ফিরে দেখা
যাঁর অভিনয়ের ভক্ত ছিলেন, তিনিই খুন করেন লিংকনকে
বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রনায়ক বা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব খুন হয়েছেন বা রাষ্ট্রযন্ত্র প্রভাবিত বিচারব্যবস্থায় তাঁদের ফাঁসি হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ড বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা সা্রা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এসব ঘটনা সম্পর্কে এখনো পাঠকদের জানার প্রবল আগ্রহ রয়েছে। তাঁদের আগ্রহের কথা চিন্তা করে আমাদের এই বিশেষ আয়োজন। আজ থাকছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুল আলোচিত ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে।
গণতন্ত্র নিয়ে বিখ্যাত সেই সংজ্ঞা এখনো গণতন্ত্রকামী মানুষের মুখে মুখে। যুক্তরাষ্ট্রে ক্রীতদাসপ্রথা বিলোপ করে আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা তাঁর নাম। ঐক্যবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র গড়তে তাঁর ভূমিকা আজও মার্কিন জনগণ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি ১৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। ১৮৬০ সালের ৬ নভেম্বর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর পর থেকে হত্যার হুমকি যেন তাঁর নিত্যসঙ্গী হয়ে ছিল। গুপ্তহত্যার হুমকি দিয়ে পাঠানো চিঠিগুলো হোয়াইট হাউসে নিজের টেবিলের ওপর ‘এ (অ্যাসাসিনেশন)’ লেবেল দিয়ে একটি বাক্সে জমা করে রাখতেন তিনি।
দক্ষিণাঞ্চলে লিংকনবিরোধী মনোভাব চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল। এরপরও নিজের জীবন নিয়ে ভীত ছিলেন না প্রেসিডেন্ট। তবে নিজের মৃত্যু নিয়ে তাঁর নিগূঢ় এক ভবিষ্যদ্বাণী ছিল বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ হ্যারল্ড হোলজার।
এই ইতিহাসবিদ বলেন, ‘আমেরিকান চেতনায় যে গুপ্তহত্যা থাকতে পারে, তা বিশ্বাস করতেন না তিনি (লিংকন)। তিনি নিয়তিবাদীও ছিলেন। বলতেন, ‘কেউ যদি আমার সমালোচনায় মুখর হতে চায়, তা ঠেকানোর মতো কিছুই করার নেই আমার।’
বস্তুত ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় যখন ওয়াশিংটন ডিসির ফোর্ড থিয়েটারে প্রেসিডেন্টের বসার নির্ধারিত জায়গায় জন ইউলকস বুথ ঢুকে পড়েন, তখন লিংকনের কিছুই করার ছিল না। এই মঞ্চ অভিনেতা পেছন দিক থেকে লিংকনের মাথায় গুলি করেন।
নাটকে বুথকে যেভাবে দেখেছিলেন লিংকন
‘প্রেসিডেন্ট লিংকন অ্যাসাসিনেটেড!’ বইয়ের লেখক ইতিহাসবিদ হোলজার। তিনি বলেন, বুথকে যে শুধু লিংকন দেখেছিলেন তা-ই নয়, বরং যে ফোর্ড থিয়েটারে তিনি খুন হন, সেখানেই একটি নাটকে বুথকে অভিনয় করতে দেখেছিলেন লিংকন।
১৮৬৩ সালের নভেম্বরে দেওয়া ঐতিহাসিক গেটিসবার্গ ভাষণের কয়েক দিন আগে ‘দ্য মার্বেল হার্ট’ নামের একটি নাটক দেখতে ওই থিয়েটারে যান লিংকন। ফরাসি ভাষা থেকে অনূদিত সেই নাটকে বুথ খলচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
হোলজারের ভাষ্য, নাটকের মধ্যেই প্রেসিডেন্টের বসার জায়গার দিকে লক্ষ্য করে সরাসরি অনেক খল সংলাপ দিতে থাকেন বুথ। বিষয়টি খেয়াল করেন লিংকনের এক সঙ্গী। তিনি লিংকনকে বলেন, ‘সংলাপগুলো অনেকটা আপনাকে উদ্দেশ করেই সে দিয়েছে।’ জবাবে লিংকন বলেন, ‘আমাকে লক্ষ্য করে খুবই উগ্রভাবে কথাগুলো বলছে, তা–ই না?’
