বাইডেন যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের গভীরে নিয়ে যাচ্ছেন
গাজা যুদ্ধ চলছে। লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা হামলা চালাচ্ছে। জর্ডান, সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিন স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করছে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া। এসবের সঙ্গে ইসরায়েলের সামরিক কর্মকাণ্ডের সম্পর্ক কতটা? যুক্তরাষ্ট্রের এখন কী করা উচিত? এসব বিষয়ে আলোকপাত করেছেন সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির জ্যেষ্ঠ ফেলো ও জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারী অধ্যাপক মেলভিন এ. গুডম্যান। তাঁর লেখাটি কাউন্টারপাঞ্চ থেকে অনুবাদ করেছেন হাসান ইমাম
গাজা যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার মধ্যে যোগসূত্র থাকার বিষয়টি হয়তো মার্কিন কর্মকর্তারা স্বীকার করতে চাইবেন না, কিন্তু এটি প্রশ্নাতীতভাবে সত্য যে ইসরায়েলের সামরিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হুতি বিদ্রোহীদের হামলা বাড়ানোর বিষয়টি সম্পৃক্ত এবং একইভাবে জর্ডান, সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিন স্থাপনায় হামলা জোরদারে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের উদ্বুদ্ধ করেছে।
পরিবর্তিত এ পটভূমিতে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আরও শক্তপোক্ত অবস্থান নিয়েছে এবং ইসরায়েলকে কূটনৈতিকভাবে সৌদি আরবের দেওয়া স্বীকৃতির বিনিময়ে রিয়াদের সঙ্গে বিস্তৃত পরিসরে নিরাপত্তা জোটের সম্ভাবনার কথা বলছে। বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আরও জোরালো প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন। অথচ এটা এমন একটা সময়ে হচ্ছে, যখন ওই অঞ্চলে আমাদের উপস্থিতি কমানোর জন্য পথ খুঁজে বের করা উচিত।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির ইতিহাস মূলত ব্যর্থতারই এক বয়ান, বিশেষ করে এ সন্ধিক্ষণে বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক, যখন আমাদের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বড় কোনো স্বার্থ ঝুঁকির মধ্যে নেই। সেই ১৯৫৩ সালে ইরানের বৈধ সরকারকে যখন উৎখাতে নিষেধাজ্ঞা দেন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার, তখন তিনি একের পর এক ব্যর্থতার মুখোমুখি হন। ১৯৮২ সালে প্রেসিডেন্ট রেগান দুর্ভাগ্যজনক এক ইসরায়েলি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে লেবাননে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির বিষয়টির অনুমোদন দেন। এর জেরে মার্কিন মেরিন সেনারা সন্ত্রাসী হামলার মুখে পড়েছিলেন।
গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন পাঁচবার সফরে গেছেন। তাঁর পঞ্চম সফর প্রথম চারটির চেয়ে বেশি সফল হয়নি। এসব সফর ইসরায়েলকে গাজার বেসামরিক এলাকায় ভারী বোমাবর্ষণ কমাতে এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটিতে মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। একইভাবে পশ্চিম তীর ও গাজার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ ও ফিলিস্তিনিদের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদের (গভর্নিং বডি) জন্য একটি চুক্তি করা; ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করা; অথবা ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়েও ব্যর্থ হয়েছে। এরই মধ্যে গত মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন হুতিদের বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক হামলা সম্পর্কে এক আলোচনায় স্বীকার করেছেন: ‘তারা কি হুতিদের থামাচ্ছে? না। তারা কি হামলা চালিয়ে যাবে? হ্যাঁ।’
মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক সংস্কারের জন্য পথ অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে নিজেকে খুব পলকাভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের মনোযোগের সবটা এখন থাকা উচিত গাজায় যুদ্ধবিরতি ও ১০০ জনের বেশি ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তির দিকে। (ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের মতে, হামাসের হাতে থাকা বাকি ১৩৬ জিম্মির মধ্যে অন্তত ৩২ জন মারা গেছেন।) অথচ এর পরিবর্তে বাইডেন প্রশাসন এমন আলোচনায় নিয়োজিত, যা কোনো কাজে লাগছে না। যেমন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা একজন নবীন তরুণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা এবং নতুন ফিলিস্তিনি প্রশাসনকে সহযোগিতার জন্য গাজায় একটি আরব শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা করা।
