জলময়ূরী

তাহসান আমার কলেজজীবনের বন্ধু। দীর্ঘ দিন যোগাযোগ নেই আমাদের। এক শহরে থাকি। কিন্তু দেখা-সাক্ষাৎ তো দূরের কথা, টেলি যোগাযোগ পর্যন্ত নেই গত কয়েক বছর। হঠাৎ করেই সেই তাহসান ফোন করল আজ।
-হ্যাঁ, তাহসান! কেমন আছিস?
-দোস্ত, খুব খারাপ, ভয়াবহ খারাপ। ভয়ানক বিপদে আছি রে! তুই কেমন আছিস?
-ভালো। কী খবর বল?
-মেয়েটাকে নিয়ে খুব পেরেশানে আছি। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। তুই কি একদিন আমাদের বাসায় আসবি?
-মেয়েকে নিয়ে পেরেশানে মানে?
-নূরি চলে যাওয়ার পর মেয়েটা একা হয়ে পড়েছে! খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। আর কথা বলছে না একদম...
-নূরি ভাবি চলে গেছে মানে? কি বলিস!
-তোর ভাবি আর নেই! সে আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে।
এই বলে তাহসান হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল। আমি যেন দিশাহীন হয়ে পড়লাম। কী বলে তাকে একটু সান্ত্বনা দেব, বুঝে উঠতে পারলাম না! তাই আমিও ফোন ধরে চুপ থাকলাম। একটু পর বললাম, ‘দোস্ত, আমাদের একদিন সবাইকেই এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এইটা ছিল জাস্ট ভাবির চলে যাওয়ার সময়। আমরা তার জন্য বেহেশত কামনা করে প্রার্থনা ছাড়া আর কী করতে পারি? তুই একটু শান্ত হ!’
তাহসান চুপ করে রইল। কোনো কথা বলল না।
মনের অজান্তে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আমি কিছুটা নস্টালজিক হয়ে পড়লাম। ভাবি আমাদের ইয়ারমেট ছিল। আমরা কত আড্ডা করেছি, মজা করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। তাহসানের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও, ভাবির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ ছিল। চন্দ্রমুখী নূরি ভাবি আর নেই ভাবতেই গলা ধরে এল। শেষবার যখন কথা হয়েছিল নূরি ভাবি বলেছিল, ‘তোদের মান-অভিমান আর কত দিন চলবে? শুধু অভিমান নাকি রাগও আছে তোর?’ ‘ছোটখাটো রাগও আছে’, শুনে বলেছিল—‘শোন মেঘ, রাগ থাকা আর এটাকে পুষে রাখা বিপজ্জনক।’
-যেমন?
-রাগ বা Anger-এর আগে D বসে গেলে কী হয়? D+Anger = Danger, রাইট? তোরা দুজনই ছোটখাটো বিষয়ে রিঅ্যাক্ট করিস বেশি! আমাদের জীবনটা আমাদের যাপিত জীবনের কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে আমরা কেমন রেসপন্স করি, তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে যে, আমাদের জীবন কত সুন্দর হবে, নির্ভার কিংবা জটিল হবে। জীবনে ভালো থাকার জন্য Action দরকার, Reaction-এর দরকার খুব একটা নেই। বুঝেছিস?
-হু!
-হু মানেটা কী?
-হু, মানে হু!
-আচ্ছা তোর ওই অজগর, কাঠুরে আর তার কুড়ালের গল্পটা মনে আছে?
-আছে ভাবি
-তোর কাছেই প্রথম এই গল্পটা আমি আর তাহসান শুনেছিলাম! বিয়ের পর নিউইয়র্ক এসে তাহসানের সঙ্গে রাগ করে আমি যখন দেশে ফেরত যেতে চেয়েছিলাম, তুই এই গল্পটা বলেছিলি! তুই বলেছিলি, অজগর কুড়ালের ওপর রাগ করে তাকে ছোবল মারতে গিয়ে, শোধ নিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিল! অজগর সাপটা যদি রিঅ্যাক্ট না করে শান্ত হয়ে চলে যেত, সে বেঁচে যেত। গল্প থেকে নিজে যদি কিছু না শিখিস, অন্যকে এই গল্পগুলো বলিস কেন, মেঘ?
এই সব ভাবছি আর মনটা খুব ভারী হয়ে উঠল! তাহসান বলল, ‘তুই কি একদিন বাসায় আসতে পারবি?’
-ঠিক আছে। আমি নিশ্চয়ই আসব।