লিংকনকে হত্যার ছয় সপ্তাহ আগেও একবার ঘাতক তাঁর খুবই কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। বুথ দেখার চেষ্টা করেছিলেন যে প্রেসিডেন্টের কতটা কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব। ১৮৬৫ সালের ৫ মার্চ দ্বিতীয় উদ্বোধনী ভাষণের সময় ‘ক্যাপিটল রোটুন্ডা’য় সীমানাবেষ্টনীর পেছনে অবস্থান নেন বুথ। লিংকন ভাষণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভবনের সামনের দিকে যেতে সিনেট চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার সময় বুথ অপেক্ষায় ছিলেন।
বুথকে যে ব্যক্তি থামিয়েছিলেন, তাঁর ভাষ্য, চোখে উন্মত্তভাব নিয়ে সীমানাবেষ্টনী পার হয়ে যান বুথ। হোলজার বলেন, এটা ছিল এমন এক মুহূর্ত, যখন বুথ খুব কাছ থেকে লিংকনকে গুলি করতে পারতেন। তাঁর মাথায় কয়েক সপ্তাহ ধরেই খুনের নেশা চেপে ছিল।
বুথ বলেছিলেন ‘এটাই হবে শেষ ভাষণ’
লিংকন ১৮৬৫ সালের ১১ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের ব্যালকনি থেকে সংস্কার নিয়ে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে আফ্রিকান আমেরিকানদের ভোটের অধিকার দেওয়ার সময় এসেছে। আমেরিকার ইতিহাসে লিংকনই প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট, যিনি বিষয়টি সামনে আনেন।
হোয়াইট হাউসের আঙিনায় দাঁড়িয়ে লিংকনের বক্তব্য শুনছিলেন বুথ ও তাঁর আরেক সহযোগী। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে হোলজার বলেন, লিংকনের বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বুথ। তাঁর মতে, প্রেসিডেন্টের বার্তার মানে হলো, কালোরাও সমঅধিকার পাবেন।
এ সময় নিজের সহযোগীর দিকে তাকিয়ে বুথ বলেন, ‘এটাই হবে তাঁর (প্রেসিডেন্ট লিংকন) শেষ ভাষণ।’ মাত্র তিন রাত পরই বুথ তাঁর কথা বাস্তবায়ন করেছিলেন।
বুথ কেন লিংকনকে হত্যা করেন
আমেরিকার দক্ষিণের রক্ষণশীল অঙ্গরাজ্যগুলো ১৮৬১ সালে কনফেডারেট স্টেটস অব আমেরিকা গঠন করে। এসব রাজ্য দাসপ্রথার পক্ষে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। অবশ্য এই কনফেডারেট বেশি দিন টেকেনি। তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পায়নি। শেষ পর্যন্ত ১৮৬৫ সালে মে মাসে কনফেডারেটপন্থী লোকজন ইউনিয়নপন্থী ব্যক্তিদের কাছে পরাজিত হন।
বুথ ছিলেন একজন শক্তিশালী অভিনেতা। ছিলেন সুদর্শন। মঞ্চে তাঁর সহজাত অভিনয় সংস্কৃতিপিপাসু মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। লিংকন নিজেও তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করেছিলেন।
বুথ সম–অধিকারবিরোধী ও কনফেডারেটের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। চোখের সামনে কনফেডারেটপন্থী ব্যক্তিদের পরাজয় ও দাসপ্রথার বিলুপ্তি তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। এ কারণে লিংকনকে অনেকটা ব্যক্তিগত শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করেন।
দাসপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নায়ক
১৮০৯ সালে ক্যানটাকি অঙ্গরাজ্যের হডজেনভিলে টমাস লিংকন ও ন্যান্সি লিংকনের দ্বিতীয় সন্তান আব্রাহাম লিংকনের জন্ম। বাবা টমাস লিংকন ছিলেন কখনো কৃষক, কখনো কাঠমিস্ত্রি। সংসারে সচ্ছলতা ছিল না তাঁদের। পেরি কাউন্টিতে আসার দুই বছর পর মারা যান আব্রাহামের মা ন্যান্সি লিংকন।
লিংকনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। বন্ধুদের পুরোনো বই সংগ্রহ করে পড়তেন। আইন বিষয়ে পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও কোথাও ভর্তি হতে পারেননি। অগত্যা নিজে নিজেই পড়তে শুরু করেন আইনবিষয়ক বই। দুই বছর পর ইলিনয় বারে আইন বিষয়ে পড়ার সুযোগ পান।
লিংকন জনসাধারণের সঙ্গে কাজ করে সামাজিক দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর কথা বলার প্রতিভার কারণে স্থানীয় মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় ব্যক্তি। ১৮৪২ সালে বিয়ে করেন ধনী ব্যবসায়ী ও আইনজীবীর কন্যা ম্যারি টোডকে।
লিংকন ১৮৪৬ সালে ইলিনয় থেকে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে কয়েক বছর আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন। ১৮৫৪ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রেইরি ল্যান্ডে দাসপ্রথা চালু করলে লিংকন এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং রাজনীতিতে ফিরে আসেন।
এরপর ১৮৫৬ সালে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেন লিংকন। ১৮৬০ সালে বেশ কিছু প্রভাবশালী প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন এবং ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
লিংকন বহু বছর ধরে চলে আসা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ চলার মধ্যেই তিনি ১৮৬৩ সালে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। এটি ছিল দাসপ্রথার বিরুদ্ধে নেওয়া পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বড় পদক্ষেপ। আর এ জন্যই শেষ পর্যন্ত লিংকনকে নিজের জীবনও উৎসর্গ করতে হয়েছে।