হ্যারি-মেগানের ভয়ংকর সেই রাত, ‘অবিশ্বাস্য’ বলছেন মেয়র
বিবৃতিটা খুবই উদ্বেগজনক ছিল। ঠিক যেন ২৬ বছর আগে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। গত বুধবার প্রিন্স হ্যারির একজন মুখপাত্র এ বিবৃতি দেন। এতে জানানো হয়, গত মঙ্গলবার রাতে নিউইয়র্কের রাস্তায় হ্যারি ও তাঁর স্ত্রী মেগান মার্কেলকে বহন করা গাড়ির পিছু নিয়েছিলেন একদল পাপারাজ্জি। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বেপরোয়াভাবে তাঁদের অনুসরণ করেন তাঁরা। এতে হ্যারি-মেগান ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হতে গিয়েছিলেন।
২৬ বছর আগে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল হ্যারির মা প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গেও। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের রাস্তায় ডায়ানার গাড়ি তাড়া করে বেপরোয়া পাপারাজ্জিরা। ওই সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ যায় জনপ্রিয় ডায়ানার। এর ২৬ বছর পর এসে একই ঘটনা যেন তাড়া করেছিল ডায়ানার ছোট ছেলে হ্যারি ও তাঁর স্ত্রী মেগানকে।
পরদিন (গত বুধবার) সকালে হ্যারি-মেগানের এ ঘটনার খবর বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাটি নিয়ে সংবাদমাধ্যম আগ্রহী হয়ে ওঠে। সিএনএন, স্কাই নিউজসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম মিনিটে মিনিটে এ ঘটনার হালনাগাদ খবর প্রচার করে। হ্যারি-মেগানের নিরাপত্তা দলের একজন সদস্য বলেন, ‘এর পরিণতি মারাত্মক হতে পারত।’ তবে নিউইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামস বলছেন, তিনি ঘটনাটি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না।
গাড়িতে ওঠার পর থেকে হ্যারি ও মেগানকে ভীষণ ভীত মনে হচ্ছিল। তবে অপর নারী (ডোরিয়া রাগল্যান্ড) তুলনামূলক শান্ত ছিলেন।
নিউইয়র্ক পুলিশের পক্ষ থেকে ওই দিনই (বুধবার) এ ঘটনার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। সংবাদমাধ্যমে কথা বলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক ক্যাবচালক। এসব বয়ান সামনে আসায় ঘটনাটির ভয়াবহতা আরও প্রকট হয়ে ধরা দেয়।
ডিউক অব সাসেক্স এবং ডাচেস অব সাসেক্স হ্যারি ও মেগান দম্পতির তুমুল জনপ্রিয়তা। তাঁদের সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহে সংবাদমাধ্যমগুলোর অন্তহীন আকাঙ্ক্ষা, রাজপরিবারের সঙ্গে হ্যারি-মেগানের শীতল সম্পর্ক, পাপারাজ্জিদের ক্যামেরা এড়িয়ে চলতে তাঁদের সতর্ক প্রচেষ্টা—এমন নানা ঘটনার ভিড়ে গত মঙ্গলবার রাতে নিউইয়র্কের রাস্তায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটি আলাদা করে গুরুত্ব পেয়েছে। কেননা, এর সঙ্গে ১৯৯৭ সালে প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়ানার মৃত্যুর আগে প্যারিসের রাস্তায় ঘটা ঘটনার অদ্ভুত মিল রয়েছে।
হ্যারি, মেগান ও পাপারাজ্জি
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হ্যারি ও মেগান নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের মিডটাউনের জিগফেল্ড বলরুমে উইমেন অব ভিশন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মেগানের মা ডোরিয়া রাগল্যান্ড। ওই অনুষ্ঠানে মেগানকে বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়। রাত ১০টার কিছু আগে তাঁরা তিনজন অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেরিয়ে আসেন। গন্তব্য ছিল আপার ইস্ট সাইড। এবারের নিউইয়র্ক সফরে সেখানেই অবস্থান করেছেন তাঁরা।
হ্যারি ও মেগান দম্পতিকে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বেপরোয়াভাবে অনুসরণ করা হয়েছে, এ কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। কেননা, নিউইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তায় ১০ মিনিটের এমন কর্মকাণ্ড অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে।
অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে জড়ো হওয়া পাপারাজ্জিরা তাড়া করতে পারেন—এমন উদ্বেগে আগে থেকেই ভুগছিলেন হ্যারি ও মেগান। এ কারণে তাঁরা বিশেষ নিরাপত্তাসংবলিত ব্যক্তিগত গাড়িতে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন।