দুই.
পরদিন সকালে তাহসানের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হলাম। করোনাভাইরাসের কারণে বাস-ট্রেন নিউইয়র্ক শহরে বিরল হয়ে গেছে। আগে প্রতি তিন মিনিট পরপর বাস, ট্রেন আসত! এখন ৩০-৪০ মিনিট পরপর আসছে। প্রথম যখন করোনা-আক্রান্ত রোগী নিউইয়র্কে শনাক্ত হয়, তার ৫৫ দিন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ১১ জন ছিল। তার ১৫-২০ দিন পর এখন তা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ। আর এখন প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। পুরো নিউইয়র্ক নগরী যেন এক মৃত্যুপুরী! হাসপাতালে করোনা রোগীর ভিড়ে ঠাসাঠাসি। চারদিকে লাশ আর লাশ।
বড় বড় হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি নেওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। সব হোটেলকে সেনাবাহিনী হাসপাতাল বানিয়েছে। নৌবাহিনী তাদের রণতরী দিয়ে এক হাজার শয্যার হাসপাতাল তৈরি করেছে। সেখানেও তিল ধারণের জায়গা নেই আর। এখন খোলা আকাশের নিচে তাঁবু খাঁটিয়ে অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করে চিকিৎসা চলছে। থেকে থেকে অ্যাম্বুলেন্সের হৃদয় বিদীর্ণ করা চিৎকারে সুনসান নীরবতা যেন ধসে পড়ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত চিকিৎসার দেশ, প্রতাপ ও পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রের দশা যখন এই, খোদা না করুক, একবার শুরু হয়ে গেলে বাংলাদেশের অবস্থা কী হবে ভাবতেই গায়ের সব লোম কাঁটা দিয়ে উঠল! আহারে আমার সোনার দেশ! মানুষ সেখানে এখনো পিকনিকের মুডে আছে। তাদের ৯৯ শতাংশ মানুষ বুঝতেই পারছে না পুরো পৃথিবী কী দুঃসহ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে!
পুরো নিউইয়র্ক শহর লকডাউন করে দেওয়ায় লোকজনের সমাগম খুব একটা নেই। ট্রেনের অনেক বগি খালি। কোনো কোনো বগিতে ৪-৫ জন যাত্রী। কোনোটা একদম জনশূন্য।
মেট্রো-টেক স্টেশনে ট্রেন থামতেই আমাদের বগিতে দুজন পুলিশ উঠল। আমার সামনে বসা মেয়েটিকে কী যেন জিজ্ঞেস করল। তারপর কিছু একটা হাতে ধরিয়ে দিল মনে হয়। এবার আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোথায় যাচ্ছি। আমি লকডাউন না মেনে কেন বাইরে? আমি বললাম, ‘আমার বন্ধুর স্ত্রী ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেছেন। তাই তাঁকে সান্ত্বনা দিতে...
কথা শেষ না হতেই ৫০০ ডলারের জরিমানার টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘উই আর ভেরি সরি, স্যার! প্লিজ স্টে হোম অ্যান্ড মেইনটেন ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্স। প্লিজ ব্যাক হোম অ্যান্ড কাউন্সিল ইউর ফ্রেন্ড ওভার টেলিফোন।’
পরের স্টেশনে পুলিশ নেমে যেতেই মেয়েটি চোখ মুখ লাল করে বলল, ‘হোয়াট আ ফাক! থ্রি হান্ড্রেড ডলার টিকিট! আম ফাকড-আপ! হোয়াট অ্যাবাউট ইউ হানি?’
-সো আই অ্যাম। ফাইভ হান্ড্রেড ডলার!

