ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি ঝুলিয়ে রেখেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করে কাঙ্ক্ষিত ডিগ্রি পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন আসমির আশরার সাফি। স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও কপালে এখনো ডিগ্রি জোটেনি তাঁর।
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাফি ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টির আরও ১২ জন শিক্ষার্থী একই পরিস্থিতিতে আছেন। অন্তত এক বছর যে তাঁরা ডিগ্রি পাচ্ছেন না, তা নিশ্চিত। বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পরিচালনা কর্তৃপক্ষ হার্ভার্ড করপোরেশন গত ২৩ মে অনুষ্ঠিত স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠানে এ শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সম্প্রতি ফিলিস্তিনের সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত হয়।
২৩ বছর বয়সী সাফি হার্ভার্ড কলেজে চার বছর ধরে সামাজিক অধ্যয়ন, জাতিসত্তা, অভিবাসন ও অধিকার বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি ইতিমধ্যে আপিল করেছেন।
‘আমি অক্সফোর্ডের রোডস বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী। হার্ভার্ডে এক বছর ধরে ডিগ্রি স্থগিত থাকার কারণে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারব কি না, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। এমনকি আমি আমার প্রোগ্রামের সব প্রাতিষ্ঠানিক শর্ত পূরণ করেছি এবং আমার ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে যা যা করা প্রয়োজন, সবকিছুই করেছি।’
সাফির মতো হার্ভার্ডের ডিগ্রি পাচ্ছেন না শ্রদ্ধা জোশিও, যদিও শিক্ষকেরা তাঁর পক্ষে আছেন। হার্ভার্ড কলেজে সাফির মতো একই বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি।
আল–জাজিরাকে জোশি বলেন, ‘আমার পক্ষ থেকে আপিল আবেদনের কাজ শেষ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে যোগাযোগের জন্য অপেক্ষা করব কি না, তা নিয়ে দোলাচলে আছি। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা প্রক্রিয়াগত অস্পষ্টতা নিয়ে পুরোপুরি সন্দিহান। আপিলের সময়সীমার বিষয়টি পরিষ্কার নয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা জোশির। যুক্তরাজ্য থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তবে এখন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন এ শিক্ষার্থী।
জোশি বলেন, ‘হার্ভার্ড-ইউকে ফেলোশিপের আওতায় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিকল্পনা ছিল আমার। তবে ডিগ্রি না পাওয়াকে কেন্দ্র করে আমার পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। প্রশাসকের পক্ষ থেকে যোগাযোগে ঘাটতি ও স্বচ্ছতার অভাবকে কেন্দ্র করে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধের বিরোধিতা করে গত এপ্রিলে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা দাবি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন ইসরায়েলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে বর্জন করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও ৩০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। হার্ভার্ডে ২৪ এপ্রিল থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয় হার্ভার্ড আউট অব অকুপাইড প্যালেস্টাইন (এইচওওপি)।
১৪ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও এইচওওপির মধ্যে আলোচনার পর বিক্ষোভে সমাপ্তি টানার ব্যাপারে সমঝোতা হয়। সমঝোতায় পৌঁছাতে ‘অনিচ্ছাকৃত ছুটিতে’ পাঠানো ২০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে পুনর্বহালের ব্যাপারে সম্মত হয় হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ। ইসরায়েলি কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন বন্ধ করার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রস্তাব ছিল বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের।
জোশি নিজে সরাসরি তাঁবুতে থেকে বিক্ষোভে অংশ নেননি। তবে তিনি বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কলেজ প্রশাসনের সঙ্গে মধ্যস্থতা করেছেন। অনিচ্ছাকৃত ছুটিতে পাঠানো ও হার্ভার্ড ক্যাম্পাস ছাড়তে বলা শিক্ষার্থীদের একজন ছিলেন জোশি।
ছুটিতে পাঠানো শিক্ষার্থীদের পুনর্বহালের আশ্বাস দেওয়া হলেও তা রাখা হয়নি বলে অভিযোগ এ শিক্ষার্থীর। তিনি বলেন, ‘১৭ মে আমাকে মৌখিকভাবে বলা হলো যে হার্ভার্ডের প্রশাসনিক বোর্ড ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত আমাকে পর্যবেক্ষণে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তত দিন পর্যন্ত আমার ডিগ্রি স্থগিত থাকবে। ২০ মে লিখিতভাবে সিদ্ধান্তটি জানানো হয়, যার প্রভাব পড়েছে আমিসহ আরও ১২ জনের বিরুদ্ধে।’
এ সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা জানতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আল–জাজিরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, ‘তাঁবু খাঁটিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট গারবারের যে লিখিত যোগাযোগ হয়েছিল, তা আমি আপনাদের পড়তে বলব। সেখানে শাস্তিমূলক প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি, বরং এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে বিদ্যমান প্রক্রিয়া ও বিধি মেনে শাস্তি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নিলে তিনি খুশি হবেন।’
গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার স্বাধীনতা ও অধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মতো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ও বিতর্কের মধ্যে আছে।
হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ছয় মাসের মাথায় গত জানুয়ারিতে পদত্যাগ করে ক্লদিন গে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কলেজ ক্যাম্পাসে ‘ইহুদিবাদ বিরোধিতার উত্থান’ নিয়ে কংগ্রেসে সাক্ষ্য দেওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করেন।
গে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৮৮ বছরের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালনকারী দ্বিতীয় নারী তিনি। গে তাঁর পদত্যাগপত্রে লিখেছিলেন, জাতিগত বিদ্বেষ থেকে তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
চাপের মুখে গে পদত্যাগপত্র দিয়েছিলেন। একাডেমিক কাজে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। কংগ্রেসের শুনানির পরপরই অভিযোগটি সামনে আসে।