আজীবনের স্বপ্ন, অনেক বছরের অপেক্ষা: পবিত্র হজের অনুভূতি কার কাছে কেমন
মুতিউল্লাহ কুরেশি একজন ভারতীয়। মাকে নিয়ে পবিত্র হজ পালন করা ছিল তাঁর সেই ছোটবেলার স্বপ্ন। পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করার পর অবশেষে এ বছর তাঁর হজ পালনের স্বপ্নপূরণ হচ্ছে। পবিত্র মক্কা থেকে মুতিউল্লাহ বলছিলেন, ‘মা যখন পবিত্র কাবা দেখলেন, কাঁদা শুরু করলেন। বছরের পর বছর জমানো অর্থ ও সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা এবার সার্থক হলো। এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’
বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে চলতি বছর হজ পালন করতে আসা লাখ লাখ মুসল্লির একজন হলেন কুরেশি। হজ পালন করা ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। সুস্থ ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলিম নারী–পুরুষের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ পালন করা ফরজ।
কুরেশির মতো ধর্মপ্রাণ অনেক মুসলমান তাঁদের হজ পালনের স্বপ্ন পূরণ করতে পারছেন। তবে হাজার হাজার মানুষ হজ পালনের অনুমতি পেতে অপেক্ষায় থাকছেন বছরের পর বছর।
যা হোক, কুরেশির হজের সফর খুব সহজ ছিল না। সে কথাই বলছিলেন তিনি, ‘২০১৯ সালে আমি পরবর্তী বছর হজ পালনের জন্য টাকা জমা দিই। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা মহামারি দেখা দেয়। শুরু হয় লকডাউন। আমাকে টাকা ফেরত দেওয়া হয়। এতে সেবার হজ পালনে যেতে পারিনি। আমার হৃদয় ভেঙে যায়।’
এ ঘটনার পর কুরেশি সরকারিভাবে হজ পালনে যাওয়ার আবেদন করেন। পরে এ বছর মা, স্ত্রী ও বড় বোনকে নিয়ে হজ পালন করার অনুমতি পেয়েছেন। সৌদি আরবে রওনা দেওয়ার আগে তিন শিশুসন্তানের দেখাশোনা করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়েছে তাঁকে।
২০১৯ সালে আমি পরবর্তী বছর হজ পালনের জন্য টাকা জমা দিই। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা মহামারি দেখা দেয়। শুরু হয় লকডাউন। আমাকে টাকা ফেরত দেওয়া হয়। এতে সেবার হজ পালনে যেতে পারিনি। আমার হৃদয় ভেঙে যায়।মুতিউল্লাহ কুরেশি, ভারতীয় নাগরিক
কুরেশি বলেন, ‘আমার ভাই দুবাইয়ে ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করেন এবং ভাবি ভারতে থাকেন। আমি ভাবিকে দুবাইয়ে রেখে এসেছি। এখন ভাই ও ভাবি আমার সন্তানদের দেখছেন। বাচ্চাদের বয়স ১২, ৯ ও ২ বছর।’
এই ভারতীয় নাগরিকের মতে, হজযাত্রায় তাঁর কঠিনতম কাজ ছিল দুই বছরের বাচ্চাটাকে দুবাই রেখে চলে আসা। কুরেশি বলেন, ‘ও আমাকে ভীষণভাবে টানে। আমি ওর শূন্যতা অনুভব করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তবে এটা ভেবে আমি স্বস্তি পাই যে হজরত ইব্রাহিমকে (আ.) এ মরুপ্রান্তরে (পবিত্র কাবার স্থানে) তাঁর শিশুসন্তানকে রেখে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।’
দিন দিন বিশ্ব কাছাকাছি আসছে। অথচ ভিন দেশের পাসপোর্টধারী দম্পতি যাঁরা এক সঙ্গে হজ পালনে যেতে চান, তাঁদের জন্য পথ আটকে রাখা হয়েছে। এতে খানিকটা হতাশ আমি।এম. হোসাইনি, জার্মানির নাগরিক
ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে ইব্রাহিম (আ.) তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে নির্জন ওই মরুপ্রান্তরে রেখে চলে যান। পরে তৃষ্ণায় কাতর শিশু ইসমাইল কান্না শুরু করেন। এ সময় পানির খোঁজে হাজার (হজরত ইব্রাহিমের স্ত্রী) দৌড়ে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সাতবার ওঠানামা করেন। এরপর ইসমাইলের পায়ের আঘাতে জমজম কূপের পানিপ্রবাহ ঘটান সৃষ্টিকর্তা।
পাঁচ হাজার বছর পর আজও জমজম কূপ সচল রয়েছে। এ কূপ পবিত্র মক্কায় পানি সরবরাহের অন্যতম উৎস। প্রতিবছর হজ পালনে যাওয়া লাখ লাখ মুসল্লির তৃষ্ণা মেটে এ কূপের পানি থেকে।
হজ পালনের অনুমতির অপেক্ষায় থাকেন হাজারো মানুষ
কুরেশির মতো ধর্মপ্রাণ অনেক মুসলমান তাঁদের হজ পালনের স্বপ্ন পূরণ করতে পারছেন। তবে হাজার হাজার মানুষ হজ পালনের অনুমতি পেতে অপেক্ষায় থাকছেন বছরের পর বছর। সংযুক্ত আরব আমিরাতের নূরা টি. তাঁদেরই একজন। তিনি বলেন, ‘বোন ও ভাইয়েরা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হজ পালনে যাওয়ার জন্য আমি আবেদন করেছি। কিন্তু প্রতিবছর সীমিতসংখ্যক লোক এ অনুমতি পান। আমাদের সেই সুযোগ এখনো আসেনি।’
৩৪ বছর বয়সী এই নারী তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে হজ পালনে যেতে দেখেছেন। কিন্তু নিজে যেতে না পারায় উদ্বিগ্ন তিনি। বলেন, ‘গত বছর আমার এক বন্ধু হজ পালনে যান। তিনি বলেছেন, বেশ পরিশ্রমের কাজ এটি।’ নূরা আরও বলেন, ‘আমি যত শিগগির সম্ভব হজ পালনে যেতে চাই, যেন সব ঠিকঠাক আদায় করতে পারি।’
হজের ক্ষেত্রে বেশকিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। এ জন্য মক্কায় থাকতে হয় অন্তত চার দিন। হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় আরাফার দিন। ৯ জিলহজ আরাফার ময়দানে উপস্থিতির পর হাজিরা চলে যান মুজদালিফায়। সেখানে উন্মুক্ত প্রান্তরে রাত কাটিয়ে পরদিন মিনার উদ্দেশে রওনা দেন তাঁরা। মিনার জামারায় শয়তানকে লক্ষ করে তাঁদের কঙ্কর ছুড়তে হয়। সেখান থেকে পবিত্র মসজিদুল হারামে গিয়ে তাওয়াফ সম্পন্ন করেন।
আইনকানুনের জটিলতা
মুসলিম জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের জন্য হজযাত্রীদের সংখ্যা নিয়ে কোটা নির্ধারণ করা আছে। গড়ে মোট মুসলিমের সংখ্যার এক শতাংশ এটি। আবার, তাঁদের জন্য সৌদি আরবে থাকার স্থান রয়েছে নির্ধারিত।
হজ পালনের অনুমতির ক্ষেত্রে বেশি সমস্যায় পড়া দম্পতিদের জন্য বাধা হয়ে ওঠে আন্তদেশীয় পাসপোর্টের বিষয়টি। এম. হোসাইনি ও সালমান আলী এমন এক দম্পতি। হোসাইনির পাসপোর্ট জার্মানির। আর তাঁর স্বামীর পাকিস্তানের।
হোসাইনি বলেন, ‘আমরা পাকিস্তান ও জার্মানির বেশ কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা আমাকে এমনকি নির্দেশনাটুকু দেয়নি। কেননা, এমন পাসপোর্টে হজ পালনে যাওয়ার প্রক্রিয়া জটিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে প্রতিবারই এটি আরও কঠিন হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে।’
হজ পালনে যেতে এখন এ দম্পতি নানা বিকল্প সমাধান খুঁজছেন। দ্বিতীয় পাসপোর্ট করা, এগুলোর একটি।
‘জার্মানি দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদন করে থাকে। তাই আমি পাকিস্তানি পাসপোর্ট করার কথা ভাবছি’, বলেন হোসাইনি। আরও বলেন, ‘দিন দিন বিশ্ব কাছাকাছি আসছে। অথচ ভিন দেশের পাসপোর্টধারী দম্পতি যাঁরা একসঙ্গে হজ পালনে যেতে চান, তাঁদের জন্য পথ আটকে রাখা হয়েছে। এতে খানিকটা হতাশ আমি।’