হন্ডুরাস কেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের বের করে দিতে চায়

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সদস্যফাইল ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী ছোট্ট দেশ হন্ডুরাস। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এখন নিজ দেশ থেকে মার্কিন সেনাদের বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে হন্ডুরাস সরকার। তাদের এ হুমকির কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

আগামী ২০ জানুয়ারি পাকাপাকিভাবে হোয়াইট হাউসের গদিতে বসতে যাচ্ছেন ট্রাম্প। এরই মধ্যে তিনি হুমকি দিয়ে রেখেছেন—ক্ষমতায় গেলে মধ্য আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া অভিবাসনপ্রার্থী ও শরণার্থীদের তাড়িয়ে দেবেন। ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার বলি হতে পারেন হন্ডুরাসের লাখ লাখ মানুষ।

চলুন দেখে নেওয়া যাক বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি এবং তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর মধ্যে এই দ্বন্দ্বের মূলে কী রয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন তা গুরুত্বপূর্ণ এবং দুই দেশের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে, তাতে এই দ্বন্দ্বের অর্থ কী?

যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের নিয়ে হন্ডুরাস কী বলেছে

খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উপলক্ষে দেওয়া এক বার্তায় হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট জিওমারা কাস্ত্রো হুমকি দিয়ে বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি তাঁর দেশ থেকে অনিবন্ধিত অভিবাসীদের গণহারে বের করে দেওয়ার পরিকল্পনা জারি রাখেন, তাহলে দেশটির সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করবেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট কাস্ত্রোর ভাষ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গণহারে অভিবাসীদের বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটলে হন্ডুরাসে দেশটির সামরিক স্থাপনাগুলো, বিশেষ করে সোতো কানো বিমানঘাঁটি ‘চালু থাকার সব যোগ্যতা হারাবে’। এটুকুই নয়, হন্ডুরাসের মাটিতে দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির আরও বড় পরিসরে সমালোচনা করেছেন তিনি।

বিদেশে অবস্থান করা নাগরিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর হন্ডুরাসের নির্ভরশীলতা রয়েছে। ২০২২ সালে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৭ শতাংশই এসেছে রেমিট্যান্স থেকে।

টেলিভিশনে সম্প্রচার করা এক বিবৃতিতে কাস্ত্রো বলেন, ‘আমাদের ভাইদের গণহারে তাড়িয়ে দেওয়ার যে বৈরী মনোভাব দেখানো হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার নীতিতে পরিবর্তন আনার বিষয়টি আমাদের বিবেচনা করতে হবে, বিশেষ করে সামরিক ক্ষেত্রে। দশকের পর দশক ধরে এক পয়সা না দিয়েও তারা আমাদের দেশে সামরিক ঘাঁটি পরিচালনা করছে।’

হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট জিওমারা কাস্ত্রো
ফাইল ছবি: রয়টার্স

হন্ডুরাসে মার্কিন ঘাঁটিগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ

মধ্য আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর সামরিক কার্যক্রমের অংশ হন্ডুরাসে সোতো কানো বিমানঘাঁটিটি। এ অঞ্চলে কমিউনিস্ট হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করতে আশির দশকে ঘাঁটিটি গড়ে তোলে ওয়াশিংটন। সেখানে বর্তমানে হাজারের বেশি মার্কিন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও কলম্বিয়ার মধ্যে অল্প যে কয়টি স্থানে বড় উড়োজাহাজ অবতরণ করতে পারে, তার একটি এই ঘাঁটি।

গবেষক এরিক ওলসনের ভাষায়, ‘আমি ভাবতেও পারি না, এই হুমকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সদয়ভাবে নেবেন।’

মধ্য আমেরিকা অঞ্চলে দ্রুত মার্কিন সেনা মোতায়েন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সোতো কানো বিমানঘাঁটি। এ ছাড়া সেখান থেকে বিভিন্ন বিপর্যয়ের সময় ত্রাণ ও প্রশাসনিক সহায়তা সরবরাহ করা যায়। মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ এই ঘাঁটি। কারণ, মধ্য ও লাতিন আমেরিকায় মাদক পাচার করিডরগুলোর কাছাকাছি এর অবস্থান।