তিন.
মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঘরবন্দী এক মাসের বেশি। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরে কাজ না করে টিকে থাকা দায়। তাই ৫০০ ডলার এই মুহূর্তে অনেক টাকা। এক সপ্তাহের বাজার চলত। বিনা কারণে বাইরে বেরোলেই ৩০০ থেকে ৫০০ ডলার জরিমানা হচ্ছে শুনেছিলাম। তবুও তাহসানের ওখানে যাচ্ছিলাম; কারণটা ভিন্ন। অভিমান করে পাঁচটি বছর আমরা কেউ কাউকে ফোন করি না। বন্ধুর স্ত্রী মারা গেছে, অভিমান করে বসে থাকা যায়?
বাসায় ফিরে এসে সাবান দিয়ে ভালোমতো হাত ধুয়ে নিলাম। ২০ সেকেন্ডের জায়গায় ৩০ সেকেন্ড। তারপর ‘রাবিং অ্যালকোহল দিয়ে হাত কচলে নিলাম। বাড়তি সাবধানতা। তারপর তাহসানকে ফোন দিলাম। তাহসান কথাই বলতে পারছে না। শুধু কাঁদছে। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। তাহসানকে জিজ্ঞেস করলাম ভাবির কি হয়েছিল?
-তোর ভাবি তো কাজ করত না। বাসায় থাকত। একদিন হঠাৎ ঠান্ডা, জ্বর আর হালকা কাশি হলো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বললেন, সিজনাল জ্বর। ৫-৭ দিনে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে ১০৪ ডিগ্রি হয়ে গেল। একটু শ্বাসকষ্ট আর ডায়রিয়াও দেখা দিল। সারা শরীরে ব্যথা শুরু করলে ডাক্তারকে ফোন দিলাম। ডাক্তার বললেন, আমরা চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছি, এখন টেলিফোনেই চিকিৎসা দিচ্ছি। উপসর্গ শুনে ডাক্তার বললেন ৯১১ নম্বরে ফোন দেওয়ার জন্য।
-বলিস কী?
-সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স চলে এল। বেলভ্যু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানেই সাত দিন চিকিৎসা নিয়ে...
- কাঁদিস না। মানুষের জন্মই হয় মৃত্যুর জন্য। না মরলে সে বেহেশতের স্বাদ নেবে কী করে?
-বন্ধু, মানুষ মারা যাবে, সেটাই সত্যি। কিন্তু এটা কেমন মৃত্যু? যে মৃত্যু সংবাদ শুনে মানুষ পালিয়ে যায়! বন্ধু-স্বজন সবাই দূরে সরে যায়—এ কেমন মানবিকতা? মৃত্যুকে আমাদের কেন এত ভয়? কেউ কি মৃত্যুকে এড়িয়ে যেতে পারবে? তাহলে কেন আমরা একে অন্যের বিপদে এগিয়ে যাচ্ছি না?
-হয়তো-বা পৃথিবীর মানুষের আরেকটু সাহসিকতার সঙ্গে করোনা মোকাবিলা করা উচিত ছিল। হয়তো আতঙ্কেই বেশির ভাগ মানুষ মারা যাচ্ছে, কে জানে।
-আমার মনে হয় তাই। তোর ভাবি সিডিসি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট ঘেঁটে করোনার উপসর্গ দেখেই নিশ্চিত হয়েছিল যে, তার করোনা পজিটিভ হবে। তারপর আতঙ্কেই বুঝি মারা গেল!
-বলিস কি? কিন্তু তুই যে বলছিলি ভাবি বাসায় থাকত, জব করত না! তাহলে কিভাবে তার করোনা দেখা দিল?
-সম্ভবত আমিই করোনার ক্যারিয়ার! আমি অনেকটা নিশ্চিত আমারও করোনা আছে! কিন্তু কী করব? আমাদের মেয়েটার বয়স মাত্র সাত বছর। আমাদের কেউ নেই নিউইয়র্কে! আমি আসলে চাইছিলাম, পুতুলকে বউদির কাছে...
-তাহসান! কাউকে বলবি না, আমি কাউকেই বলিনি। তোর বউদির সঙ্গে আমি আর থাকি না। আমরা গত মাস থেকে আলাদা বাসায় থাকি। আলাদা থাকি মানে, তোর বউদি নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
-বলিস কি!
-দুঃখজনক, কিন্তু সত্যি।
-তুই একা থাকিস?
-নাহ।
-তাহলে কি তুই আবার...
-না, না! বড় মেয়ে আমার কাছে চলে এসেছে। বাপ-বেটির সংসার।
-আমি যে কী করব ভেবে পাচ্ছি না। মেয়েকে কোথাও, কারও কাছে দিয়ে যেতে পারলে হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করাতাম। আমি নিশ্চিত আমার থেকেই তোর ভাবি...

চার.
পুতুল এখন আমাদের এখানে। সাত বছরের বাচ্চা মেয়েটা মনে হয় বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। চুপচাপ সারা দিন কার্টুন আর নাটক দেখে। মাঝরাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। মেয়েটার জন্য কষ্টে বুকটা চৌচির হয়ে যায়। ওর দিকে তাকালে বুকটা ফেটে যায়। একবার ভাবলাম, গিন্নিকে ফোন দিয়ে ঘটনা বলি আর পুতুলকে ওদের কাছে পাঠিয়ে দিই। আবার ভাবলাম, পিচ্চিটার আর যন্ত্রণা না বাড়াই। আমাদের এখানেই সে মানিয়ে নিয়েছে।

