মধ্যবর্তী নির্বাচন মার্কিন মুলুকে যে বদল আনতে পারে
যুক্তরাষ্ট্রের আজকের মধ্যবর্তী নির্বাচনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে ক্ষমতাসীন দলের ওপর। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাগ্য কতটা সুপ্রসন্ন, তার অনেকটাই আভাস দেবে এই মধ্যবর্তী নির্বাচন। তবে এর প্রভাব মার্কিনদের দৈনন্দিন জীবনের ওপরও নেহাতই কম নয়।
এই মধ্যবর্তী নির্বাচনেই বোঝা যাবে, কার হাতে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। দেশের আইনপ্রণেতা ও গভর্নর কার্যালয়ের দায়িত্ব কে সামলাবেন, সেটাও অনেকটা স্পষ্ট হবে এই নির্বাচনে। আবার এই নির্বাচনেই ভোটাররা দেশের নেতৃত্ব ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মতপ্রকাশের সুযোগ পাবেন।
মধ্যবর্তী নির্বাচন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য কতটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা বিবিসির এক বিশ্লেষণে তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়া, অনথিভুক্ত অভিবাসন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চাপে ফেলতে পারে।
এই মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলই ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাঠের প্রতিযোগিতায় প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবার নির্বাচনে যাওয়ার সম্ভাবনার ওপরও প্রভাব ফেলবে।
বিবিসির ওই প্রতিবেদনে মধ্যবর্তী নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে, এমন পাঁচটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
গর্ভপাতের অধিকার অথবা বিধিনিষেধ
কংগ্রেসের পুনর্গঠন সরাসরি মার্কিনদের দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, তার বড় উদাহরণ হতে পারে গর্ভপাত।
গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত গর্ভপাতের অধিকার আইন বাতিল করেছেন। মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ হাতে পেলে দুই দলই এ ইস্যুতে নতুন আইনের প্রস্তাব করেছে।
ডেমোক্র্যাটরা নারীদের গর্ভপাতের অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্যদিকে রিপাবলিকানরা ১৫ সপ্তাহের পর গর্ভপাতে নিষেধাজ্ঞা জারির প্রস্তাব দিয়েছে।পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন ও মিশিগান অঙ্গরাজ্যে গভর্নর ও স্থানীয় নেতৃত্বে যে ফল আসবে, তাতে গর্ভপাতের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আসতে পারে।
কংগ্রেসে যারা জিতবে ও ক্ষমতায় বসবে, তারা গর্ভপাত ছাড়াও অন্যান্য নীতিতে প্রভাব ফেলবে। যদি রিপাবলিকানরা জেতে, তাহলে অভিবাসন, ধর্মীয় অধিকার ও সহিংস অপরাধ গুরুত্ব পাবে। আর ডেমোক্র্যাটরা জিতলে পরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা, ভোটের অধিকার ও বন্দুক নিয়ন্ত্রণের মতো ইস্যুগুলো গুরুত্ব পাবে।
রিপাবলিকানদের তদন্তের পালা
এ তো গেল নীতিনির্ধারণের কথা। এর বাইরেও মধ্যবর্তী নির্বাচনের আলাদা প্রভাব রয়েছে। যে দল কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তাদের হাতে কমিটির তদন্তের ক্ষমতা থাকবে। দুই বছর ধরে ডেমোক্র্যাটরা হোয়াইট হাউসের খুঁটিনাটি তথ্য প্রকাশ সীমিত রেখেছে। গত বছরের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনাকেই বেশি সামনে এনেছে তারা।
ওই হামলার ঘটনায় ডেমোক্র্যাটরা এ পর্যন্ত কয়েক শ মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল, ট্রাম্প হামলার বিষয়ে আগে থেকে জেনেও কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুনানি হয়েছে। এ বছরের শেষের দিকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলে খেলা ঘুরে যেতে পারে। রিপাবলিকানরা আশা করছে, তারা হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের নিয়ন্ত্রণ পাবে। এমনটা ঘটলে কী করবে, তা–ও বলেছে রিপাবলিকানরা। রিপাবলিকানরা বলেছে, ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার শুনানি বন্ধ করে জো বাইডেনের ছেলে হান্টারের চীনের সঙ্গে ব্যবসা নিয়ে শুনানি চালু করবে তারা।
রিপাবলিকানরা বাইডেন প্রশাসনের অভিবাসননীতি, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণের উৎস নিয়েও তদন্ত করতে চায়।