যদিও ওই সময় হ্যারি-মেগানের সঙ্গে পুলিশের নিরাপত্তা দল ছিল বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা বলেন, ঘণ্টাখানেক হ্যারি, মেগান ও ডোরিয়া রাগল্যান্ড তাঁদের নিজেদের গাড়িতে ছিলেন। কিন্তু পাপারাজ্জিদের দৃষ্টি এড়াতে পারেননি। পাপারাজ্জিরা পুরোটা সময় তাঁদের তাড়া করেন।
পুলিশ তাঁদের আপার ইস্ট সাইডের ১৯তম পুলিশ প্রিসেন্টে (পুলিশ স্টেশন) নিয়ে যান। এ সময় নিজেদের গাড়ি বদলে ফেলেন তাঁরা। সেখানে একটি ক্যাব ডেকে তাঁকে হ্যারি, মেগান ও ডোরিয়া রাগল্যান্ডকে তুলে দেওয়া হয়। ওই ক্যাবের চালক ছিলেন সুখচরণ সিং। হ্যারি-মেগান মিনিট দশেক তাঁর ক্যাবে ছিলেন।
সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে হ্যারি-মেগানের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। হ্যারি বরাবরই তাঁর মা প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর জন্য পাপারাজ্জিদের দায়ী করেন। এমনকি হ্যারি এর আগে বলেছেন, তাঁর স্ত্রী মেগানের প্রতি ট্যাবলয়েডগুলো হয়রানিমূলক আচরণ করছে। এসব আচরণ তাঁকে তাঁর মায়ের অভিজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দেয়।
সেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে সুখচরণ সিং বলেন, পিছু নেওয়া পাপারাজ্জিদের হাত থেকে বাঁচতে হ্যারি-মেগান তাঁর গাড়িতে উঠেছিলেন। একটি ময়লার গাড়ির কারণে ক্যাবটি সড়কে আটকে যায়। হঠাৎ পাপারাজ্জিরা এসে একের পর এক ছবি তুলতে শুরু করেন। এ সময় পেছনের আসন থেকে এক নারী কণ্ঠে ‘ওহ, আমার ঈশ্বর’ বলতে শোনেন সুখচরণ সিং। তবে কথাটি কে বলেছিলেন, তা তিনি বুঝতে পারেননি।
সুখচরণ সিং আরও বলেন, ‘হ্যারি ও মেগান কোথায় যাবেন, তা বলার আগেই নিরাপত্তাকর্মী আবার পুলিশ স্টেশনের দিকে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন।’ তিনি বলেন, ‘গাড়িতে ওঠার পর থেকে হ্যারি ও মেগানকে ভীষণ ভীত মনে হচ্ছিল। তবে অপর নারী (ডোরিয়া রাগল্যান্ড) তুলনামূলক শান্ত ছিলেন।’
সুখচরণ সিং জানান, পাঁচ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ট্রাকটি তাঁদের পথ থেকে সরে যায়। তিনি গাড়ি চালাতে শুরু করেন। তখনো পাপারাজ্জিদের অন্তত দুটি গাড়ি তাঁদের গাড়ি অনুসরণ করছিল। হ্যারি ও মেগানের নিরাপত্তাকর্মী যখন এটা বুঝতে পারেন, তখন তিনি তাঁকে পুলিশ স্টেশনের দিকে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। তিনি তাঁদের সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ততক্ষণে ঘড়িতে রাত সাড়ে ১১টা বেজে গেছে।
পুলিশ স্টেশনে ফিরে হ্যারি, মেগান ও ডোরিয়া রাগল্যান্ড তাঁদের ব্যক্তিগত কালো রঙের এসইউভি গাড়িতে চড়েন। এ গাড়িতে চড়ে তাঁরা অনুষ্ঠানস্থল থেকে পুলিশ স্টেশন অবধি এসেছিলেন। সেই সময় পুলিশ পুরো এলাকার গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। কিছু সময় হ্যারি, মেগান ও ডোরিয়া রাগল্যান্ড পুলিশ স্টেশনে অপেক্ষা করেন। পরে তাঁদের নিজেদের গাড়িতে চড়িয়ে পুলিশি পাহারায় গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়।
নিউইয়র্ক পুলিশের মুখপাত্র জুলিয়ান ফিলিপস এক বিবৃতিতে জানান, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্ক পুলিশ হ্যারি ও মেগান দম্পতির নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তা করেছে। তবে এ ঘটনাকে ‘ধাওয়া’ বা ‘তাড়া’ বলে উল্লেখ করেনি পুলিশ। বলা হয়েছে, কিছু আলোকচিত্রী ডিউক ও ডাচেস অব সাসেক্সের চলার পথকে ‘চ্যালেঞ্জিং’ করে তুলেছিল। তবে তাঁরা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। এ সময় সংঘর্ষ, হতাহত কিংবা গ্রেপ্তারের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না মেয়র
বুধবার সকালে পূর্বনির্ধারিত একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন নিউইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামস। এ সময় তাঁর কাছে আগের রাতের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। মেয়র এরিক বলেন, এটা কিছুটা বেপরোয়া এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হয়েছে। যদিও তিনি বলেন, এখনো তাঁকে পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি।
