মার্কিন সিনেটে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসন-পরবর্তী বিচার শুরু হওয়ার কথা আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু তার আগে মঙ্গলবার সে বিচারকাজে বাদ সেধে বসলেন কেন্টাকি থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর র্যান্ড পল। শাসনতান্ত্রিক সূত্রে আপত্তি তুলে তিনি বলেন, সাবেক প্রেসিডেন্টের বিচার করার কথা শাসনতন্ত্রে নেই, ফলে সংখ্যাগুরু ডেমোক্র্যাটরা যে বিচারের আয়োজন করছেন, তা অশাসনতান্ত্রিক। এই বিচার বাতিল প্রশ্নে এখনই ভোটাভুটি চাই।
ভোটাভুটিতে আপত্তি ছিল ডেমোক্র্যাটদের। তা সত্ত্বেও ভোট গৃহীত হলে দেখা গেল, মোট ৪৫ জন রিপাবলিকান বিচারের বিপক্ষে। সিনেটের ৫০ জন ডেমোক্র্যাটের সঙ্গে মাত্র ৫ জন রিপাবলিকান বিচারের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ফলে বিচার যথারীতি চলবে, তবে বিচার শেষে ভোটের ফল কী হতে পারে, এ থেকেই তা স্পষ্ট। নিয়ম অনুযায়ী, সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ বা মোট ৬৭ জন সিনেটরের সমর্থন না পেলে ট্রাম্প খালাস পেয়ে যাবেন। স্পষ্টতই ১৭ জন রিপাবলিকান এই বিচারে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গী হবেন, তেমনটা ভাবার সংগত কারণ নেই।
ভোট শেষে উৎফুল্ল রিপাবলিকান সিনেটর র্যান্ড পল সে কথাই বললেন, ‘যাঁরা এই বিচার অশাসনতান্ত্রিক বিবেচনা করেন, তাঁরা কেন সাবেক প্রেসিডেন্টকে দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে ভোট দেবেন?’ ডেমোক্র্যাটদের প্রায় পরিহাস করেই বললেন, সব শেষ, এই চেষ্টার আর কোনো মানে হয় না।
সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের নেতা সিনেটর চাক শুমার সে কথায় সম্মত নন। তিনি বলেন, কোনো সাবেক প্রেসিডেন্টের বিচার করা যাবে না, এটা অদ্ভুত কথা। ইতিহাসে তেমন বিচারের অনেক উদাহরণ রয়েছে। শুধু শাসনতান্ত্রিক বলেই নয়, সাধারণ বিচারবুদ্ধিও বলে এই বিচার অপরিহার্য।
রিপাবলিকানদের প্রধান যুক্তি, ট্রাম্প তো ক্ষমতায় নেই, তাহলে তাঁকে নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি কেন? একজন রিপাবলিকান নেতা বলেছেন, এই বিচার যদি চলতে দেওয়া হয়, তাহলে হেন সাবেক প্রেসিডেন্ট নেই, যাঁকে এরপর বিচারে টেনে আনা যাবে না। এমনকি দাস রাখার অপরাধে প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনেরও বিচার হতে পারে।
যে ৫ জন রিপাবলিকান সিনেটর বিচারের পক্ষে ভোট দেন, তাঁদের কেউ কেউ ডেমোক্র্যাটদের যুক্তির সঙ্গে একমত। যেমন আলাস্কা থেকে নির্বাচিত সিনেটর লিসা মুরকাউস্কি বলেন, অভিশংসন বিচারের উদ্দেশ্য শুধু একজন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে বহিষ্কার নয়, তাঁর কৃতকর্মের শাস্তির বিধান করাও।
শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য এই যুক্তি মানেন না। তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, মার্কিন ইতিহাসে ক্ষমতা ত্যাগের পর অভিশংসন ও বিচারের বিস্তর উদাহরণ রয়েছে। ‘সাবেক’ এই কারণে বিচার থেকে রক্ষা পাওয়া গেলে তো অপরাধীমাত্রই বিচারের আগে পদত্যাগ করে বলতে পারেন, আমি আর ক্ষমতায় নেই, অতএব বিচার অশাসনতান্ত্রিক। ১৮৭৬ সালে একজন যুদ্ধমন্ত্রী সেই মতলবে অভিশংসন বিচারের কয়েক দিন আগে পদত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু বিচার থেকে রক্ষা পাননি।