পাঁচ.
তাহসান যা ভেবেছিল, তাই। তার করোনা টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ। একদম ভেঙে পড়েছে সে। আমি যত বলছি শক্ত হতে, সে ততই যেন দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে ঠিক, কিন্তু সুস্থ হওয়ার জন্য দোয়া চাইছে না। ওপারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রতিদিন।
তাহসানকে শেষ দেখা দেখতে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। সে ট্যাক্সি চালাত। আমি বলতাম, ট্যাক্সি চালানো বাদ দে। আইটি প্রশিক্ষণ নে। আর ১০টা মানুষের মতো হেরে যাওয়ার জন্য আমাদের জন্ম হয়নি। তাহসান বলত, ‘এই দেশে আমাদের জেনারেশন কিছু করতে পারবে না। তুই খামোখা আইটি-ফাইটি নিয়ে বসে থাকিস না। এই নিয়েই আমাদের দূরত্ব বাড়ে।’
শেষবার যখন ফোনে কথা হয়, তখন সে বলছিল—গত মাসেই পিপল এন টেকে সফটওয়্যার টেস্ট অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছিল সে। নতুন জবে জয়েন করেই আমাকে ফোন দিয়ে ‘সারপ্রাইজ’ দেবে বলে প্ল্যান করেছিল। কী করার? ম্যান প্রপোজেস, বাট গড ডিসপোজেস। সে যাই হোক। তাহসান স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। ‘স্বপ্নেরা মরে না কখনো।’
তাহসানের স্বপ্ন নিশ্চয়ই পুতুলের মাঝে বেঁচে থাকবে! স্বপ্নটা একটু একটু করে বড় হবে। তাহসান দেখে যেতে পারেনি বলে তার দুঃখ থাকবে হয়তো। আসলে স্বপ্ন পূরণটা দেখে যেতে পারল কি পারল না, সেটা খুব একটা বড় বিষয় নয়, স্বপ্ন বেঁচে আছে সেটাই বড় বিষয়।

ছয়.
গত তিন-চার দিন ধরে ঠান্ডা, জ্বর, কাশি বাড়ছে তো বাড়ছেই। আজ ডাক্তারের কাছে যাব ভাবছি। আমার অসুখে বড় মেয়েটা খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। তার ধারণা, আমার বন্ধু তাহসান আমাকে ইনফেকটেড করে দিয়ে গেছে। মেয়েটা কাছে এসে বলল, ‘বাবা, আমি ৯১১ কল করেছি। এখনই অ্যাম্বুলেন্স আসবে তোমাকে নিতে। তুমি তৈরি হও।’
আমি কিছু বলার আগেই বলল, ‘মা হাসপাতালে চলে গেছে আগেই। মা-ই আমাকে ৯১১-এ কল দিতে বলে দিয়েছে। আমি দুঃখিত, বাবা। আমাদের এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। তুমি একদমই কথা শুনো না, নিজের যত্ন নাও না।’
আকাশ বাতাস ভারী করে অ্যাম্বুলেন্স আসছে। বাসার সামনে এসে থামল মনে হলো। আমিও তাহসানের মতো একটু প্যাসিমিস্টিক হয়ে পড়েছি মনে হয়। ঠিক এই মুহূর্তে আমার মন প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে চলে গেছে। অনেক প্রিয় মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তাদের সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না ভাবতেই পুরো হৃদয়টা হাহাকার করে উঠল।
আমার একটা ছোট্ট স্বপ্ন ছিল। শালবনের ভেতর একটা কলেজ হবে। মুহূর্তেই বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল যেন। আমি যদি মরে যাই, স্বপ্ন বেঁচে থাকবে তো? আমার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য থেকে কি স্বপ্নের বীজটায় জল ঢালবে কেউ? ভাবছি।
না, না। এত সহজে ভেঙে পড়লে চলবে না। আমাকে শক্ত থাকতে হবে। বাঁচতে হবে। নূরি ভাবি আর তাহসানের স্বপ্ন পুতুলকে মানুষ করতে হবে। করোনার সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হতে হবে পুতুলদের জন্য।
স্ট্র্যাচারে করে তুলে অ্যাম্বুলেন্সের দরজা বন্ধ করে দিল।

সাত.
ইমার্জেন্সি গেটে গিয়ে দেখলাম, আমার গিন্নি দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে দৌড়ে এল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল...
তার কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠল। চিৎকার করে কাঁদছে ...
আমি এবার ভাবছি অন্য কথা। নূরি ভাবি এক মেয়ে জন্ম দিয়ে জলময়ূরীর মতো চলে গেল। তাহসানের বউদিও অনেকটা জলময়ূরীর মতোই চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পারল না। ফিরে এসেই কান্নাকাটি—যেন আমি মারা গেছি!
মানুষ যত মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছায়, তত তার বাঁচার আকাঙ্ক্ষা বাড়ে। আমারও এখন বাঁচতে ইচ্ছে করছে। তবে মৃত্যু ভয় আমার নেই। সমাজে, রাষ্ট্রে কিংবা পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়। আমিও নই—ভাবতেই নিজেকে নির্ভার লাগছে।
কান্না থামছে না। আমি বললাম, ‘কান্না থামাও।’
তার কান্না আওয়াজ যেন আরও বেড়ে গেল।
কান্নার বিকট আওয়াজে চোখ মেলে দেখি পুতুলের খালা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কী বিষয়?
সে বলল, দেশের অনেক প্রিয় মুখ চোখের সামনে ভাসছে। আমার খুব কান্না পাচ্ছে...