কীভাবে মার্কিন গোপন নথিতে ঢুকলেন টাশেরা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত কয়েক ডজন অতিগোপনীয় গোয়েন্দা নথি ফাঁস হয়েছে। এসব নথি ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে। নথি ফাঁসের ঘটনায় ১৩ এপ্রিল সামরিক বাহিনীতে কর্মরত জ্যাক টাশেরা নামের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই। তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। টাশেরাকে গ্রেপ্তারের পরের ঘটনাপ্রবাহ, গোপন নথিতে তাঁর প্রবেশাধিকার এবং সামরিক বাহিনীতে তাঁর পেশাগত জীবন নিয়ে নতুন কিছু বিষয় উঠে এসেছে।
টাশেরার বয়স মাত্র ২১ বছর। তিনি ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে এয়ার ন্যাশনাল গার্ডের একজন সদস্য। তাঁর বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়াই জাতীয় প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত গোপন তথ্য হস্তগত ও স্থানান্তর এবং তথ্য নিজের কাছে রাখা ও সরানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। এই দুই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
অনলাইন গেমের একটি চ্যাটরুমে গোপন এসব নথি প্রকাশ করেছিলেন টাশেরা। ফাঁস হওয়া এসব গোপন মার্কিন গোয়েন্দা নথিতে রাশিয়া– ইউক্রেন যুদ্ধের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ও মিত্র দেশ নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দাদের সংগ্রহ করা বিভিন্ন তথ্যও এসব নথিতে রয়েছে।
তবে এ ঘটনা নিয়ে চলমান তদন্ত নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি মার্কিন কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে কীভাবে এসব তথ্য ফাঁস হলো, সে বিষয়েও কিছু জানাননি তাঁরা। তবে শুক্রবার আদালতে যেসব নথি দাখিল করা হয়েছে, সেখান থেকে টাশেরার জীবন এবং কীভাবে তিনি এসব নথি ফাঁস করলেন, তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। আদালতে দাখিল হওয়া নথিগুলো থেকে যেসব বিষয় জানা গেছে, সেগুলোই তুলে ধরা হলো।
প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বরে
টাশেরার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে এফবিআইয়ের স্পেশাল এজেন্টের লেখা একটি হলফনামা, যিনি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ও গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।
হলফনামায় এফবিআইয়ের স্পেশাল এজেন্ট প্যাট্রিক লুকেনহফ বলছেন, একজন ব্যবহারকারীর নাম (ইউজার নেম) ব্যবহার করে এক ব্যক্তি পেমেন্ট রেকর্ডের মাধ্যমে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এসব অতিগোপনীয় নথি অনলাইন মাধ্যমে পোস্ট করা শুরু করেন। পরে জানা যায়, ওই ইউজার নেম টাশেরার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
হলফনামা অনুযায়ী, গেমারদের কাছে জনপ্রিয় ডিসকর্ড নামক একটি সামাজিক মাধ্যমের চ্যাটরুমে এসব নথি পোস্ট করা হয়। ওই চ্যাটরুমে মূলত ভূরাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
হলফনামায় বলা হয়, জানুয়ারিতে নথিগুলোর ছবি পোস্ট করা হয়। এসব নথির ছবিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোনো নথি গোপনীয় হলে যেসব চিহ্ন দেয়, সেসব চিহ্ন দেখা যায়।
নামবিহীন (ইউজার ১ নাম দেওয়া হয়েছে শুধু) একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী এফবিআইকে বলেছেন, শুরুর দিকে যেসব নথি পোস্ট করা হয়েছে, তার একটিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের হালহকিকত সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ একটি দিনে সেনাদের গতিবিধি–সম্পর্কিত তথ্য সেখানে ছিল।
হলফনামায় ফাঁস হওয়া এসব নথিকে ‘সংবেদনশীল মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, গোপন উত্স ও পদ্ধতির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
হলফনামা অনুযায়ী, কোনো নথিতে ‘অতিগোপনীয়’ চিহ্ন থাকা মানে এসব প্রকাশ করা হলে জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ইউজার ১ এফবিআইকে আরও জানিয়েছে, টাশেরা বলেছিলেন তিনি উদ্বিগ্ন, কারণ যদি তিনি তাঁর কর্মস্থলেই এসব নথির অনুলিপি তৈরি করেন, তাহলে ধরা পড়ে যেতে পারেন। তাই তিনি নথিগুলো অফিস থেকে তাঁর বাড়ি নিয়ে সেগুলোর ছবি তুলতে শুরু করেছিলেন।