সে উদাহরণ দিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা আইনবিশারদ অধ্যাপক লরেন্স ট্রাইব বলেছেন, শাসনতন্ত্রে স্পষ্ট বলা আছে, ঘুষ, রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার মতো বড় অপরাধের জন্য অভিশংসিত করা যাবে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে এমন ব্যক্তিকে ভবিষ্যতে ক্ষমতা থেকে স্থায়ী বহিষ্কার ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে।
ডেমোক্র্যাটরা অভিশংসনের এই শাস্তির বিধানের ওপর জোর দিয়েছেন। ক্ষমতা থেকে সরে গেলেও ট্রাম্প এখনো অনেক ক্ষতি করতে সক্ষম। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ তাঁর অনুগত সমর্থক। তিনি এখনো এদের উসকে দিতে পারেন।
যে ৫ জন রিপাবলিকান সিনেটর বিচারের পক্ষে ভোট দেন, তাঁদের কেউ কেউ ডেমোক্র্যাটদের যুক্তির সঙ্গে একমত। যেমন আলাস্কা থেকে নির্বাচিত সিনেটর লিসা মুরকাউস্কি বলেন, অভিশংসন বিচারের উদ্দেশ্য শুধু একজন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে বহিষ্কার নয়, তাঁর কৃতকর্মের শাস্তির বিধান করাও।
লক্ষণীয় যে সিনেটে রিপাবলিকানদের নেতা মিচ ম্যাককনেল বিচারের বিপক্ষে ভোট দেন। এর আগে তিনি কংগ্রেসে হামলার পেছনে ট্রাম্পের উসকানি কাজ করেছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। তিনি বিচারে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করতে আগ্রহী, এমন ইঙ্গিতও পাওয়া গিয়েছিল, যদিও মুখ ফুটে বলেননি ঠিক কীভাবে ভোট দেবেন। অনেকে ভেবেছিলেন, ম্যাককনেল ট্রাম্পকে দল থেকে ছেঁটে ফেলতে আগ্রহী।
মঙ্গলবারের পদ্ধতিগত ভোটে তিনি বিচারের বিপক্ষে ভোট দেওয়ায় কেউ কেউ বিস্মিত হয়েছেন। তবে বিচারকাজে সওয়াল-জবাবের পর সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তিনি যদি মত বদলান, তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
ওহাইওর বিদায়ী সিনেটর রব পোর্টম্যান সে কথাই বলেছেন। তাঁর কথায়, ভোটদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি সব যুক্তি-প্রমাণ যাচাই করে দেখতে চান। সাউথ ডাকোটার সিনেটর জন থুন মনে করেন, যাঁরা বিচারের বিপক্ষে ভোট দিলেন, তাঁরা যে নিজেদের মত বদলাবেন না, সে কথা ভাবার কোনো কারণ নেই।
অধিকাংশ নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক অবশ্য মনে করেন, এই ভোট থেকেই ঠাওর করা যায়, ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করতে ১৭ জন রিপাবলিকান সিনেটরের ভোট কিছুতেই মিলবে না। এই দলে এবং তৃণমূল পর্যায়ে ট্রাম্পের প্রভাব এখনো বিপুল। তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে নিজেদের রাজনৈতিক বিপদ ঘাড়ে নিতে ৫-৭ জনের বেশি রিপাবলিকান সিনেটর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
সে কথা স্বীকার করে ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে পরিচিত রিপাবলিকান ভাষ্যকার ম্যাক্স বুট বলেছেন, বিচারের কাঠগড়ায় একা ট্রাম্প নন, পুরো রিপাবলিকান দল। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, গত চার বছর এই নেতারা ট্রাম্পের সব অপরাধ মেনে নিয়েছেন। এবারও মানবেন, তা প্রায় অবধারিত। কিন্তু ভবিষ্যতে যখন আবার ৬ জানুয়ারির মতো বিদ্রোহের ঘটনা ঘটবে, তাতে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তাঁরা কিছুতেই এড়াতে পারবেন না।