ষড়যন্ত্রতত্ত্ব, হুমকি ও হামলা: মার্কিন নির্বাচনের নতুন বাস্তবতা
সিন্ডি এলগান একজন নির্বাচনী কর্মকর্তা। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যের এক কোণে ছোট একটি কেন্দ্রে দুই দশক ধরে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। দীর্ঘ এতটা সময়ে তাঁর ওপর প্রতিবেশী ভোটারদের আস্থার কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু দৃশ্য পাল্টে গেছে। এখন সেই প্রতিবেশীরাই মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘জয় কেড়ে নেওয়ার’ ষড়যন্ত্রের তিনিও একটি অংশ।
২০২০ সালে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে নেভাদার এসমেরালদা কাউন্টিতে গণনা করা ভোটের ৮২ শতাংশ পেয়েছিল ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি। যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কাউন্টিতে খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষের বসবাস, এটি সেসবের একটি।
এলগানের ওপর একসময় আস্থা থাকা প্রতিবেশীদের একজন মেরি জেইন জাকাস। অবসরপ্রাপ্ত এই স্কুলশিক্ষক বলছিলেন, ‘২০২০ সালের নির্বাচনী ফলাফল আমি বিশ্বাস করি না।’
রক্ষণশীলদের (রিপাবলিকান পার্টি) তরফে মাঝেমধ্যেই সামনে আনা এক ষড়যন্ত্রতত্ত্বের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মেরি জেইন বলেন, ‘সমস্যা হলো, ভোট গননার ক্ষেত্রে ব্যালট পেপারের পরিবর্তে ভোটিং মেশিনের ব্যবহার।’
মেরি জেইন বলেন, মাইক লিনডেল (মার্কিন ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও ষড়যন্ত্রতাত্ত্বিক) চিহ্নিত করেছেন, জালিয়াতির অনেক পন্থা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনে বিভিন্ন গাণিতিক ফর্মুলা রয়েছে, যা আপনার ভোট উল্টে দিতে পারে।’
নির্বাচনে বিভিন্ন গাণিতিক ফর্মুলা রয়েছে, যা আপনার ভোট উল্টে দিতে পারে।
এসমেরালদা কাউন্টির নিবন্ধিত ৬০০ ভোটারের প্রায় সবাইকে দেখে চেনেন সিন্ডি এলগান। তিনি বলেন, অতীতে সব সময়ই এই কমিউনিটির সদস্যরা নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে দৃশ্যত সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প যখন ২০২০ সালের নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে হেরে যাওয়া প্রত্যাখ্যান করলেন, তখন থেকেই তাঁদের মধ্যে শুরু হলো তিক্ততা।
গোল্ডফিল্ডে নিজ অফিসে বসে এই নির্বাচনী কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, ‘কিছু লোক আছেন, যাঁরা এ বিষয়ে (নির্বাচন নিয়ে) অতি আবেগপ্রবণ এবং দেশ নিয়ে তাঁদের আবেগপ্রবণ হওয়াকে আমি দোষ দিতে পারি না। কিন্তু তাঁরা এমন কিছু করছেন, যা প্রকাশ করুন বা না করুন, সেসবের সঙ্গে আমি একমত না-ও হতে পারি।’
‘এটি নির্বাচনের ক্ষতি করছে’
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, মার্কিনদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনব্যবস্থার সুসংহত অবস্থা নিয়ে সন্দিহান।
গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘ইস্যু ওয়ান’-এর ক্লেয়ার উডাল বলেন, মার্কিন নির্বাচনব্যবস্থায় আস্থাহীনতা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে ট্রাম্পের অস্বীকৃতি আস্থাকে একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে।
এ নিয়ে (নির্বাচনী প্রক্রিয়া) জাতীয় পর্যায়ে হইচই হওয়ার বাইরে গোল্ডফিল্ডের মতো ছোট ছোট কমিউনিটিতেও যেভাবে প্রশ্ন উঠছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মন্তব্য করেন ক্লেয়ার উডাল। তিনি বলেন, হুমকি, হয়রানি ও হামলার শিকার হয়ে অনেক নির্বাচনী কর্মকর্তা তাঁদের দায়িত্ব থেকে সরে গেছেন।
ক্লেয়ার উডাল বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উঠতে দেখছি, বিশেষ করে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে।’
এ নিয়ে (নির্বাচনী প্রক্রিয়া) জাতীয় পর্যায়ে হইচই হওয়ার বাইরে গোল্ডফিল্ডের মতো ছোট ছোট কমিউনিটিতেও যেভাবে প্রশ্ন উঠছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মন্তব্য করেন ক্লেয়ার উডাল। তিনি বলেন, হুমকি, হয়রানি ও হামলার শিকার হয়ে অনেক নির্বাচনী কর্মকর্তা তাঁদের দায়িত্ব থেকে সরে গেছেন।
