অনিন্দ্যসুন্দরী কামরাঙ্গী থেকে কামরাঙ্গীরচর

বুড়িগঙ্গার ভেতর ‘ওই দেখা যায়’ কামরাঙ্গীরচর l ছবি: আশরাফুল আলম
বুড়িগঙ্গার ভেতর ‘ওই দেখা যায়’ কামরাঙ্গীরচর l ছবি: আশরাফুল আলম

এখন কামরাঙ্গীরচরে যাওয়া-আসা সহজ। লালবাগ দিয়ে লোহার ব্রিজ পার হয়ে যেমন চরটিতে পৌঁছানো যায়, তেমনি সদরঘাট থেকে ট্রলারেও যাওয়া যায়। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর ছাড়ে। ভাড়া ১২ টাকা।

কামরাঙ্গী নামের এক অনিন্দ্যসুন্দরী বাস করতেন বুড়িগঙ্গার চরে। একদিন নদী পার হওয়ার সময় নৌকা ডুবে তাঁর মৃত্যু হয়। তখন তাঁর প্রেমিক যুবক ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ‘হায় কামরাঙ্গী’, ‘হায় কামরাঙ্গী’ বলে গগনবিদারী চিৎকার শুরু করেন। চারদিকে কেবল উত্তাল ঢেউ, কোথাও নেই কামরাঙ্গী—এ দৃশ্য দেখে যুবক বুড়িগঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। নদীতে রচিত হয় যুগল প্রেমের সমাধি। সেই থেকে ওই চরের নামকরণ হয় কামরাঙ্গীরচর (কিংবদন্তির ঢাকা, লেখক নাজির হোসেন)।

কামরাঙ্গীরচর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিল ঢাকার মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ বুড়িগঙ্গার একটি দ্বীপ। আট মাস শুকনো আর চার মাস পানির নিচে—এই ছিল এখানকার বাসিন্দাদের নিয়তি। ধান, ডাল, সরষে ফলত। লেখাপড়া বলতে প্রধানত ছিল মাদ্রাসাশিক্ষা। ১৯৯১ সালে প্রথম ‘হাক্কুল এবাদ লোহার ব্রিজ’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে লালবাগের সঙ্গে যুক্ত হয় চরটি। এরও ১০ বছর পরে হয় নদী রক্ষা বাঁধ (বেড়িবাঁধ)।

চরে স্থানীয় ধনী ব্যক্তিদের যেমন বসবাস, তেমনি দরিদ্র নিম্নবিত্তদের সংখ্যাও হাজারে হাজারে। এখানে ১০ তলা ভবন যেমন আছে, তেমনি আছে বেজায় ঘিঞ্জি এলাকা। এখানকার রাস্তাঘাটগুলো সব সময় যানবাহনে পূর্ণ থাকে। পুরো চরে শত শত কারখানা, যেখানে কাজ চলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। আর এসব কারখানায় শিশুশ্রম খুবই মামুলি ব্যাপার।

কামরাঙ্গীরচর ঘাটে স্থানীয় ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষনির্বিশেষে গোসল সারেন। বুড়িগঙ্গার এদিককার পানি তুলনামূলক কম দূষিত, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে।

বেড়িবাঁধ সড়কের তীরে সৃজিত হয়েছে নানা ধরনের গাছ। বেল, কতবেল, নারকেল, পেয়ারা, জলপাই। মুক্ত বাতাসের লোভে বিকেলবেলা আশপাশের জনপদ থেকে অনেকেই এখানে দুদণ্ড সময় কাটান। তবে কামরাঙ্গীরচরে অপরাধ কম নয়। মাদক ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত। সামাজিক অপরাধ দমনের তাগিদ থেকেই ১৯৯৮ সালে হয় কামরাঙ্গীরচর থানা।

তবে অপরাধ রুখে কামরাঙ্গীরচরকে একটি আলোকিত জনপদ বানাতে চান, এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। এক বছরের মধ্যে অন্তত চারবার চরটিতে যাওয়ার সুবাদে বলা যায়, কিছু মানুষ আছেন বলেই এলাকাটি সামাজিকভাবে অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে। একজনের নাম শহীদ হোসেন, তাঁর ব্যবসা ইট-বালুর। আরেকজন মো. হাবিব, বাবুবাজারে কাপড়ের ব্যবসা। ইমাম হোসেন করেন কাঠের ব্যবসা। আর মো. জামানের আছে পোশাক কারখানা। তাঁদের মধ্যে জামান বাদে কেউ এসএসসি পাস করেননি। কিন্তু আজ থেকে ১০ বছর আগে কামরাঙ্গীরচরে তাঁরা গড়ে তোলেন বুড়িগঙ্গা গণপাঠাগার, যে পাঠাগার বুড়িগঙ্গা পারে চেতনার বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। এখানে আরেকটি পাঠাগার আছে, নাম জাগরণী পাঠাগার। কবি নির্মলেন্দু গুণ এই পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত। অনেক বছর ধরেই চরটিতে বসবাস করছেন তিনি।