ফাঁস হওয়া এসব নথির কিছু ছবি বিবিসি পর্যালোচনা করেছে। তাতে দেখা গেছে, এসব নথি আবাসিক ঠিকানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটিতে, একটি রান্নাঘরের কাউন্টারটপ এবং মেঝের টাইলস স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। অন্যগুলোতে একটি ডেস্কে বিভিন্ন ব্যক্তিগত জিনিসপত্র দেখা যায়।
গোপন তথ্যে প্রবেশাধিকার ছিল টাশেরার
আদালতে দাখিল হওয়া নথি অনুযায়ী, টাশেরা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এয়ার ন্যাশনাল গার্ডে যোগ দেন। তিনি জুনিয়র পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁর পদবি ছিল সাইবার ডিফেন্স অপারেশনস জার্নিম্যান। বর্তমানে তাঁর পদবি একজন ই–৩ এয়ারম্যান।
২০২১ সালে টাশেরাকে ‘অতিগোপনীয়’ নিরাপত্তাসংক্রান্ত তথ্যে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়। একই বছর তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অন্যান্য গোপন কর্মসূচিতে সংবেদনশীল কমপার্টমেন্টের প্রবেশাধিকারও দেওয়া হয়।
এসব প্রবেশাধিকার অনুমতি পেতে আজীবনের জন্য একটি নথিতে স্বাক্ষর করতে হয় তাঁকে। এর শর্ত হলো, তিনি বেঁচে থাকতে এসব তথ্য কখনো প্রকাশ করতে পারবেন না। একই সঙ্গে তাঁর কাছ থেকে এটাও স্বীকার করিয়ে নেওয়া হয়, কারও অনুমতি ছাড়া তিনি যদি এসব সংরক্ষিত তথ্য প্রকাশ করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হবে।
অতিগোপনীয় তথ্যসংক্রান্ত বিভিন্ন মামলা নিয়ে কাজ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন একজন জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক আইনজীবী মার্ক জাইদ। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, এত কম বয়সে টাশেরার মতো কারও গোপন নথিতে প্রবেশাধিকার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।
মার্ক জাইদ বলেন, ‘টাশেরার বয়সী অনেকে আছেন, যাঁদের গোপন নথিতে প্রবেশাধিকার রয়েছে, বিশেষ করে ন্যাশনাল গার্ডে। তবে বিষয়টা হলো, তিনি কেন এমন কিছু গোপন নথিতে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন। তাঁর মতো বয়সী একজন অফিসারের এসব গোপন বিষয়ে প্রবেশাধিকার থাকার প্রয়োজনই নেই।’
সাইবার ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের একজন এয়ারম্যান হিসেবে টাশেরার কাজ হলো, বিমানবাহিনীর যেসব বৈশ্বিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক রয়েছে, তার কার্যক্রম পরিচালনায় সহযোগিতা করা।
মার্ক জাইদ বলেন, এই পদে থাকার কারণে টাশেরা যৌথ গোয়েন্দা যোগাযোগব্যবস্থায় (জেডব্লিউআইসিএস) প্রবেশাধিকার পাবেন। মার্ক জাইদের কথায়, এই জেডব্লিউআইসিএস হলো যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাবিষয়ক ‘তথ্যের সংগ্রহশালা’।
‘ফাঁস’ শব্দের খোঁজ
ফৌজদারি অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, টাশেরা তাঁর সরকারি কম্পিউটার ব্যবহার করে ৬ এপ্রিল গোয়েন্দা প্রতিবেদনের জন্য ‘ফাঁস’ শব্দটি লিখে সার্চ করেন। একই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক ডজন গোপন গোয়েন্দা নথি ফাঁস হওয়ার বিষয়টি জানাজানি হয়।
আদালতে দাখিল নথিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সে অনুসারে এমন বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে টাশেরা জাতীয় প্রতিরক্ষা–সম্পর্কিত গোপন তথ্য প্রকাশকারী ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে মার্কিন গোয়েন্দাদের মূল্যায়নসম্পর্কিত গোপন প্রতিবেদনের সন্ধান করছিলেন।’
গুপ্তচরবৃত্তি আইনে মামলা
অভিযোগে আরও দেখা গেছে, টাশেরার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার কিছুটা আনা হয়েছে গুপ্তচরবৃত্তি আইনের অধীনে।
আরও নির্দিষ্ট করে বললে, প্রথম যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাতে দোষী সাব্যস্ত হলে টাশেরার জরিমানাসহ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। আর অভিযোগটি হলো এমন ব্যক্তিদের জন্য, যাঁরা সরকারের বিভিন্ন নথি হস্তগত, অনুলিপি তৈরি, অনুলিপি তৈরির চেষ্টা করেন—তাঁদের বিরুদ্ধে আনা হয়ে থাকে।
সংবিধিতে আরও বলা হয়েছে, এসব নথি যেকোনো দেশ নিজেদের ফায়দা তোলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঘাত করার জন্য ব্যবহার করতে পারে।