মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: ‘এক্স ফ্যাক্টর’ মুসলিম ও ইহুদি ভোট

কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পফাইল ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শিবিরে সম্ভাব্য প্রতিটি ভোট দখলের তীব্র লড়াই শুরু হয়ে গেছে। সব মাথাব্যথা সাত ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ অঙ্গরাজ্য নিয়ে। এসব অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের অধিকাংশই তাঁদের মন ঠিক করে ফেলেছেন, কাকে ভোট দেবেন। যাঁরা এখনো মন ঠিক করে ওঠেননি, এমন ভোটারের সংখ্যা খুব বেশি নয়, মধ্য-অক্টোবরের হিসাব অনুসারে তা ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশের বেশি নয়। যত মনোযোগ এই হাতে গোনা কয়েক হাজার ভোট নিয়ে।

ভোট নিয়ে এই তীব্র লড়াই অবশ্য নতুন নয়। ২০১৬ ও ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল যথাক্রমে ৭৭ হাজার ও ৪৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে। কোনো কোনো ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যে মাত্র কয়েক হাজার ভোট চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করেছিল। যেমন ২০২০ সালে জো বাইডেন উইসকনসিনে মাত্র ২০ হাজার ৬৮২ ভোটে সে অঙ্গরাজ্যের ১০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়েছিলেন। জর্জিয়ায় তাঁর জয়ের মার্জিন বা পার্থক্য ছিল আরও কম, মাত্র ১১ হাজার ৭৭৯ ভোটে জিতেছিলেন। পাঠকের হয়তো মনে আছে, নির্বাচনের ফলাফলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ক্ষিপ্ত ট্রাম্প জর্জিয়ার সেক্রেটারি অব স্টেটকে ফোন করে দাবি করেছিলেন, তাঁকে যেন ১১ হাজার ৭৭৯-এর চেয়ে আর মাত্র একটা ভোট (অর্থাৎ ১১ হাজার ৭৮০) খুঁজে দেওয়া হয়।

উভয় সংকটে কমলা

দিন যতই যাচ্ছে, ততই মনে হচ্ছে এবারের ভোটের ‘এক্স ফ্যাক্টর’ হতে পারে মিশিগান ও পেনসিলভানিয়ার মুসলিম ও ইহুদি ভোট। এবারের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পাওয়ার একটি সম্ভাব্য পথ হচ্ছে এই দুই অঙ্গরাজ্য ও উইসকনসিনে কমবেশি যেমন ভোটেই হোক জয় ছিনিয়ে নেওয়া।

মুসলিম ও ইহুদি ভোট নিয়ে উভয় সংকটে রয়েছেন কমলা। ইসরায়েলের পক্ষে কথা বললে আরব-মুসলিমরা নাখোশ হচ্ছেন। অন্যদিকে ইসরায়েলের সমালোচনা ও ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলতে গেলে ইহুদি ভোটারদের অসন্তুষ্ট করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

জনমত জরিপের ওপর নির্ভর করে উইসকনসিনে কমলা খানিকটা হলেও স্বস্তিতে রয়েছেন। ফলে এই মুহূর্তে তাঁর সব নজর মিশিগান ও পেনসিলভানিয়ায়। ট্রাম্প ও কমলা উভয়েই এই দুই অঙ্গরাজ্যে অতিরিক্ত নজর দিচ্ছেন তাঁদের দুই বড় ভোটিং ব্লক মুসলিম ও ইহুদি ভোটারদের ওপর। এর আগে আমরা মিশিগানে মুসলিম ভোটের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছি। সেখানে প্রায় দুই লাখ আরব ও মুসলিম ভোটার, গাজায় অব্যাহত ইসরায়েলি হামলায় বাইডেন প্রশাসনের সমর্থনে ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদের অনেকেই কমলার পক্ষে ভোট দেবেন না বলে ভাবা হচ্ছে।

মুসলিমদের কথা আলোচিত হলেও ইহুদি ভোটের কথা নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। মিশিগানে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ইহুদি ভোটার রয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক হিসেবে তালিকাভুক্ত। গত তিনটি নির্বাচনে সারা দেশে ইহুদিদের প্রায় ৭০ শতাংশ ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এবারও কি সেই অনুপাতে ভোট দেবেন?

