বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ ঠেকাতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বর্জন করেছেন শিক্ষার্থীরা। এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলন দমাতে শত শত বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ।
ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বোস্টন শহর পুলিশের বরাতে সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজ জানিয়েছে, শহরের এমারসন কলেজ থেকে স্থানীয় সময় বুধবার রাতে প্রায় ১০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে সন্ধ্যায় ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ৯৩ জনকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়।
টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অস্টিন শহরে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসেও বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সেখান থেকে ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কলাম্বিয়া, ইয়েল ও নিউইয়র্ক ইউনির্ভাসিটিতে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের পর নতুন করে এসব গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চলা এ হামলায় উপত্যকাটিতে ৩৪ হাজার ৩০৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে তীব্র মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে সেখানে।
ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যালামনাই পার্কে বিক্ষোভ করতে বুধবার জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁদের বাধা দেয় দাঙ্গা পুলিশ। পুলিশের হেলিকপ্টার থেকে ঘোষণা দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ১০ মিনিটের মধ্যে সরে যেতে বলা হয়। এরপরও ঘটনাস্থলে থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
জানা গেছে, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় বিক্ষোভ প্রথমে শান্তিপূর্ণ ছিল। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ এক নারীকে আটক করতে গেলে পানির বোতল ছুড়ে মারেন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় তাঁরা স্লোগান দিতে থাকেন—‘তাঁকে ছেড়ে দিন।’ এ ছাড়া পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘিরে ‘ফিলিস্তিনের মুক্তি চাই’ বলেও স্লোগান দেন তাঁরা।
গত রোববার থেকে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তাঁবু টাঙিয়ে অবস্থান করছেন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা। সতর্ক করার পরও তাঁরা সেখান থেকে সরেননি বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। সিবিএস নিউজকে বোস্টন পুলিশ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে তাদের তিন সদস্য আহত হয়েছেন। তাঁদের একজনের অবস্থা গুরুতর। আর সংঘর্ষে কোনো শিক্ষার্থী আহত হননি।
মার্কিন গণমাধ্যম ফক্স নিউজ ৭-এর একজন আলোকচিত্রীকে তাঁর ক্যামেরাসহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁকে ঘিরে রেখেছিল দাঙ্গা পুলিশ।
এদিকে বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দেয়নি এমারসন কলেজ কর্তৃপক্ষ। এর আগে এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছিল, কলেজ কর্তৃপক্ষ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকারকে সমর্থন করে। একই সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের আইন মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়।
টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি
টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীদের সরাতে বুধবার অভিযানে নামেন পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় বাসিন্দারা। লাঠি হাতে ঘোড়ায় চড়ে পুলিশ সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। টেক্সাসের গভর্নর বলেছেন, এই বিক্ষোভকারীদের ‘কারাগারে থাকা উচিত’।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, বিক্ষোভকারীদের পিছু হটানোর চেষ্টা করছেন পুলিশ সদস্যরা। তাঁরা মাইকে বিক্ষোভকারীদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে নির্দেশ দেন। এর ব্যতিক্রম হলে গ্রেপ্তারের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। পুলিশ জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে মার্কিন গণমাধ্যম ফক্স নিউজ ৭–এর একজন আলোকচিত্রীকে তাঁর ক্যামেরাসহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁকে ঘিরে রেখেছিল দাঙ্গা পুলিশ। পরে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ওই আলোকচিত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কলাম্বিয়ায় গ্রেপ্তারের পর ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ
সম্প্রতি নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে গাজায় হামলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসজুড়ে দেখা যায় ফিলিস্তিনের পতাকা। প্ল্যাকার্ডে লেখা হয়, ‘সত্যিকারের আমেরিকা গাজার পক্ষে’, ‘গাজায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় টিকে নেই’—এমন সব স্লোগান। বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পরপরই এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে।
এ ছাড়া গত সপ্তাহে ‘নিরাপত্তা ঝুঁকিকে’ কারণ দেখিয়ে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার সেরা ছাত্রীর সমাবর্তন বক্তৃতা (ভেলেডিক্টোরিয়ান) বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই ছাত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইহুদিবিরোধী তৎপরতা চালান বলে অভিযোগ ওঠার পর এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে আসনা তাবাসসুম নামের ওই ছাত্রীর অভিযোগ, তাঁর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ইসরায়েলপন্থী ও ইহুদি গোষ্ঠী বলছে, এসব বিক্ষোভে ইহুদিবিরোধী উপাদান রয়েছে। ফলে তারা নিরাপদ বোধ করছে না।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া–বার্কলে ও ইউনির্ভাসিটি অব মিশিগানেও ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। এর জেরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ইসরায়েলপন্থী ও ইহুদি গোষ্ঠী বলছে, এসব বিক্ষোভে ইহুদিবিরোধী উপাদান রয়েছে। ফলে তারা নিরাপদ বোধ করছেন না।
নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির কয়েকজন ইহুদি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ‘হুমকিপূর্ণ’ উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছেন, সেখানে ইহুদি শিক্ষার্থীদের ওপর হয়রানির ঘটনা খুবই বিরল।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘গণহত্যা থেকে বিচ্ছিন্ন’ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। যেসব প্রতিষ্ঠান অস্ত্র উৎপাদনসহ নানা উপায়ে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় সহযোগিতা করছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের বৃত্তি না দেওয়ার দাবিও তুলেছেন তাঁরা। যদিও ইসরায়েল বলছে, গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে না তারা। তবে উপত্যকাটিতে গণহত্যার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না আন্তর্জাতিক বিচার আদালত।