মেয়র এরিক অ্যাডামস বলেন, ‘হ্যারি ও মেগান দম্পতিকে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বেপরোয়াভাবে অনুসরণ করা হয়েছে, এই কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। কেননা, নিউইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তায় ১০ মিনিটের এমন কর্মকাণ্ড অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে।’
এ সময় প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানাকে স্মরণ করেন এরিক অ্যাডামস। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, তাঁর মা (ডায়ানা) কীভাবে মারা গেছেন, সেটা এখন আমাদের মধ্যে অনেকেই আর স্মরণ করেন না।’
নিউইয়র্কের রাস্তায় হ্যারি ও মেগান দম্পতির সঙ্গে ঘটে যাওয়া এ ঘটনায় তাঁর বাবা যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লসের আবাসস্থল বাকিংহাম প্যালেস কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এমনকি হ্যারির বড় ভাই প্রিন্স উইলিয়ামের আবাসস্থল কেসিংটন প্যালেস কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতো নীরব রয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে হ্যারি-মেগানের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। হ্যারি বরাবরই তাঁর মা প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর জন্য পাপারাজ্জিদের দায়ী করেন। এমনকি হ্যারি এর আগে বলেছেন, তাঁর স্ত্রী মেগানের প্রতি ট্যাবলয়েডগুলো হয়রানিমূলক আচরণ করছে। এসব আচরণ তাঁকে তাঁর মায়ের অভিজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দেয়।
শুধু অসন্তোষ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হননি হ্যারি। বরং সাম্প্রতিক অতীতে তিনি ও মেগান কয়েকটি ব্রিটিশ সংবাদপত্র ও ট্যাবলয়েডের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নিয়েছেন। হ্যারি অভিযোগ তুলেছেন, খবরের আশায় এসব সংবাদমাধ্যম তাঁর মুঠোফোন হ্যাক করেছে। তাঁদের বিভিন্ন গোপন বিষয়ে অনৈতিক অনুপ্রবেশ করেছে।
হ্যারির মতে, সংবাদমাধ্যমের এসব কর্মকাণ্ড তাঁর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। কেননা, ২০২০ সালে রাজদায়িত্ব ত্যাগ করা ও যুক্তরাজ্য ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়ার পর থেকে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা আর ব্রিটিশ পুলিশের নিরাপত্তা পান না। তাই তাঁরা যখন যুক্তরাজ্যে যান, তখন তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়ে যায়।
এ কারণে যুক্তরাজ্য সফরকালে তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য পুলিশকে অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন হ্যারি। তবে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে মেট্রোপলিটন পুলিশ। অন্যদিকে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনজীবীদের যুক্তি, ধনী ব্যক্তিদের পুলিশি সুরক্ষা ‘কেনার’ অনুমতি দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হবে না।
হ্যারি মেগানকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ
তবে রাজপরিবার, হ্যারি-মেগানের প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ কখনোই কমেনি। এমনকি হ্যারি-মেগানের প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ও দেশটির দর্শকদের তুমুল আগ্রহ রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তথ্য বিশ্লেষণকারী বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান নিয়েলসেনের একটি পরিসংখ্যানের কথা উল্লেখ করা যায়। ২০১৮ সালে উইন্ডসর ক্যাসেলে হ্যারি-মেগানের বিয়ের রাজকীয় আসর বসেছিল। ওই আয়োজন টিভিতে সরাসরি দেখানো হয়েছিল।
এ বিষয়ে নিয়েলসেন বলছে, টিভিতে ১ কোটি ৮০ লাখ ব্রিটিশ ওই আয়োজন দেখেছিলেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বসে হ্যারি-মেগানের বিয়ের অনুষ্ঠান দেখেন ২ কোটি ৯০ লাখ মানুষ। এমনকি ২০১১ সালে রাজা চার্লসের বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম ও কেট মিডলটনের বিয়ের রাজকীয় আয়োজনের চেয়ে হ্যারি ও মেগানের বিয়ের অনুষ্ঠান টিভির পর্দায় বেশিসংখ্যক মার্কিন দেখেছেন।
* সংক্ষেপিত অনুবাদ