ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ ঘিরে ‘অনিশ্চয়তায়’ বাকি বিশ্ব

ডোনাল্ড ট্রাম্পফাইল ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে জানুয়ারিতে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারে শত্রু-মিত্র উভয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন বদলে দেওয়ার কথা বলেছিলেন সদ্য বিজয়ী রিপাবলিকান পার্টির এই প্রার্থী। অঙ্গীকার করেছিলেন ইউক্রেন যুদ্ধ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধের, বিদেশি পণ্যের ওপর শুল্কারোপ এবং লাখো অবৈধ অভিবাসীকে প্রত্যাবাসনের। ফলে সাবেক এই প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় মেয়াদ নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছে বাকি বিশ্ব।

ট্রাম্পের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর বিশ্ব এখন তাঁর আরেক মেয়াদে চার বছরের অনিশ্চয়তা এবং ‘আগে আমেরিকা (আমেরিকা ফার্স্ট)’ বাণিজ্য সুরক্ষানীতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটি বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান রীতিনীতি পাল্টে দিতে পারে, ক্ষমতা বাড়াতে পারে একনায়কদের আর গণতান্ত্রিক সহযোগীদের আমেরিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা মুছে দিতে পারে।

নির্বাচনী প্রচারে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য বিতর্ক না হলেও এ নিয়ে কয়েকবার বক্তব্য দিয়েছেন ট্রাম্প। এসব বক্তব্য যদি নীতিতে (পলিসি) পরিণত হয়, তাহলে এটি শত্রু-মিত্র উভয়ের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের ধরন বদলে দিতে পারে।

নির্বাচনে জিতলে ইউক্রেন যুদ্ধ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেছিলেন ট্রাম্প। তাঁর এই অঙ্গীকার ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের দিয়ে আসা সহায়তা প্রত্যাহারের শামিল বলে মনে করছেন অনেকে। এটি আদতে রাশিয়াকেই সুবিধা দেবে।

আরও বড় পরিসরে বলতে গেলে, রিপাবলিকান এই নেতা স্পষ্ট করেছেন, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটিকে আরও ‘একলা চলো’ নীতির দিকে নিতে চান। পাশাপাশি শুল্কারোপের নীতি বাণিজ্যযুদ্ধের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকতে পারে। নিজেদের নিরাপত্তা অংশীদারদের কাছ থেকে আরও বেশি অর্থ চাইতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জে যুক্তরাষ্ট্রকে কম যুক্ত করতে ইচ্ছুক।

অনেকে মনে করছেন, ট্রাম্পের এই নীতির প্রভাব স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর পর দেখা যাওয়া যেকোনো কিছুর চেয়ে সুদূরপ্রসারী হবে। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক জেমস কারেন বলেন, ইতিমধ্যে আমেরিকার নিজেকে অগ্রাধিকার দেওয়ার যে প্রবল প্রবণতা, এ নীতি সেটিকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ দেখার পর বিশ্ব ইতিমধ্যে জেনে গেছে, তাঁর সঙ্গে একমাত্র নিশ্চিত যে বিষয়টি যায়, সেটি হলো অনিশ্চয়তা। আরেক মেয়াদে নির্বাচিত ট্রাম্প প্রায়ই বলে থাকেন, বিশ্বকে ধোঁয়াশায় রাখাটাই তাঁর আদর্শ পররাষ্ট্রনীতি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গণনার সময়ই এশিয়া থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর কর্মকর্তারা জনগণকে আবার আশ্বস্ত করতে থাকেন। তাঁরা জোর দিয়ে বলেন, যেসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক, সেগুলো সম্ভবত পরিবর্তন হচ্ছে না।

মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শেইনবাউম চলতি সপ্তাহে বলেছেন, অভিবাসন ও মাদক পাচার মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর দেশ ‘সুসম্পর্ক’ বজায় থাকবে। এর কয়েক দিন আগেই মেক্সিকো থেকে আমদানি পণ্যের ওপর ২৫ থেকে ১০০ শতাংশ শুল্কারোপের হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প।

ভারত আগ্রহ নিয়ে এবং তেমন কোনো দুশ্চিন্তা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ওপর নজর রেখেছিল। দেশটির বিশ্বাস, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এবং পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে চীনের পাল্টা হিসেবে তাদের অবস্থান নতুন মার্কিন প্রশাসনের বিবেচনায় থাকবে।

ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে বিদেশি পণ্যের ওপর আকাশচুম্বী শুল্কারোপ, গণহারে অভিবাসী প্রত্যাবাসন, যুদ্ধের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান এবং মিত্রদের ওপর ব্যয় চাপানো নিয়ে অতিমাত্রায় জোর দেওয়ার ফলে ইতিমধ্যে অনেক দেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

চীনের অর্থনীতিতেও অস্থিরতা চলছে। দেশটি সম্ভবত আরও বৃহৎ পরিসরে এবং উচ্চ হারের শুল্কারোপের মুখে পড়তে যাচ্ছে, যা ট্রাম্পের আগের মেয়াদে আরোপ করা হয়েছিল এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময়ও অব্যাহত ছিল।

বেইজিংয়ের রেনমিন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শি ইনহং বলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বৈশ্বিক আস্থা ও সম্মান অনিবার্যভাবে কমাবে।

দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে থাকা মার্কিন সেনাদের জন্য দেশ দুটিকে আরও অর্থ গুনতে চাপ দেওয়া হতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়াকে বছরে এক হাজার কোটি ডলার দিতে বাধ্য করার অঙ্গীকার করেছিলেন ট্রাম্প। বর্তমানে দেশটি ১০০ কোটি ডলারের কম দিয়ে থাকে।

এশিয়ার কয়েকজন কূটনীতিক বলেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে চীন আগ্রাসন না চালালেও তাইওয়ানের ওপর চাপ আরও তীব্র করবে বলে তাঁরা ধারণা করছেন। তাঁদের মতে, গণতন্ত্রের জন্য ট্রাম্প যুদ্ধে জড়াবেন না—বিষয়টি হিসাব-নিকাশে রাখতে পারে চীন। স্বশাসিত দ্বীপরাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রোচিপ–শিল্প ‘চুরির’ও অভিযোগ করে আসছেন ট্রাম্প।

ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, সামরিক জোট ন্যাটোর সামষ্টিক প্রতিরক্ষাসম্পর্কিত অনুচ্ছেদ তিনি মেনে চলবেন না। সামষ্টিক প্রতিরক্ষার এই অনুচ্ছেদ কয়েক দশক ধরে ইউরোপকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক রেখেছে। নির্বাচনী প্রচারের একপর্যায়ে তিনি এমনও বলেছিলেন, জোটের প্রতি পর্যাপ্ত তহবিলের জোগান যেসব সদস্যদেশ দেবে না, সেসব দেশের প্রতি যা ইচ্ছা করার জন্য তিনি রাশিয়াকে ‘উৎসাহ দেবেন’।

বাংলাদেশের কক্সবাজারের শরণার্থীশিবিরে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। অভিবাসীদের প্রতি ট্রাম্পের বিদ্বেষ এবং সবার ক্ষেত্রে তার কী প্রভাব পড়তে পারে, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁরা। রোহিঙ্গা শরণার্থী ইউসুফ আবদুল রহমান (২৬) বলেন, ট্রাম্পের অভিবাসীবিরোধী জাতীয়তাবাদী মনোভাব তাঁকে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি বলেন, লোকজনকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে জনপ্রিয়তা পেতে পছন্দ করেন ট্রাম্প। ‘আপনারা আর অন্যরা’ এভাবে বলে থাকেন ট্রাম্প, যা বিদ্বেষ ছড়ায়।

তবে কিছু দেশ ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে একটি হলো ইসরায়েল। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার আগেই ইসরায়েলের উগ্রপন্থীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে থাকেন। তাঁদের মতে, ফিলিস্তিনের গাজায় এবং ইরানের ছায়াগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধের যেকোনো প্রচেষ্টা ঠেকাতে ট্রাম্পকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পক্ষে থাকতে রাজি করানো যাবে।

যুদ্ধে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের নিন্দা জানিয়ে আসছেন ফিলিস্তিনিরা। নতুন মার্কিন প্রশাসনের ক্ষেত্রে সেটি কেমন হতে পারে, তা নিয়ে আশা ও শঙ্কা দুটিই প্রকাশ করছেন তাঁরা। লেবানন ও অন্য আরব প্রতিবেশীরাও ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদকে সতর্কতার সঙ্গেই স্বাগত জানাবে বলে মনে করা হচ্ছে।