হুমকি, হয়রানি ও হামলায় দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার এমন প্রবণতা স্থানীয় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের মধ্যেই বেশি, বিশেষ করে অ্যারিজোনার মতো অঙ্গরাজ্যগুলোতে। এসব অঙ্গরাজ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে সচরাচর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়ে থাকে। যেমন ইস্যু ওয়ানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অ্যারিজোনায় গত নির্বাচনে মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট ও নেভাদায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ পয়েন্টে ট্রাম্পকে হারিয়ে জয়ী হন বাইডেন।
নেভাদার পশ্চিমে ডগলাস কাউন্টিতে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেন অ্যামি বার্গানস। এই কাউন্টিতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। তিনি বলেন, ‘চার বছর ধরে এখানে আমিই শুধু এই পদে কাজ করছি। অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ নির্বাচনী কর্মকর্তাদের একজন আমি।’
মার্কিন নির্বাচনব্যবস্থায় আস্থাহীনতা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে ট্রাম্পের অস্বীকৃতি আস্থাকে একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে।
বার্গানস ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির একজন সমর্থক। নির্বাচন নিয়ে বর্তমান বাস্তবতায় হতাশ তিনি। তিনি বলেন, নির্বাচনব্যবস্থার শুদ্ধতা বিষয়ে অপতথ্যের বেশির ভাগ আসছে তাঁর দলের ভেতর থেকেই। এসব মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রের কারণে দায়িত্ব পালন করা থেকে সরে যাচ্ছেন সৎ কর্মকর্তারা।
বার্গানস বলেন, ‘(দায়িত্ব পালন থেকে সরে যাওয়ায়) নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান আমরা হারাচ্ছি, যা তাঁরা বছরের পর বছর ধরে অর্জন করেছেন। এটি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আরও নিরাপদ করতে সহায়তা করছে না। এটি নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’
নির্বাচনী কর্মকর্তাদের হুমকি
নেভাদার সাবেক কয়েক নির্বাচনী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এএফপি। তবে তাঁরা নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এমনই একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি আমার পরিবারকে (নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কায়) আবার প্রকাশ্যে আনতে চাই না।’
হুমকি ও হামলার কারণে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা স্থানীয় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের মধ্যেই বেশি, বিশেষ করে অ্যারিজোনার মতো অঙ্গরাজ্যগুলোতে। এসব অঙ্গরাজ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে সচরাচর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়ে থাকে। যেমন ইস্যু ওয়ানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অ্যারিজোনায় গত নির্বাচনে মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট ও নেভাদায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ পয়েন্টে ট্রাম্পকে হারিয়ে জয়ী হন বাইডেন।
নির্দলীয় ‘ইলেকশনস অ্যান্ড ভোটিং ইনফরমেশন সেন্টার’-এর এক জরিপ অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের এক-চতুর্থাংশ হয় নির্যাতন, নয় হুমকির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
বার্গানস এই নির্বাচনী কর্মকর্তাদের একজন ছিলেন। ২০২২ সালে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিষয়ে ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইলেকশন অফিশিয়ালস’-এর কর্মকর্তা ট্যামি প্যাট্রিক বলেন, উত্তেজনা বাড়তে থাকায় এখন এমন সব নিরাপত্তা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যা আগে কখনো শোনা যায়নি; যেমন বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও নজরদারি ক্যামেরার ব্যবহার, এমনকি ভোটকেন্দ্রের কাছে বিভিন্ন ভবনে স্নাইপার মোতায়েন। কাজে লাগানো হচ্ছে প্রশিক্ষিত কুকুরও।
বার্গানস বলেন, তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা এখন নারকান নামের ওষুধ সঙ্গে রাখেন, যাতে বিষ মেশানো ব্যালটের ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারেন।