জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট, মহা কেলেঙ্কারিতে বিদায়
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭তম প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। দেশটির ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় এই প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা হারান মহা কেলেঙ্কারিতে। যা পরিচিত ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ নামে। ১৯৭৪ সালের ৮ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে পদত্যাগের ঘোষণা দেন নিক্সন। পরদিন ৯ আগস্ট পদত্যাগ করেন তিনি। মার্কিন ইতিহাসে পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া একমাত্র প্রেসিডেন্ট নিক্সন
সময়টা ১৯৭৪ সালের ৮ আগস্ট। দুপুর নাগাদ হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়, রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। গুঞ্জন ছড়ায়, পরিস্থিতি আর হাতের মুঠোয় নেই। তাই পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন নিক্সন।
রাত ঠিক আটটা, শুধু যুক্তরাষ্ট্রবাসী নন, বিশ্বের রাজনীতিসচেতন মানুষদের চোখ টিভির পর্দায়, কান রেডিওতে। ঠিক সময়েই প্রেসিডেন্টের সরকারি দপ্তর ওভাল অফিস থেকে জাতির সামনে হাজির হলেন নিক্সন। অবশেষে গুঞ্জন সত্যি হলো। প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়ার ঘোষণা দিলেন তিনি।
ভাষণে জাতির উদ্দেশে নিক্সন বললেন, ‘আমি কখনো দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়ার মানুষ নই। কিন্তু একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার কাছে আমেরিকার স্বার্থ সবার আগে। আমি পদত্যাগ করতে যাচ্ছি। আগামীকাল আমি হোয়াইট হাউস ছাড়ব।’
পরদিন আলোচিত-সমালোচিত নিক্সন যুগের সমাপ্তি ঘটল। রচিত হলো এক ইতিহাস। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া একমাত্র প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। আর তাঁর বিদায় হয় দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে, যার নাম ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন
রিচার্ড নিক্সনের জন্ম ১৯১৩ সালে, ক্যালিফোর্নিয়ায়। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আইনে পড়াশোনা করা নিক্সনের। ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর ছিলেন। প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের আমলে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। ১৯৬৮ সালের নির্বাচনের জয় পাওয়ায় পরের বছরের ২০ জানুয়ারি রিপাবলিকান নেতা নিক্সন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন।
ওই সময় স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা তুঙ্গে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তুমুল বিরোধের মুখে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করা, সেই সঙ্গে বেইজিং সফর করে দেশ-বিদেশে সফল কূটনীতির অনন্য নজির স্থাপন করেন নিক্সন। দেশে তখন তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা। এর ওপর ভর করে ১৯৭২ সালের নির্বাচনেও উতরে যান নিক্সন। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৪৯টিতে জয় পান তিনি। আরেক মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব নেন।
মার্কিন রাজনীতিতে নিক্সনের উত্থানটা ছিল বেশ ধীরে। কংগ্রেসম্যান, সিনেটর, ভাইস প্রেসিডেন্ট, এরপর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন তিনি। কিন্তু তাঁর পতনটা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। দেশে-বিদেশে তুমুল বিতর্ক নিক্সনের জনপ্রিয়তাকে আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনে। প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদত্যাগ করতে হয় তাঁকে।
কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যায় দ্রুত। জড়িয়ে পড়েন বহুল আলোচিত কেলেঙ্কারিতে। এই কেলেঙ্কারির যখন সূচনা, তখন নিক্সন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় ব্যস্ত। আর দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালনের মাঝামাঝিতে গিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি।
একটি হোটেল ও কেলেঙ্কারি
ওয়াশিংটনের একটি হোটেলের নাম ‘ওয়াটারগেট’। সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির ন্যাশনাল কমিটির কার্যালয় ছিল। ১৯৭২ সালের ১৬ জুন রাত থেকে ১৭ জুন ভোর পর্যন্ত ওয়াটারগেট হোটেল ও অফিস কমপ্লেক্স থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে আড়ি পাতার যন্ত্র উদ্ধার করা হয়।
ঘটনাটি এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু এর সঙ্গে যে নিক্সনের ভাগ্য জড়িয়ে যাবে, তা তখন কেউ ভাবেননি। পরদিন ‘বোমা ফাটায়’ সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট। সংবাদমাধ্যমটির প্রথম পৃষ্ঠায় বড় এক কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বিরোধী দলের ওই কার্যালয়ে গোপনে টেপরেকর্ডার পাতা হয়েছিল। এর পেছনে জড়িত রিপাবলিকান পার্টি। আর ঘটনাটি জানতেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট নিক্সন।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির বিষয়টি অনুসন্ধান করেন ওয়াশিংটন পোস্টের দুই তরুণ প্রতিবেদক বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টাইন। আর প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয় পত্রিকার কিংবদন্তিপ্রতিম সম্পাদক বেন ব্র্যাডলির নেতৃত্বে। তাঁরা জানান, আড়ি পাতার পেছনে নিক্সনের পুনর্নির্বাচন কমিটির সদস্য ও সিআইএর সাবেক সদস্য জেমস ম্যাককর্ডের দায় রয়েছে। এর সঙ্গে হোয়াইট হাউসের হাত রয়েছে।
