বেইজিং থেকে বুদাপেস্ট— কমলা-ট্রাম্প বিতর্ক কীভাবে দেখছে বিশ্ব

প্রথম মুখোমুখি বিতর্কে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বাগ্‌যুদ্ধে জড়ান বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম সরাসরি বিতর্ক গভীর মনযোগ দিয়ে দেখেছেন মার্কিন ভোটাররা। এই বিতর্কের দিকে নজর ছিল বাকি বিশ্বেরও।

স্থানীয় সময় মঙ্গলবার পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়াতে এবিসি নিউজ আয়োজিত এই বিতর্কে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বাগ্‌যুদ্ধে জড়ান বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

বেইজিং থেকে বুদাপেস্ট— এই বিতর্ককে কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তা তুলে ধরেছেন বিভিন্ন দেশে থাকা বিবিসির প্রতিবেদকেরা।

পুতিনের নাম নেওয়ায় বিরক্ত ক্রেমলিন

বিতর্কে ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে কমলা বলেন, ‘পুতিন (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন) একজন একনায়ক। তিনি আপনাকে ধরাশায়ী করে ফেলবেন।’

এ বিতর্কের ওপর নজর ছিল রাশিয়ার। মস্কো মার্কিন নির্বাচনে এমন ফলাফল দেখতে আগ্রহী, যাতে রাশিয়ার উপকৃত হবে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনের জয় চান কি না— এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান ট্রাম্প। যে বিষয়টি ক্রেমলিন ইতিবাচকভাবে নিয়েছে।

জবাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি চাই এই যুদ্ধ বন্ধ হোক।’ অন্যদিকে কমলা ইউক্রেনের ‘ন্যায়সংগত আত্মরক্ষার’ কথা বলেন। তিনি অভিযোগ করেন, বাকি ইউরোপের প্রতিও নজর দিয়েছেন পুতিন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের বিতর্কে পুতিনের নাম উল্লেখ করায় ক্রেমলিন বিরক্ত বলে জানিয়েছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে পুতিনকে পুঁজি করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি পছন্দ করি না। আশা করছি, আমাদের প্রেসিডেন্টের নাম এসবের বাইরে রাখবেন তাঁরা।’

ট্রাম্পের মন্তব্যে কিয়েভে উদ্বেগ

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনের জয় চান কি না— এমন প্রশ্নের জবাব ট্রাম্প না দেওয়ায় কিয়েভের লোকজন সম্ভবত অবাক হননি। তবে এতে তাঁদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করেছে যে, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসলে না জানি কোনো পরিণতি ডেকে আনে।

ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে গর্ব করে বলে আসছেন, তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারেন। এটি এমন আভাস হিসেবে অনেক ইউক্রেনীয় দেখছেন যে, অবিশ্বাস্যভাবে একটি বাজে চুক্তি চাপিয়ে দেওয়া হবে, যেখানে রাশিয়া গত আড়াই বছর যে ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে তার বিশাল অংশ ছেড়ে দিতে কিয়েভকে বাধ্য করা হবে।

অন্যদিকে, কমলা হ্যারিসের জবাবে কিছুটা আস্থা খুঁজে পাবেন ইউক্রেনীয়রা। আমেরিকা বর্তমানে ইউক্রেনকে যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, সে অবস্থান থেকে সরে আসার কোনো ইঙ্গিত তাঁর বক্তব্যে ছিল না।

কমলার দাবি, ‘ট্রাম্প এখনো যদি হোয়াইট হাউসে থাকতেন, তাহলে ঠিক এই মুহূর্তে পুতিনকে কিয়েভ বসা দেখা যেত।’

ট্রাম্পের মন্তব্যের পর ‘আবদুল’ মিমের ছড়াছড়ি

আফগানিস্তান থেকে ২০২১ সালের আগস্টে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা যুদ্ধের অবসান হয়। তবে কাবুলের দিকে তালেবানদের বিস্ময়করভাবে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসার ফলে শেষ মুহূর্তে সেনা ও কয়েক হাজার বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে নিতে গিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

কমলা ও ট্রাম্পের বিতর্কেও যথারীতি বিষয়টি যে এসেছে, তা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছুই ছিল না। কারণ, আসলে কী ঘটেছিল, সেটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এবং বিকৃত করা হয়েছে।

যেভাবে সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছিল, সে বিষয়টি সমর্থন করেন কি না— এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান কমলা। তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, সেনা প্রত্যাহারে প্রেসিডেন্টে বাইডেনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি একমত।

বিতর্কে ট্রাম্প গর্ব করে বলেন, তিনি তালেবান প্রধান ‘আবদুলের’ সঙ্গে কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন, যিনি এখনো তালেবানের প্রধান।

ধারণা করা হচ্ছে, আবদুল বলতে তিনি আবদুল গনি বারাদারের কথা বলছেন। সেনা প্রত্যাহার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের হওয়া চুক্তিতে তিনি সই করেছিলেন। তবে তিনি কখনো তালেবানের প্রধান ছিলেন না এবং ক্ষমতা দখলের পর তাঁকে দৃশ্যপট থেকে অনেকটা সরিয়ে দেওয়া হয়।

ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘আবদুল’ মিমের ছড়াছড়ি দেখা যায়, বিশেষ করে যাদের নামের সঙ্গে আবদুল আছে। অন্যরা আবার জানতে চান, ‘আবদুলটা কে?’

