রোম শহরের বুকে আস্ত এক দেশ ভ্যাটিকান সিটি

আয়তনে বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ ভ্যাটিকান সিটি। রোমান ক্যাথলিক গির্জার ধর্মগুরুদের আবাসভূমি এটি। ভ্যাটিকান সিটি থেকে গির্জার সরকার বা ধর্ম যাজকীয় শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেন পোপ। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ধর্মযাজক ও সন্ন্যাসীরাই মূলত এখানকার বাসিন্দা। এখানে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা গির্জাসহসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবনের অবস্থান। ১৯২৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভ্যাটিকান সিটি স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি পায়। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ১৯৮৪ সালে ভ্যাটিকান সিটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের এলাকা ঘোষণা করে। আজ মঙ্গলবার দেশটির স্বাধীনতা লাভের ৯৬ বছর পূর্ণ হলো। বিশেষ এই দিনটিতে ভ্যাটিকান সিটির আদ্যোপান্ত জেনে নেওয়া যাক।

ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কয়ারছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

ইতালির রোম শহরের ভেতরে ছোট একটি দেশ ভ্যাটিকান সিটি। নামের সঙ্গে সিটি থাকলেও এটি বিশ্বের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ এবং রোমান ক্যাথলিক গির্জার সদর দপ্তর। ক্ষুদ্র এ দেশটির প্রায় চারপাশটাই পাথরের দেয়ালে ঘেরা। দেয়ালগুলোর ভেতর আছে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা নামের বিশাল এক গির্জা, ভ্যাটিকান প্যালেস এবং আরও কিছু ভবন। ভ্যাটিকান প্যালেসের ভেতরে পোপের ভবন, জাদুঘর, একটি গ্রন্থাগার এবং সিস্টিন চ্যাপেল ভবনের অবস্থান।

ইতালির তাইবার নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ভ্যাটিকান একসময় জলাভূমি ছিল। আজার ভাতিকানাস নামে পরিচিত অঞ্চলটি রোমান সাম্রাজ্যের শুরুর দিকের বছরগুলোতে প্রশাসনিক অঞ্চলে পরিণত হয়, সেখানে বিলাসবহুল স্থাপনা গড়ে ওঠে।

সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা গির্জার শুরু যেভাবে

৬৪ খ্রিষ্টাব্দে রোমের বেশির ভাগ অংশ আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর ভ্যাটিকান হিল নামের পাহাড়ের পাদদেশে খ্রিষ্ট ধর্মপ্রচারক সেন্ট পিটারসহ আরও কয়েকজন খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন সম্রাট নিরো। সেখানেই তাঁদের সমাধি হয়। ৩১৩ সালে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন রোমান সম্রাট প্রথম কনস্টানটাইন। এরপর ৩২৪ সালে তিনি সেন্ট পিটারের সমাধির ওপর একটি গির্জা নির্মাণের কাজ শুরু করেন। দ্রুতই জায়গাটি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে জনপ্রিয় তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। সেখানে বাণিজ্যিক এলাকাও গড়ে ওঠে।  

৭৫০ শতকের পর ইতালির মধ্যাঞ্চলের বেশির ভাগই পোপদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এসব জায়গা পপাল স্টেটস বা পোপের রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। ৮৪৬ সালে আরবদের হামলায় সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা গির্জাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৎকালীন পোপ চতুর্থ লিও পবিত্র এ গির্জাকে সুরক্ষিত রাখতে এটি এবং আশপাশের স্থাপনাগুলো ঘিরে দেয়াল নির্মাণের আদেশ দেন। ৮৫২ সালে ৩৯ ফুট দীর্ঘ দেয়াল নির্মাণের কাজ শেষ হয়। ১৬৪০ শতকে পোপ তৃতীয় উরবানের সময়ে দেয়ালগুলো ক্রমাগত বিস্তৃত করা হয়।

সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

শুরুতে পোপেরা নিকটবর্তী লেটেরান প্যালেসে থাকতেন। তবে ষষ্ঠ শতকের শুরুর দিকে পোপ সিমাকুস সেন্ট পিটার্সের পাশে একটি বাসভবন গড়ে তোলেন। কয়েক শ বছর পর পোপ তৃতীয় ইউজিন এবং পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ত এটিকে বিস্তৃত করেন। ১২৭৭ সালে এ অবকাঠামোটির সঙ্গে ক্যাস্টেল সান্ট অ্যাঞ্জেলোকে সংযুক্ত করতে আধা মাইল দৈর্ঘ্যের একটি পথ তৈরি করা হয়। তবে ১৩০৯ সালে পোপের প্রশাসনিক কেন্দ্রকে ফ্রান্সে সরিয়ে নেওয়ার পর এসব ভবন পরিত্যক্ত হয়ে যায়। পরবর্তী অর্ধশতক ধরে শহরটি দৈন্যের মধ্যে ছিল।

১৩৭৭ সালে পোপের শাসনব্যবস্থা ফ্রান্স থেকে আবারও রোমে ফিরিয়ে আনা হয়। তখন ধর্ম যাজকেরা দেয়ালঘেরা ভ্যাটিকান সিটিতে দ্যুতি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তৎপর হন। ১৪৫০ সালে পোপ নিকোলাস ভি চিরকা অ্যাপোস্টলিক প্যালেসের নির্মাণকাজ শুরু করেন। অবশেষে তার উত্তরসূরিদের জন্য স্থায়ী বাড়ি নির্মাণ হয়। তাঁর সংগ্রহে থাকা বইগুলো দিয়ে গড়ে তোলা হয় ভ্যাটিকান লাইব্রেরি। ১৪৭০-এর দশকে বিখ্যাত উপাসনালয় সিস্টিন চ্যাপেলের কাজ শুরু করেন চতুর্থ সিক্সতুস।