ইসরায়েল এসব ঠেকাতে তার ক্ষমতার মধ্যে সম্ভাব্য সবকিছু করবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে দেনদরবার করতে হবে, ততক্ষণ এ ব্যাপারে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম। বাইডেন ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগে কোনো আগ্রহ দেখাননি। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ খুব সামান্যই। অতীতের নজির বলছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টদের বিব্রত করার জন্য নেতানিয়াহু তাঁর পথের বাইরে গিয়েও হেঁটেছেন এবং জানুয়ারির শেষ নাগাদ গাজায় তীব্র মাত্রার বোমাবর্ষণ সীমিত করার প্রশ্নে বাইডেন প্রশাসনের প্রতি দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি এরই মধ্যে তিনি ভঙ্গ করেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির ইতিহাস মূলত ব্যর্থতারই এক বয়ান, বিশেষ করে এ সন্ধিক্ষণে বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক, যখন আমাদের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বড় কোনো স্বার্থ ঝুঁকির মধ্যে নেই। সেই ১৯৫৩ সালে ইরানের বৈধ সরকারকে যখন উৎখাতে নিষেধাজ্ঞা দেন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার, তখন তিনি একের পর এক ব্যর্থতার মুখোমুখি হন। ১৯৮২ সালে প্রেসিডেন্ট রেগান দুর্ভাগ্যজনক এক ইসরায়েলি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে লেবাননে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির বিষয়টির অনুমোদন দেন। এর জেরে মার্কিন মেরিন সেনারা সন্ত্রাসী হামলার মুখে পড়েছিলেন।
২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাকে প্রতারণাপূর্ণ সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা সাজান, যাতে বাগদাদের ওপর ইরানের প্রভাব বিস্তারের দরজা খুলে যায়। শুরু হয় অস্থিতিশীলতার চক্র, যা এখনো এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন; পূর্ব জেরুজালেমে মার্কিন কনস্যুলেট বন্ধ করে দেন; ফিলিস্তিনিদের সাহায্য বন্ধ করে দেন; গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের স্থায়ী দখলদারত্বকে সমর্থন করেন। ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তি বাতিলের ফলে দেশটির গুরুতর রাজনৈতিক আলোচনার সুযোগ হঠাৎ শেষ হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থ রক্ষার জন্য দুটি পদক্ষেপ অপরিহার্য। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলকে চাপ দিতে হবে। ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো মার্কিন অস্ত্র হস্তান্তরের ক্ষেত্রে প্রকৃত শর্ত আরোপ করা অথবা ওয়াশিংটন যে প্রাণঘাতী ব্যবস্থা সরবরাহ করে, তা বন্ধ করা। ইসরায়েলের ব্যাপারে প্রভাবের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বেসামরিক হাতিয়ার নেই, তাই সামরিক সহায়তাই আমাদের লাভের একমাত্র উৎস। দ্বিতীয়ত, ইরানের সঙ্গে নতুন করে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরুর সময় এসেছে।
ইরানে বিপ্লব মাথাচাড়া দেওয়াসহ ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের হামলা চালানোর পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগরে প্রভাব বিস্তারে সামরিক শক্তির ওপর যুক্তরাষ্ট্র অত্যধিক নির্ভর করে আসছে। এ পটভূমিতে অনেক মার্কিন রাজনীতিবিদ ও পণ্ডিতই ইরানে সরকার পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশটির বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহারের পক্ষে। অনেক মার্কিন নেতাই ১৯৭৯ সালে ইরানে আমাদের নাগরিকদের জিম্মি পরিস্থিতির কথা ভুলে যাননি এবং সে সময় থেকেই তাঁরা পাল্টা আঘাত হানতে চেয়েছেন। যেমন অবসরপ্রাপ্ত মেরিন জেনারেল অ্যান্থনি জিনি একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘আপনি যদি ইরাককে পছন্দ করেন, তবে আপনি ইরানকেও ভালোবাসবেন।’
যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থ রক্ষার জন্য দুটি পদক্ষেপ অপরিহার্য। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলকে চাপ দিতে হবে। ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো মার্কিন অস্ত্র হস্তান্তরের ক্ষেত্রে প্রকৃত শর্ত আরোপ করা অথবা ওয়াশিংটন যে প্রাণঘাতী ব্যবস্থা সরবরাহ করে, তা বন্ধ করা।
ইসরায়েলের ব্যাপারে প্রভাবের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বেসামরিক হাতিয়ার নেই, তাই সামরিক সহায়তাই আমাদের লাভের একমাত্র উৎস। দ্বিতীয়ত, ইরানের সঙ্গে নতুন করে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরুর সময় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নসের ইরানি নেতাদের সঙ্গে দেনদরবার করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। স্পষ্টতই তিনি বাইডেন প্রশাসনের সবচেয়ে কার্যকর কূটনীতিক। ইরানকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান কূটনৈতিক কার্যকলাপ সৌদি আরব, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মতো গুরুত্বপূর্ণ আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনায় সীমাবদ্ধ, যা কোথাও নিয়ে যাচ্ছে না। উপরন্তু এসব আলোচনার মধ্যে রয়েছে সৌদি আরবের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনার বিষয়টি, যা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন উপস্থিতির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত একটি ঢাল যুক্ত করবে।
এসব অগ্রগতি এমনকি ‘আরব ন্যাটো’ গঠনের জন্য নতুন করে আলোচনার দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা ট্রাম্প ও তাঁর তৎকালীন আক্রমণাত্মক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন শুরু করেছিলেন। বাইডেন প্রশাসন সম্ভবত এই অঞ্চলে সামরিক শক্তির সীমা বুঝতে পারে, তবে ইরানের সঙ্গে সংঘাত ও নেতানিয়াহুর প্রতি অব্যাহত সমর্থনের বিষয়টি কেবল অতিরিক্ত মার্কিন সেনা মোতায়েন করার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এর শেষ পরিণতি হবে যুক্তরাষ্ট্রকে আটকে মধ্যপ্রাচ্যে রাখা; নিজেদের কাঁটাঝোপে আটকে থাকা।