বিতর্কের শুরুতে করমর্দন করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস
ছবি: এএফপি

বেইজিংয়ের জন্য অনিশ্চয়তা

চীনের নেতাদের কাছে কমলা অনেকটা অপরিচিত মুখ এবং বিতর্কের পরেও তেমনই আছেন। চীনের বিষয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলার তেমন অতীত অভিজ্ঞতা নেই। বিতর্কের মঞ্চে তিনি এতটুকুই বলেছেন, এক বিংশ শতাব্দীর এই লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র জিতবে, চীন নয়।

ভাইস প্রেসিডেন্ট এমন কিছু তুলে ধরেছেন, যেটা চীন পছন্দ করে না। আর সেটা হলো অনিশ্চয়তা। তবে চীনের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এমন অভিমত চালু আছে, বাইডেনের দেখে-শুনে পা বাড়ানোর কূটনৈতিক পদক্ষেপ থেকে খুব বেশি বিচ্যুত হবেন না কমলা।

অবশ্য বিতর্কে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মার্কিন চিপ চীনে রপ্তানির মাধ্যমে বেইজিংয়ের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়নে সহায়তা করার অভিযোগ আনেন কমলা। জবাবে ট্রাম্প বলেন, চীনা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্কারোপের পরিকল্পনা করছেন তিনি।

চীনের নেতারা অনিশ্চয়তার মতো বিষয় পছন্দ করেন না। কিন্তু ট্রাম্প এর বাইরে গিয়ে অন্য কিছু করবেন, এ বিতর্ক সে ধরনের বিশ্বাস জন্মানোর কিছু করবে না বলেই মনে করেন তাঁরা। বাস্তবতা হলো, হোয়াইট হাউসের দায়িত্বে যে-ই আসুক না কেন, চীনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হবে না।

আরও পড়ুন

হোয়াইট হাউসে যাওয়ার দৌড় নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রহ

মধ্যপ্রাচ্য নীতির বিষয়ে বিতর্কে নিজেদের আগের অবস্থান থেকে তেমন একটা সরে আসেননি দুই প্রার্থীর কেউই। যদিও ট্রাম্প নিজের বৈশিষ্ট্যগতভাবে অতিশয়োক্তি করে বলেন, যদি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী (কমলা) প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে দুই বছরের মধ্যে ইসরায়েলের অস্তিত্ব থাকবে না।

হোয়াইট হাউসে যাওয়ার এই দৌড়ের ওপর নিবিড়ভাবে নজর রাখছে মধ্যপ্রাচ্য। গাজা যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ছে এবং যুদ্ধবিরতি এখনো অধরা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমালোচকদের সন্দেহ, ইচ্ছাকৃতভাবেই এই যুদ্ধকে মার্কিন নির্বাচনের পর পর্যন্ত টেনে নিতে চান নেতানিয়াহু। এই আশায় যে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে হ্যারিসের চেয়ে তিনি ইসরায়েলের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল হবেন।

কমলা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইসরায়েলের ওপর বাইডেনের চেয়ে সম্ভবত কঠোর হবেন তিনি। এই সুযোগটাই লুফে নিয়েছেন ট্রাম্প। বিতর্কে তিনি বলেছেন, ইসরায়েলকে ‘ঘৃণা করেন’ ভাইস প্রেসিডেন্ট।

ফিলিস্তিনিরা ট্রাম্প সম্পর্কে গভীরভাবে সন্দিহান। কিন্তু গাজায় যুদ্ধ থামাতে বাইডেন প্রশাসনের অক্ষমতার কারণে হতাশও। সম্ভবত দুটি মন্দের মধ্যে তুলনামূলক কম মন্দ হিসেবে কমলার প্রতি ঝুঁকেছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন

ওরবানের প্রশংসা করায় হাঙ্গেরিতে উচ্ছ্বাস

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘ভিক্তর ওরবান সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন, তারা তাঁকে দৃঢ়চেতা ব্যক্তি বলে থাকেন। তিনি কঠিন মানুষ; চৌকস।’

ট্রাম্পের এমন প্রশংসা হাঙ্গেরির সরকার সমর্থক সংবাদমাধ্যমগুলো লুফে নেয়। ‘মাগেয়ার নেমজেত’ পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘বড় ধরনের স্বীকৃতি!’

বিতর্কের সঞ্চালকেরা ট্রাম্পকে এমন একজন বিশ্ব নেতার নাম বলতে বলেছিলেন, যিনি তাঁকে সমর্থন করেন। জবাবে তিনি বলেন, ওরবান।

যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে সমর্থন দেন ভিক্তর ওরবান। আগামী নভেম্বরের নির্বাচনেও তাঁর প্রতি কড়া সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন হাঙ্গেরির এই ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী।

আরও পড়ুন