্রসিকিউটরের পদ গ্রহণ করেন।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল গারল্যান্ড যখন স্মিথকে ওয়াশিংটনে বিশেষ কাউন্সেলের চাকরির প্রস্তাব দেন, তখন তাঁর (স্মিথ) দল কসোভোর সাবেক প্রেসিডেন্ট হাশিম থাচির বিচারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
স্মিথ তখনই মার্কিন বিচার বিভাগে ফিরতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সে সময় তিনি একটি সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ছিলেন। এ কারণে অস্ত্রোপচারের পর সেরে উঠতে তাঁর কিছুটা সময় লেগেছিল। এর ফলে ২০২১ সালের জানুয়ারির আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরতে পারেননি।
স্মিথের বন্ধু ও সাবেক সহকর্মী নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি মোয়ে ফোডেম্যান। তিনি গত বছর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেছিলেন, তাঁর দেখা সেরা আইনজীবীদের একজন স্মিথ।
স্মিথের অন্য সাবেক সহকর্মীরা তাঁকে একজন নির্ভীক ও সক্রিয় আইনজীবী হিসেবে অভিহিত করেছেন। অনেকে বলেছেন, স্মিথকে অপদস্থ করার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।