বাইডেনের ভবিষ্যৎ
ক্ষমতাসীন দলের ওপর একধরনের গণভোট হিসেবে বিবেচনা করা হয় মধ্যবর্তী নির্বাচনকে। এক বছরের বেশি সময় ধরে বাইডেনের প্রতি সমর্থন কমেছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগের মতো ইস্যুতে জোরেশোরে প্রচার চালিয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। কংগ্রেসের দুই কক্ষে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ডেমোক্র্যাটরা।
প্রেসিডেন্ট থাকার প্রথম দুই বছরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জলবায়ু পরিবর্তন, বন্দুক নিয়ন্ত্রণ, অবকাঠামোগত বিনিয়োগ, শিশুদের দারিদ্র্যের মতো ক্ষেত্রগুলোতে নতুন আইনের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করেছেন। কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা কম থাকলেও বাইডেনের চেষ্টা থামেনি।
বাইডেন নিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলোর একটিও রিপাবলিকানদের দখলে চলে গেলে এসব ইস্যুতে তারা ডেমোক্র্যাটদের বিল পাস আটকে দেবে। মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাইডেনের রাজনৈতিক দুর্বলতা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার শুরু হলে বাইডেনের জায়গায় অন্য ডেমোক্র্যাট খোঁজা হতে পারে।
ট্রাম্প কি আবার নির্বাচন করবেন
যুক্তরাষ্ট্রের পরাজিত প্রেসিডেন্টদের মতো ট্রাম্প নীরবে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াননি। তিনি এখনো ২০২৪ সালের নির্বাচনে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার আগ্রহ পোষণ করছেন। মধ্যবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্পের অবস্থান শক্তিশালী হতে পারে। আবার এই নির্বাচনের ফলে ট্রাম্প একেবারে হতাশও হতে পারেন। ট্রাম্প সরাসরি ভোটে না থাকলেও তাঁর পছন্দের বেশ কয়েকজন ক্ষমতাধর প্রার্থী মার্কিন নির্বাচনের দৌড়ে মাঠে নেমেছেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বেশ কয়েকজন সিনেট প্রার্থীকে তুলে এনেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন জর্জিয়ার সাবেক ফুটবল খেলোয়াড় হারশেল ওয়ালকার, পেনসিলভানিয়ার চিকিৎসক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মেহমেত ওজ, ওহাইওর জনপ্রিয় লেখক জেডি ভান্স প্রমুখ। তাঁদের প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে প্রবীণ রিপাবলিকান নেতারা আপত্তি জানান। তবে ট্রাম্প এসবে কান দেননি।
এই জনপ্রিয় তারকারা জিতলে ট্রাম্পের রাজনৈতিক দক্ষতাই প্রমাণিত হবে। এতে কনজারভেটিভ দলের আবেদনও বাড়বে। তবে কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সংখ্যা কমে গেলে ব্যর্থতার দায়ও চাপবে ট্রাম্পের ওপর। এ জন্য প্রার্থী নির্বাচনে ট্রাম্পের অদক্ষতাকে দায়ী করা হতে পারে।
এমনটা ঘটলে রিপাবলিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের বিরোধী যাঁরা আছেন, তাঁরা উৎসাহী হতে পারেন। ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিসান্টিস ও টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট নভেম্বরে পুনর্নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। ২০২৪ সালে রিপাবলিকানদের মনোনয়ন পেতে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলকে তাঁরা ব্যবহার করতে পারেন।
অস্বীকারকারীরা কি নির্বাচন করবেন
৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার পর এ বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনই প্রথম নির্বাচন। এ নির্বাচনে ট্রাম্পের সমর্থকেরা জো বাইডেনকে পরাস্ত করার চেষ্টা করবেন।
ক্যাপিটল হিলে হামলা থেকে দৃষ্টি সরাতে ট্রাম্প বরাবর নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলা এমন বেশ কয়েকজন মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন অ্যারিজোনার মার্ক ফিঞ্চেম, নেভাদার জিম মার্চেন্ট, পেনসিলভানিয়ার গভর্নর প্রার্থী ডগ মাসট্রিয়ানো।
২০২৪ সালের নির্বাচনে নিজেদের অঙ্গরাজ্যে প্রভাব বিস্তার করার জন্য তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মধ্যবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত হলে এই রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করতে পারেন।