কামরাঙ্গীরচরে একটি মহিলা সমবায় সমিতির নির্বাহী কর্মকর্তা স্বপন রায়। সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে কিস্তি আদায় এবং তাঁদের মধ্যে ঋণদানই সমিতির কাজ। এ ছাড়া সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের অধীনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে এই সমিতি। সম্প্রতি সমিতির অনুষ্ঠানে গেলে স্বপন বলেন, চরের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র, বিশেষ করে যারা স্থানীয় নয়। সাধারণত শ্রমিকশ্রেণির মানুষেরা পরিবার নিয়ে চরে বসবাস করে। ঘরভাড়া তুলনামূলক কম। তাঁর পর্যবেক্ষণ, এখানকার দরিদ্র নারীরা কষ্টসহিষ্ণু। স্বামী ছেড়ে চলে গেলেও এই নারীরাই অনেকে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেন। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়ান।

এ লেখার শুরুতে কামরাঙ্গীরচরের নামকরণের পেছনে যে ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এর বাইরে আরও কিছু মত প্রচলিত আছে। এ এস এম ইউনুছের কামরাঙ্গীর চরের ইতিকথা বইতে লেখক লিখেছেন, বর্তমানে রাজনারায়ণ ধর রোড সংলগ্ন শ্মশানঘাট এলাকাটি একসময় চর বা দ্বীপের মতোই ছিল। এখানে মানুষ ‘কামরাঙ্গীর’ মতো দেখতে একধরনের মরিচ চাষ করত। সে সময়ে ব্রিটিশ সার্ভেয়ার এলাকাটি জরিপকালে ‘কামরাঙ্গা’র মতো মরিচের জমি থেকে এই মৌজার নাম রাখেন ‘কামরাঙ্গীরচর’।

তৃতীয় কারণ, মোগল আমলে বাদশা জাহাঙ্গীরের বিবি মরিয়মের নামে একটি কামান ছিল, যেটি তলিয়ে যায় বুড়িগঙ্গায়। অনেক বছর পর চর জাগলে কামানটি পাওয়া যায় নতুন চরে। সেই থেকে চরটির নাম হয় ‘কামানের চর’। পরবর্তী সময়ে বিবর্তনের মাধ্যমে শব্দটি ছড়ায় ‘কামরাঙ্গীরচর’।

এ ছাড়া নামকরণের পক্ষে আরও কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক-গবেষক। তবে নাজির হোসেনসহ সব গবেষকই কম-বেশি উপরিউক্ত কারণগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন।

কামরাঙ্গীরচর সংলগ্ন অন্য চরগুলোর মধ্যে রয়েছে নবাবচর, বাক চান খাঁর চর, জঙ্গলবাড়ির চর, হামলাইর চর, শ্রীখণ্ডের চর, দুখু মিয়ার চর, সোনাটেঙ্গর চর। এর মধ্যে কিছু নাম পরে বদলের কবলে পড়েছে। বইপত্র ঘেঁটে জানা যায়, প্রায় পৌনে তিন শ বছর আগে এই চরে জনবসতির শুরু। এই চরের বেশির ভাগ জমির মালিক ছিলেন ভাওয়াল রাজা। ১৯১২ সালে তা তৎকালীন সরকারের হাতে চলে যায়। বর্তমানে চরের জনসংখ্যা ১২ লাখের কম নয়।

সারা কামরাঙ্গীরচর একটি ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে ছিল। সেই সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন অনেক দিন ধরেই বিলুপ্ত। সিটি করপোরেশনের অধিভুক্ত হওয়ার পর তিনটি ওয়ার্ডে বিভক্ত চরটি। চরটিতে মসজিদ-মাদ্রাসার অভাব নেই। ১৯৬৫ সালে এখানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করেন হাফেজ্জি হুজুর।

শেষ করা যাক বুড়িগঙ্গা গণপাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক শহীদ হোসেনকে দিয়ে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। কথা হচ্ছিল পাঠাগার থেকে বই চুরি নিয়ে। পাঠাগারটিতে বই ছিল ১ হাজার ৩০০, যা এখন ৬০০। শহীদ বিশ্বাস করেন, যেসব ছেলেমেয়ে বই নিচ্ছে, তারাই একদিন ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। পড়তে পড়তে তাদের মধ্যে একধরনের বোধ তৈরি হবে যে বই চুরি করা অন্যায়।

এ দর্শন সাধারণ একজন ইট-বালু ব্যবসায়ীর। বিকশিত হওয়ার পথ থেকে কামরাঙ্গীরচরকে কে বিচ্যুত করবে?