ঘুমন্ত নগর দেখতে যেমন

সুনসান নিরব জাতিসংঘ সদর দপ্তর এলাকা। ছবি: সাগ্রে চিসিম তূর্য
সুনসান নিরব জাতিসংঘ সদর দপ্তর এলাকা। ছবি: সাগ্রে চিসিম তূর্য

কিছুক্ষণ পরপরেই অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বেজে চলেছে বাসার দুই দিকের রাস্তায়। ভয়াবহ সে চিৎকার! চারিদিক থম থমে ভাব। প্রায় এক মাস ধরে আমাদের প্রতিবেশীদের কেউ বাইরে যাচ্ছে না। নিউইয়র্ক শহর থেকে ৩০ মিনিট ড্রাইভ দূরত্বে আমাদের বাসা।

গত ১ মাস সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে ছিলাম। ঘরে বসে ‘হোম অফিস’ করেছি। কাজ তেমন নেই। পত্রিকা পড়ছি, বই পড়ছি, ছোট গল্প লিখছি, টিভি দেখছি, মাঝে মাঝে রান্না করছি, বন্ধুদের ফোন করছি। কিন্তু সময় কাটছে না।

মন ভালো নেই। ১১ এপ্রিল বিকেল ৩টায় ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার ও নিউইয়র্ক পুলিশ বিভঅগের অক্সিলারি পুলিশ কর্মকর্তা সাগ্রে চিসিম তুর্যকে নিয়ে বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বের হলাম।

ব্রুকলিনের ক্রস স্ট্রিট, ক্রিসেন্ট রোড ও ১০১ অ্যাভিনিউ থেকে নিউইয়র্ক শহরের পথে বের হলাম। উড হেভেন বেলভিউ হয়ে গেলে দূরত্ব প্রায় ১০-১২ মাইল। ৩০ মিনিটের মতো সময় লাগতে পারে!

প্রথমেই একটা গ্যাস স্টেশনে থামলাম। দেখলাম ৫-৭ জন যুবক রেসিং মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় খেলা করছে! আমাদের গাড়ির সামনে পেছনে ৫-৭টা প্রাইভেট কার। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, তাঁরাও আমাদের মতো কোন জরুরি প্রয়োজনেই বের হয়েছে। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর ডানে একটা পার্ক চোখে পড়ল। সেখানে কয়েকটা পরিবার তাঁদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে বসে আছে। মনে মনে ভাবছি, কি অদ্ভুত মানুষগুলো, এর মধ্যেও পার্কে ঘুরছে, যেন কিছুই হয়নি।

নিউইয়র্ক শহরে ঢুকছি। যেন ক্লান্ত শহর ঘুমিয়ে আছে। ডানে, বায়ে দেখলাম, শহরটা যেন দিনের বেলাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে! দোকান-পাট, রেস্টুরেন্ট এমনকি ব্যাংকও বন্ধ। ২-৪ জন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পুলিশের টহল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিছু প্রাইভেট কার, ২-১টি যাত্রীশূন্য পাবলিক বাস।

আমরা ম্যানহাটনের ১ অ্যাভিনিউ ধরে আপটাউনের দিনে যাচ্ছি। ফাস্ট অ্যাভিনিউয়ের ৫-৬ স্ট্রিটের ৯১ হাউসের দিকে চোখ তুলে তাকালাম। এখানে বাংলাদেশের চির তরুণ ডমিনিক থাকেন। তাঁর বয়স ৮৫ বছর। আজ থেকে ৫০ বছর আগে ৩৫ বছর বয়সে তিনি এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গে আরোহণের চেষ্টা করেছিলেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি যুবক, যিনি প্রথম এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা করেছিলেন। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। ৩৫ বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। করোনার উপসর্গ নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শে প্রায় ২ সপ্তাহ ধরে কোয়ারেন্টিনে আছেন।

ডমিনিকের বাসা পার হয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাই। যে শহরে শত শত সাইকেল আরোহী পাওয়া যায়, সেই শহরে দু–একটার বেশি সাইকেল পাওয়া গেল না। রাস্তার ডানে বায়ে পার্ক করা রয়েছে শত শত সাইকেল।
সামনে গোটা পঞ্চাশেক অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিডিও রেকর্ডিং শুরু করলাম। বেলভিউ হাসপাতালের সামনে এসে পড়েছি। ভিড় নেই খুব একটা। সুনসান নীরবতা। তবে এতগুলো অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ভয়াবহতার তীব্রতা বুঝতে পারছি। সাগ্রেকে বললাম, আমরা জাতিসংঘ সদর দপ্তর হয়ে টাইম স্কয়ার যাব।

জাতিসংঘ সদর দপ্তরে গিয়ে দেখা গেল, সব দেশের জাতীয় পতাকা নামান। দু-একজন সিকিউরিটি ছাড়া সেখানে কাক–পঙ্খি দেখা গেল না। অন্যান্য সময়ে অফিস বন্ধ থাকলেও শত শত মানুষের ভিড় থাকে সেখানে। অনেক দর্শনার্থী ছবি তোলে। এবার গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টো পথে ২ অ্যাভিনিউতে উঠলাম। এখানে ৪-৫টি পাবলিক বাস চলতে দেখা গেল। বাস চলছে, কিন্তু যাত্রী শূন্য!