বাইডেন ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিলেও আরব ও মুসলিম ভোটারদের সন্তুষ্ট করতে কমলা গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করেছেন, ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সমর্থন করেছেন। অনেক ইহুদি আমেরিকানের চোখে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের সন্ত্রাসী হামলার পর ফিলিস্তিনের পক্ষে একটি কথা বলা বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। সে জন্য ইহুদিদের ব্যাপারে ডেমোক্র্যাটদের এই দ্বিধা।

তা সত্ত্বেও ইহুদি-আমেরিকানদের মতামতের যে নতুন জরিপ হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ৭১ শতাংশ ভোটার কমলা ও ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। মাত্র ২৬ শতাংশ ইহুদি বলেছেন, তাঁরা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। জুইশ ডেমোক্রেটিক কমিটি অব আমেরিকার গৃহীত এই জরিপে প্রধানত ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যগুলোর ইহুদিদের মতামত নেওয়া হয়েছে। গ্রুপটি ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত, সে কথা উল্লেখ করে ট্রাম্পের প্রচার শিবির থেকে বলা হয়েছে, জরিপটি মোটেই বস্তুনিষ্ঠ নয়। রিপাবলিকান জুইশ কোয়ালিশনের পক্ষে যে জরিপ করা হয়েছে, তাতে ইহুদি ভোটারদের অর্ধেকই জানিয়েছেন, তাঁরা ট্রাম্পের সমর্থক—এটা এই কোয়ালিশনের প্রধান নির্বাহী ম্যাট ব্রুকসের কথা।

পেনসিলভানিয়াতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আরব-মুসলিম ও ইহুদি নাগরিকের বসবাস। ট্রাম্প ও কমলা উভয়েই এই দুই গ্রুপের ভোট পেতে মরিয়া। মুসলিমদের ব্যাপারে কমলার হিসাব, ট্রাম্প খোলামেলাভাবে ইসরায়েলপন্থী। তিনি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে এনেছেন ও ওয়াশিংটনে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) অফিস বন্ধ করে দিয়েছেন। ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু সংস্থার জন্য আর্থিক অনুদানও তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রচার শিবিরের বিশ্বাস, কোনো কোনো আরব-মুসলিম হয়তো ডেমোক্রেটিক পার্টির বাক্সে ভোটদানে বিরত থাকবেন, কিন্তু ট্রাম্পকে ভোট দেবেন না। তবে এই হিসাব যে অভ্রান্ত, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।

ইহুদিদের ব্যাপারে অবশ্য কমলার প্রচার শিবির অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। কমলার স্বামী ডাগ এমহফ একজন ইহুদি, যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি-বিদ্বেষ ঠেকাতে তিনি একটি জনপ্রিয় রণকৌশল প্রণয়ন করেছেন। নিজের স্বামীকে ইহুদি ভোট শিকারে কমলা কাজে লাগাচ্ছেন। ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজগুলোতে এমহফ প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বিভিন্ন ইহুদি গ্রুপের সঙ্গে মিলিত হয়ে কমলার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এতে যে কাজ হচ্ছে, সর্বশেষ জনমত জরিপ থেকেই তা ঠাহর করা যায়।

‘ইহুদি-বিদ্বেষী’ ট্রাম্প

অবশ্য ইহুদি ভোটের ব্যাপারে কমলার পক্ষে সেরা প্রচারক ট্রাম্প নিজেই। তাঁকে অধিকাংশ ইহুদি চেনেন ‘ইহুদি-বিদ্বেষী’ হিসেবে। কথা ও কাজে তার নানা প্রমাণও তিনি দিয়েছেন। অতি সম্প্রতি এক ইহুদি সম্মেলনে অতিথি বক্তা হিসেবে এসেছিলেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি নিজের পক্ষে ইহুদি ভোটের দাবি জানিয়ে বলেন, যদি কেউ তাঁকে ভোট না দিয়ে কমলাকে ভোট দেন, তাহলে তাঁদের মাথা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এর আগে তিনি এমন কথাও বলেছেন, যেসব ইহুদি ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দেন, তাঁরা আসলে নিজেদের ধর্ম ও জাত পরিচয়কে ঘৃণা করেন।

কথাটা ইহুদি ভোটারদের ভীষণ ক্ষিপ্ত করেছে। ইহুদি সংগঠন অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগের প্রধান জনাথান গ্রিনব্লাট বলেছেন, ট্রাম্পের কথা শুধু বিদ্বেষপূর্ণই নয়, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

ট্রাম্পের কথাকে ব্যবহার করে ডেমোক্রেটিক জুইশ কাউন্সিলের তরফ থেকে ইতিমধ্যে একটি মজাদার বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, একজন ইহুদি নারী চিকিৎসকের কার্যালয়ে এসেছেন তাঁর মাথা পরীক্ষা করাতে। তাঁর অভিযোগ, এক দাগি আসামি, যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে প্রচারণা চালাচ্ছে, সে ইহুদিদের হুমকি দিচ্ছে। মাথাটা বোধ হয় সেই কারণেই গেল।