বিতর্কে কমলা জিতেছেন, নাকি ট্রাম্পই তাঁকে জিতিয়ে দিয়েছেন

কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে মঙ্গলবার সরাসরি বিতর্ক হয়ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান দুই প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মুখোমুখি বিতর্কে কে জিতেছেন, তা নিয়ে কয়েকটি অনানুষ্ঠানিক জনমত জরিপের ফল প্রকাশ হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও এ নিয়ে নিজেদের মত দিচ্ছেন। জনমত জরিপ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বেশির ভাগেরই রায় হলো, বিতর্কে কমলাই জিতেছেন।

বিতর্কে দর্শকদের ওপর সিএনএন পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, কমলা হ্যারিস জয়ী হয়েছেন। ৬৩ শতাংশ মানুষ তাঁকে জয়ী বলে মনে করছেন। আর ট্রাম্পকে জয়ী মনে করছেন ৩৭ শতাংশ মানুষ।

নিবন্ধিত ভোটারদের ওপর ইউগভ পরিচালিত অপর এক জরিপেও দেখা গেছে, বেশির ভাগ মানুষ কমলা হ্যারিসকে জয়ী বলে মত দিয়েছেন। এমনকি রক্ষণশীলদের টিভি নেটওয়ার্ক ফক্স নিউজের বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন যে ট্রাম্পকে পরাজিত করেছেন কমলা।

বিতর্কের পর সিদ্ধান্তহীনতায় থাকা ভোটারদের নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো জরিপের ফল এখনো প্রকাশ হয়নি। জরিপের ফল প্রকাশ হতে কয়েক দিন লেগে যেতে পারে। আর প্রার্থীরা কে কেমন করলেন, তার ওপর ভিত্তি করে ভোটারদের অনেকে তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলবেন কিনা, তা নিশ্চিত নয়।

তবে কমলা হ্যারিস কি আসলেই জিতেছেন, নাকি ট্রাম্পের দুর্বলতাই তাকে বিজয়ী করে তুলেছে?

এ ব্যাপারে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে আল জাজিরা। তাঁরা বিতর্ক, রাজনৈতিক বক্তব্য, মনস্তত্ত্ব এবং যোগাযোগসংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন ট্রাম্পের দুর্বল জায়গাগুলোতে খোঁচা দিয়ে সাফল্য পেয়েছেন কমলা হ্যারিস। আবার কেউ কেউ বলছেন, ট্রাম্পকে বিচলিত করে দেওয়ার কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন কমলা। আর তা করতে গিয়ে তিনি ভোটারদের নিজের নীতিমালা কী হবে, সে সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলতে পারেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের হফসট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টোমেকা এম রবিনসন বলেন, তিনি (কমলা) বিতর্কে জিতেছেন এবং এমনি এমনিই যে জিতে গেছেন এমনটা নয়।

ট্রাম্প সম্পর্কে রবিনসনের মত হলো, রিপাবলিকান এ নেতা বিভিন্ন বিষয়ে নিজের অবস্থানে অটল থাকতে পারেননি। তিনি মনে করেন, অবৈধ অভিবাসী এবং প্রজননবিষয়ক (গর্ভপাতের অধিকার) একই ধরনের আক্রমণাত্মক বক্তব্য না দিয়ে ট্রাম্পের উচিত ছিল প্রেসিডেন্ট হলে তাঁর নীতিমালা কী হবে, তা নিয়ে বলা।

বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যমবিষয়ক অধ্যাপক ট্যামি আর ভিজিলও বলেছেন, ট্রাম্পের দুর্বলতাগুলোকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন কমলা। তবে তিনি তাঁর নীতিমালাসংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলো সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।