যদিও হন্ডুরাসের সাবেক প্রেসিডেন্ট হুয়ান অরলান্ডো হার্নান্দেজের সরকারের প্রতি ওয়াশিংটন সমর্থন জানানোর পর দেশটিতে ঘাঁটি নির্মাণের যে যৌক্তিকতা যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়েছে, তার সমালোচনা করেছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। অর্থ পাচার ও মাদক–সংক্রান্ত অপরাধের জেরে ২০২২ সালে হার্নান্দেজকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করা হয়। তিনি নিউইয়র্কে ৪৫ বছরের কারাদণ্ডের সাজা ভোগ করছেন।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক ডানা ফ্রাঙ্ক আল–জাজিরাকে বলেন, হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট, তাঁর দুর্নীতি ও সামরিক বাহিনীকে বৈধতা দিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাদের শক্তিশালী করছিল। লাখ লাখ ডলার দিচ্ছিল। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য ছিল, ঘাঁটিটি তারা মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহার করছে। এটি জোচ্চরি।

হন্ডুরাসের হুমকি কতটা গুরুত্বপূর্ণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, হন্ডুরাসের এই হুমকি মধ্য আমেরিকার ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। অধ্যাপক ডানা ফ্রাঙ্ক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ধরেই নিয়েছে, তারা পশ্চিম গোলার্ধে, বিশেষ করে মধ্য আমেরিকায় আধিপত্য করতে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে হন্ডুরাসের এই হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় শক্তিশালী একটি বাঁকবদল বলে মনে করেন তিনি।

ডানা ফ্রাঙ্কের ভাষ্যমতে, যখন চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে, তখন হয়তো সোতো কানো ঘাঁটি ধরে রাখতে চাইবে ওয়াশিংটন। বর্তমানে মধ্য আমেরিকায় চীনের কোনো সামরিক উপস্থিতি নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কে হন্ডুরাস ফাটল চাইবে না বলেও মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বিদেশে অবস্থান করা নাগরিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর হন্ডুরাসের নির্ভরশীলতা রয়েছে। ২০২২ সালে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৭ শতাংশই এসেছে রেমিট্যান্স থেকে। আর হন্ডুরাসের প্রবাসী নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের হিসাবে, হন্ডুরাসের জনসংখ্যার ৫ শতাংশ থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে, যা সংখ্যার দিক দিয়ে পাঁচ লাখের বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ফাইল ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে হন্ডুরাস, বিশেষ করে শ্রম খাতে। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর শহরে ফ্রাঙ্কিস স্কট কি ব্রিজ ভেঙে পড়েছিল। ওই ঘটনায় ছয়জন নির্মাণশ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের একজন ছিলেন হন্ডুরাসের। অন্যরা ছিলেন মেক্সিকো, গুয়াতেমালা ও এল সালভেদর থেকে যাওয়া অভিবাসী।

বিষয়টি বিবেচনায় নিলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গণহারে অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকির মুখে হন্ডুরাসের চুপ থাকাটা কঠিন। দেশটির উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী টনি গার্সিয়া বলেছেন, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার হন্ডুরাসের নাগরিককে বের করে দেওয়া হতে পারে। এতে বড় আঘাত আসতে পারে রেমিট্যান্স তথা দেশটির অর্থনীতির ওপর।

যা হতে পারে

বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, হন্ডুরাসের এই হুমকির লক্ষ্য তাদের নীতিতে দ্রুত কোনো পরিবর্তন আনা নয়। বরং এটি আলোচনায় বসার একটি কৌশল। আর মাকিন নীতিতে অর্থপূর্ণভাবে পরিবর্তন আনার সক্ষমতাও হন্ডুরাসের নেই। গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের গবেষক এরিক ওলসন বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, হন্ডুরাস খুবই দুর্বল অবস্থান থেকে হুমকিগুলো দিচ্ছে।’

ওলসনের মতে, এই হুমকির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও হন্ডুরাসের সম্পর্কে বড় পরিসরে প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে ডানপন্থী রিপাবলিকান সরকার যখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে, তখন এই হুমকি দিয়ে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ শুরু করেছে হন্ডুরাস সরকার।

গবেষক এরিক ওলসনের ভাষায়, ‘আমি ভাবতেও পারি না যে এই হুমকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সদয়ভাবে নেবেন। বিশেষ করে এমন একটি সরকার এই হুমকি দিয়েছে, যাদের নিকারাগুয়া ও ভেনেজুয়েলার সমকাতারে ফেলতে ইতিমধ্যে আগ্রহ দেখিয়েছেন রিপাবলিকানরা। সোতো কানো ঘাঁটি নিয়ে শেষ পর্যন্ত যা–ই হোক না কেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে যাচ্ছে।’