গুরুতর এই অভিযোগ অস্বীকার করেন নিক্সন। ভাষণ দিয়ে জাতিকে জানান, তিনি নির্দোষ। সিনেটর-কংগ্রেসম্যানদের বেশির ভাগ নিক্সনের পাশে ছিলেন। পাশে ছিল না সংবাদমাধ্যম। এ নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে ওয়াশিংটন পোস্ট। বলা হয়, প্রেসিডেন্ট নিক্সন মিথ্যা বলছেন। বিশ্বে সংবাদমাধ্যমে এ ঘটনা ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিতি পায়।
রেকর্ড নিয়ে বিতর্ক
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির বিষয়টি অনুসন্ধান করেন ওয়াশিংটন পোস্টের দুই তরুণ প্রতিবেদক বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টাইন। আর প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয় পত্রিকার কিংবদন্তিপ্রতিম সম্পাদক বেন ব্র্যাডলির নেতৃত্বে। তাঁরা জানান, আড়ি পাতার পেছনে নিক্সনের পুনর্নির্বাচন কমিটির সদস্য ও সিআইএর সাবেক সদস্য জেমস ম্যাককর্ডের দায় রয়েছে। এর সঙ্গে হোয়াইট হাউসের হাত রয়েছে।
এসব প্রতিবেদনের জেরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা এবং ওয়াশিংটন পোস্ট নিক্সন প্রশাসনের রোষানলে পড়ে। কিন্তু পিছু হটেনি সংবাদমাধ্যমটি। বছর দুয়েক ধরে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে নির্বাচনের আগে নিক্সনের নির্বাচনী প্রচার কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেটিক পার্টির কৌশল সম্পর্কে জানতে ওয়াশিংটনে দলটির সদর দপ্তরে গোপনে টেপরেকর্ডার স্থাপন করেছিলেন।
ঘটনাটি ফাঁস হওয়ার পর হোয়াইট হাউসের কয়েকজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন এবং একজনকে বরখাস্ত করা হয়। পরে ওই বছরের নভেম্বরে নিক্সন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এফবিআইয়ের কর্মকর্তারা রেকর্ড চান। কিন্তু নিক্সন প্রশাসন তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
নিজের অবস্থানে বেশি দিন অটুট থাকতে পারেননি নিক্সন। সংবাদমাধ্যমের অব্যাহত চাপ, রাজনৈতিক বন্ধুদের পাশ থেকে সরে যাওয়া ও জনসমর্থন করতে থাকায় ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে টেপ প্রকাশ করেন নিক্সন। তবে তা পর্যাপ্ত ছিল না। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়। জুলাইয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে টেপ হস্তান্তর করেন নিক্সন। এ থেকে প্রমাণ হয়ে যায়, নিক্সন আড়ি পাতা সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন।
পদত্যাগ সময়ের ব্যাপার
মার্কিন রাজনীতিতে তুমুল জনপ্রিয় ব্যক্তিদের একজন ছিলেন নিক্সন। এই জনপ্রিয়তা তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে। কিন্তু তাঁর ইমেজ যেন ভেঙেচুড়ে দেয় ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জমা দেওয়া টেপের মধ্যে একাংশ রেকর্ডিং খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে নিক্সনের সেক্রেটারি রোজ মেরি উডস দাবি করেন, ভুলবশত ওই অংশ মুছে গেছে। তবে কারও বুঝতে বাকি ছিল না, প্রেসিডেন্টকে বাঁচাতে এটা ইচ্ছা করে করা হয়েছে। এর ফলে আগস্ট নাগাদ জনমত নিক্সনের বিপক্ষে চলে যায়। মার্কিন কংগ্রেসের একটা বড় অংশ চলে যায় তাঁর বিরুদ্ধে। উদ্যোগ নেওয়া হয় অভিশংসনের।
নানামুখী চাপ, বিতর্ক ও সমালোচনা আর অভিশংসন উদ্যোগের জেরে আগেভাগে পদত্যাগের ঘোষণা দেন নিক্সন। তাই ৮ আগস্ট রাতে তিনি যখন টিভি পর্দায় হাজির হন, সবাই আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, এখন আর নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন না নিক্সন। ইতিহাস গড়ে প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দেওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র। সেটাই হয়।
‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’
মার্কিন রাজনীতিতে নিক্সনের উত্থানটা ছিল বেশ ধীরে। কংগ্রেসম্যান, সিনেটর, ভাইস প্রেসিডেন্ট, এরপর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন তিনি। কিন্তু তাঁর পতনটা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। দেশ-বিদেশে তুমুল বিতর্ক নিক্সনের জনপ্রিয়তাকে আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনে। প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদত্যাগ করতে হয় তাঁকে।
নিক্সনের বিদায় এবং মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি নিয়ে হলিউডে সিনেমা হয়েছে। নাম ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’। ১৯৭৬ সালের ৪ এপ্রিল রাজনৈতিক-থ্রিলার ঘরানার সিনেমাটি মুক্তি পায়। এই সিনেমায় ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির খবর সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে গিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট এবং দুই অনুসন্ধানী তরুণ প্রতিবেদকের লড়াই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সিনেমাটি বানানো হয়েছিল ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’ নামে একটি বই থেকে। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির খবর প্রথম প্রকাশ করা ওয়াশিংটন পোস্টের দুই তরুণ প্রতিবেদক বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টাইন এই বই লিখেন। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালের ১৫ জুন, নিক্সনের পদত্যাগের মাস দুয়েক আগে।
আলোচিত এই কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ করে ১৯৭৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
আলোচিত-সমালোচিত প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জীবনাবসান ঘটে ১৯৯৪ সালের ২২ এপ্রিল। নিউইয়র্কে মারা যান তিনি।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, বিবিসি ও ডয়চে ভেলে