হাজারো বাঙালির আড্ডা, গল্প চলে সারা দিন, সেটি বন্ধ! কোন মানুষের চিহ্ন দেখা গেল না।

পাশে ইত্যাদি বাজারে। তার সামনে ১০-১৫ জনকে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বজায় রেখে দাঁড়ানোর চেষ্টা দেখা গেল। দুই/চারজন নিয়ম মানতে অনিচ্ছুক মনে হলো।

গ্রোসারিতে প্রয়োজনীয় কেনাকাটায় সামাজিক দুরত্ব মেনে চলছেন সবাই।  ছবি: সাগ্রে চিসিম তূর্য
গ্রোসারিতে প্রয়োজনীয় কেনাকাটায় সামাজিক দুরত্ব মেনে চলছেন সবাই। ছবি: সাগ্রে চিসিম তূর্য

কাবাব কিংয়ে ফিরে এসে এবার ডাইভার্সিটি প্লাজার দিকে তাকালাম। এখানে এশিয়ার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ তো বটেই, স্প্যানিশ, গায়ানিজ, ত্রিনিদাদের মানুষের ভিড় লেগে থাকে। বহুজাতিক মানুষের আড্ডাস্থল এই ডাইভার্সিটি প্লাজা! হাজার হাজার মানুষ এখানে বসে আড্ডা দেন, তাঁদের প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটান। এই ডাইভার্সিটি প্লাজা যেন এক মৃত্যুপুরী এখন। দুই-একজনকে হেঁটে যেতে দেখা গেল। সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, দুজন স্প্যানিশ প্রকাশ্যে বিয়ার খাচ্ছেন! দূর থেকে জুম করে ছবি তুলছি বুঝতে পেরে নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু বিয়ার লুকালেন না। ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, কেন ছবি তুললেন। আমি মুচকি হেসে আমার কার্ড দেখিয়ে দিলাম। আর অমনি একজন আবার বিয়ারে চুমুক দিয়ে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে পোজ দিলেন। আমি তাঁদের অদূরে পুলিশের গাড়ির দিকে আঙুল দিয়ে দেখালাম। লোকটি হাত নেড়ে বললেন, ‘আহ!’

পেছন ফিরে তাকাতেই অয়েন্ডিস বিল্ডিংটা দেখা গেল। একটা পাবলিক বাস একজন যাত্রী নিয়ে ছুটে চলছে! ওপরে জনশূন্য ট্রেন স্টেশন!

আমরা উত্তর আমেরিকার প্রথম আলোর অফিসের সামনে দিয়ে ফিরব। ফেরার পথে ডানে একটা বন্ধ ব্যাংক, আর ডেরা রেস্টুরেন্ট! এত কিছুর মধ্যেও এটি খোলা! ভেতরে গোটা ২০-৩০ জন গ্রাহকের লাইন!

বায়ে টার্ন নিয়ে প্রথম আলো অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছি আরেক মিনি বাংলাদেশ ওজোন পার্ক এলাকায়। বাঙালিদের প্রিয় গ্রোসারি মান্নান সুপার মার্কেট বন্ধ। অন্যান্য দোকানপাটও সব বন্ধ। মান্নান সুপার মার্কেটের উল্টোদিকে ম্যাকডোনাল্ডস, গোল্ডেন ফার্ম সুপার মার্কেট খোলা।
আল হক ফার্মেসি বন্ধ। দরজায় দুটি ফোন নম্বর দিয়ে লেখা, ফোন করুন! ফোন দিলাম, এক যুবক এসে দরজা খুললেন। জিজ্ঞেস করলেন, প্রেসক্রিপশন আনছেন?

আল হকের উল্টো পাশে বাংলা বাজার সুপার মার্কেট। বন্ধ মনে হলো। কিন্তু ভেতরে কিছু গ্রাহক দেখা গেল। তার পাশে রাস্তার ওপারে ওয়াল গ্রিন খোলা, লম্বা লাইন।

ওজোন পার্ক এলাকায় অনেক বাঙালিকে বিনা কারণেই ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল! এঁদের অনেকেই যুবক। কিছু বয়োবৃদ্ধ। কিছু মহিলাকেও দেখা গেল।

নিউইয়র্কের অনেক জায়গা ঘুরে যেটি মনে হলো, কিছু মানুষ সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং নিয়ে মোটেও চিন্তা করেন না। ২৫০ থেকে ১০০০ ডলারের জরিমানা হওয়ার কথা থাকলেও পুলিশও কিছুটা মানবিকতা দেখাচ্ছে। কারণ তাঁদের নাকের ডগায় কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে গালগল্পও করছেন! এ দলে সাদা-কালো যেমন আছে, স্প্যানিশও আছে। তবে সব ছাপিয়ে বাঙালি একটু বেশিই! দেশের মানুষের প্রতি আলাদা ভালোবাসা থেকেই হয় তো এমনটি মনে হয়েছে। আমার মনে হওয়াটা মিথ্যে হলে আমি খুশি হব।