বর্তমানে ভ্যাটিকান পোপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফ্রান্সিস
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

১৫০৩ সালে পোপ হিসেবে দ্বিতীয় জুলিয়াস দায়িত্ব নেওয়ার পর শহরটিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়। তিনি সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ১২০০ বছরের পুরোনো ভবনটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তিনি ইতালীয় স্থপতি দোনাতো ব্রামান্তেকে এটি নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তবে ১৫১৩ সালে জুলিয়াসের মৃত্যু এবং পরের বছর ব্রামান্তের মৃত্যুর পর এই প্রকল্প চালিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে অচলাবস্থা তৈরি হয়। অবশেষে ১৫৪৭ সালে ইতালীয় ভাস্কর মিকেলাঞ্জেলো সে অচলাবস্থার অবসান ঘটান এবং ব্রামেন্তোর মূল নকশা অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৫৯০ সালে এর আকর্ষণীয় গম্বুজের কাজ শেষ হয়। আর বিশাল অবকাঠামোটির চূড়ান্ত কাজ শেষ হয় ১৬২৬ সালে। ৫ দশমিক ৭ একর জায়গাজুড়ে তৈরি করা গির্জাটি ৪৫২ ফুট লম্বা। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গির্জার মর্যাদা ধরে রেখেছিল।

আর ভ্যাটিকান জাদুঘর গড়ে তোলা হয় দ্বিতীয় জুলিয়াসের সংগ্রহে থাকা ভাস্কর্য দিয়ে। পরে অন্য পোপেরা ওই জাদুঘরের সংগ্রহ বাড়াতে থাকেন।

স্বাধীনতার স্বীকৃতি

১৮৭০ সালে ইতালীয় সরকার ভ্যাটিকান সিটির দেয়ালের বাইরের সব ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে। গির্জা কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের মধ্যে পরবর্তী প্রায় ৬০ বছর ধরে বিরোধ চলেছে। শেষ পর্যন্ত ১৯২৯ সালে দুই পক্ষের মধ্যে ল্যাটেরান প্যাক্টস নামের চুক্তি হয়। চুক্তির আওতায় ভ্যাটিকান সিটিকে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শুধু তা–ই নয়, পপাল রাজ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে গির্জাকে ৯ কোটি ২০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।

বাসিন্দা কারা

পোপসহ গির্জা সরকারের শত শত সদস্য ভ্যাটিকান সিটিতে থাকেন ও কাজ করেন। পোপের সুরক্ষায় নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনী সুইস গার্ডের বেশ কিছু সদস্যও তাঁদের পরিবার নিয়ে সেখানে থাকেন। ভ্যাটিকান সিটিতে প্রায় তিন হাজার মানুষ কাজ করেন। এ কর্মীদের বেশির ভাগই রোমে থাকেন। বেশির ভাগ মানুষ ইতালীয় ভাষায় কথা বলেন। তবে সরকারি কাগজপত্র এবং গির্জার কিছু অনুষ্ঠানে লাতিন ভাষা ব্যবহার করা হয়।

ভ্যাটিকান মিউজিয়াম প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীরা
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

ভ্যাটিকান সিটির অর্থনীতি অন্য দেশের অর্থনীতি থেকে আলাদা। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার রোমান ক্যাথলিকরা তাঁদের স্থানীয় গির্জাগুলোতে অনুদান দেন। ভ্যাটিকান সিটি সেখান থেকে কিছু অর্থ পায়। বই, স্ট্যাম্প, কয়েন এবং স্যুভেনিরও বিক্রি করে ভ্যাটিকান। জাদুঘর পরিদর্শনে আসা পর্যটকদের মাধ্যমেও আয় করে থাকে ভ্যাটিকান।

বর্তমানে জর্জ মারিও বেরগোগলিও পোপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পোপ ফ্রান্সিস নামেও পরিচিত। অসুস্থতার কারণে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট পদত্যাগ করার পর ২০১৩ সালের মার্চে কার্ডিনালরা ফ্রান্সিসকে পোপ নির্বাচিত করেন। আর্জেন্টিনার বংশোদ্ভূত ফ্রান্সিস লাতিন আমেরিকা অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হওয়া প্রথম কোনো পোপ। ওই সময় তাঁর বয়স ছিল ৭৬ বছর।

ক্যাথলিক গির্জার প্রায় ১২০ কোটি অনুসারীর কাছে ভ্যাটিকান সিটি একটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। ১০৯ একর জায়গা নিয়ে দেশটি গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন দূরবর্তী এলাকায় ভ্যাটিকানের মালিকানাধীন আরও ১৬০ একর জায়গা আছে। ভ্যাটিকান সিটির নিজস্ব ব্যাংকিং ব্যবস্থা, টেলিফোন ব্যবস্থা, ডাকঘর, ফার্মেসি, সংবাদপত্র, রেডিও এবং টিভি স্টেশন আছে। ২০২৩ সালের এক হিসাব অনুসারে সেখানকার বাসিন্দার সংখ্যা ৭৫০ জনের কিছু বেশি।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, ব্রিটানিকা, হিস্ট্রি ডট কম