ভিজিল আল জাজিরাকে বলেন, ‘হ্যারিস বিতর্কে জিতেছেন। কারণ, তিনি ভালো করেই জানতেন যে ঠিক কোন জায়গায় খোঁচা দিলে ট্রাম্প তাঁর চিরাচরিত রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করবেন। তিনি যা বলেন, তা খুব কম সময়েই সত্য হয়। তিনি চান কথাগুলোকে দর্শকেরা আবেগ দিয়ে বিবেচনা করুক, যুক্তি দিয়ে নয়। মঙ্গলবার রাতেও তিনি একই কাজ করেছেন।’

বিতর্কের মঞ্চে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস
ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং অসংলগ্ন ছিলেন ট্রাম্প

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ আবার আগের বিতর্কে ট্রাম্পের আচরণের সঙ্গে গত মঙ্গলবার রাতের বিতর্কে তাঁর আচরণের তুলনা করছেন। আগের বিতর্কে ট্রাম্পের মুখোমুখি হয়েছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে ট্রাম্পের কাছে বিতর্কে ধরাশায়ী হওয়ার পর বাইডেন তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নিক বিউচ্যাম্প আল জাজিরাকে বলেন, প্রথম বিতর্কে বাইডেন নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছিলেন।  ট্রাম্প ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করে, শান্ত থেকে এবং বেশির ভাগ সময় নিজের বার্তা দেওয়ার মধ্য দিয়ে কাজটি আরও সহজ করে তুলেছিলেন। অপর দিকে কমলা-ট্রাম্প বিতর্কে কমলা একনাগাড়ে ট্রাম্পকে খোঁচা দিচ্ছিলেন, বিদ্রূপ করছিলেন এবং ছোটখাটো অপমান করে যাচ্ছিলেন। আর এতে ট্রাম্প কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তিনি ক্রমাগত রেগে যেতে থাকেন এবং অসংলগ্ন আলোচনা করতে থাকেন।

কমলা সম্পর্কে বিউচ্যাম্প বলেন, তিনি (কমলা) নিজের সম্পর্কে, নিজের মূল্যবোধ সম্পর্কে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি। বরং তিনি ট্রাম্পকে বেসামাল করে দেওয়ার চেষ্টাতেই ব্যস্ত ছিলেন।

মিথ্যা নিয়ে ট্রাম্পের কিছু আসে যায় না

সত্যতা যাচাই–সংক্রান্ত সংস্থাগুলো ট্রাম্পকে ভুল প্রমাণের মতো অনেক তথ্য পেলেও বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, বিতর্কে কে জিতেছেন, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কারণ, সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ভুল এবং অযৌক্তিক সব দাবি করেন, তা নতুন কিছু নয়, তা অনেক আগেই প্রমাণিত। বরং তাঁর এসব কথাবার্তার কারণে অন্য অন্য রাজনীতিকদের ক্যারিয়ার নষ্ট হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুই প্রার্থীর কাছ থেকে দুই ধরনের আচরণ যখন আশা করা হয়, তখন বিতর্কের ফলাফল নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে যায়।

উইলিয়ামস কলেজের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক স্টিভেন ফেইন বলেন, যখন একজন প্রার্থীর কাছ থেকে সত্য কথা শোনার প্রত্যাশাই করা হয় না, আবার অন্য প্রার্থীর কাছ থেকে নীতিমালা বিষয়ে স্পষ্টবাদী হওয়ার মতো প্রচলিত মানদণ্ড পূরণের আশা করা হয়, তখন একটি বিতর্ককে বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করা সহজ নয়।

মঙ্গলবার রাতে কমলার বিরুদ্ধে ট্রাম্প যেসব মিথ্যা কথা বলেছেন, সেগুলো উল্লেখ করে ফেইন বলেন, ‘সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা মানুষেরা বলেন, তারা দুই প্রার্থীর মধ্যে ভিন্নতা দেখেন না। কারণ, হ্যারিস তাঁর নীতিমালা নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। এটা আপেলকে কমলার সঙ্গে তুলনা না করে ওয়াশিং মেশিনের সঙ্গে তুলনা করার মতো হয়ে যায়।’