কৃষক যখন প্রেসিডেন্ট

অভিষেকের দিন পেদ্রো কাস্তিলিও
ছবি: এএফপি

কৃষক, শিক্ষক, সংগঠক, প্রেসিডেন্ট। ব্যক্তি একজন। কিন্তু তাঁর পরিচয় চারটি।

তা কী করে হয়! হয়। বিরলভাবে হয়। এই যেমন পেদ্রো কাস্তিলিওর ক্ষেত্রে হয়েছে।

অন্যতম দরিদ্র এলাকার ছোট্ট এক গ্রামে ১৯৬৯ সালে পেদ্রোর জন্ম। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। মা-বাবা দুজনই অক্ষরজ্ঞানহীন। পেশা তাঁদের কৃষি। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান হলে যেমনটা হয়, পেদ্রোর বেলাতেও তা–ই হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই মা–বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করে বেড়ে উঠেছেন তিনি।

কৃষিকাজ করলেও পড়াশোনায় ছাড় দেননি পেদ্রো। কিন্তু তাঁর স্কুল ছিল অনেক দূরে। বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে দুই ঘণ্টার বেশি সময় হেঁটে তবেই স্কুলে পৌঁছাতে হতো পেদ্রোকে।

পড়াশোনার খরচ জোগাতে কিশোর ও তরুণ বয়সে পেদ্রোকে কফিখেতে কাজ করতে হয়েছে। আইসক্রিম বিক্রি করেছেন। রাজধানীতে গিয়ে বিক্রি করেছেন সংবাদপত্র। এমনকি হোটেলের টয়লেটও পরিষ্কার করেছেন। এভাবে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হন তিনি।

শিক্ষাজীবন শেষে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হন পেদ্রো। ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল। ২৫ বছর এ পেশায় নিজেকে নিযুক্ত রাখেন তিনি। শিক্ষকতা করার একপর্যায়ে পেশাগত ইউনিয়নে যুক্ত হন তিনি।

২০০২ সালে রাজনীতিতে নাম লেখান পেদ্রো। তখন তিনি মেয়র পদে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে হেরে যান তিনি।

পেদ্রো আলোচনায় আসেন ২০১৭ সালে। স্কুলশিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধিসহ অন্যান্য দাবিতে ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেন তিনি। এ আন্দোলন তাঁকে পরিচিতির পাশাপাশি জনপ্রিয়তা এনে দেয়। সেই হলো তাঁর শুরু। তারপর পেদ্রো যে মিশনে নামেন, এর গল্প অনেকটা এমন—‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’।

এলাকায় সোনার বৃহৎ খনি আছে। কিন্তু সেখানকার মানুষের জীবনে এর ন্যূনতম প্রভাবও নেই। তারা গরিবের মধ্যেও গরিব। ধনী-গরিব, গ্রাম-শহরের মধ্যকার বৈষম্য বিস্তর। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ ও গরিব জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নেই। নেই স্বীকৃতি। এসব বিষয় পেদ্রোকে মূলধারার রাজনীতিতে নামতে প্রভাবিত করে।

২০২১ সালে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ান পেদ্রো। প্রথম দফার নির্বাচনে অখ্যাত এ প্রার্থীকে কেউ হিসাবের খাতায় রাখেনি। কিন্তু রাজনীতিতে নবিশ পেদ্রোই দেখান চমক। প্রায় দেড় ডজন প্রার্থীকে পেছনে ফেলে প্রথম দফায় প্রথম হন তিনি।

দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে পেদ্রোর প্রতিপক্ষ কিকো ফুজিমোরি। এবার কঠিন লড়াই। বামপন্থী বনাম ডানপন্থী। পেদ্রো বামপন্থী। কিকো ডানপন্থী।

ক্ষমতার রাজনীতির কেন্দ্রসহ শহরাঞ্চলে পেদ্রো অচেনা। আগন্তুক। ‘আউটসাইডার’। তবে গ্রামীণ এলাকায় তিনি ইতিমধ্যে পরিচিত মুখ। সেখানে তিনি ‘আমি তোমাদেরই লোক’।

নির্বাচনী প্রচারে পেদ্রো তাঁর গ্রামীণ পরিচয়ই তুলে ধরেন। তিনি কৃষকের মতো মাথায় গোল হ্যাট পরে প্রচারে অংশ নেন। তিনি তাঁর প্রচারে দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনের কথা বলেন। সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা বলেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন। তাঁর প্রচারের কেন্দ্রে ছিল জনগণ। তিনি বলেন, ধনী দেশে কোনো গরিব থাকবে না।

অন্যদিকে, পেদ্রোর প্রতিপক্ষ কিকোর জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক পরিবারে। তাঁর বাবা দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। একসময় কিকো ফার্স্ট লেডির দায়িত্বও পালন করেছেন। পরে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে নামেন। একাধিকবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। শহুরে, ধনিক, এলিট ও ব্যবসায়ী শ্রেণির মধ্যে তাঁর পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা আছে। রাজনীতির মারপ্যাঁচও তিনি ভালো জানেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি পেদ্রোকে ধরাশায়ী করার সব চেষ্টাই করেন। তার অংশ হিসেবে পেদ্রোকে উগ্রবাদী বামপন্থী হিসেবে অভিহিত করা হয়। বলা হয়, সশস্ত্র কমিউনিস্ট গেরিলা গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র আছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন পেদ্রো।

কিকো ফুজিমোরি
ছবি: রয়টার্স

গত ৬ জুন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। ১৫ জুন ভোট গণনা শেষ হয়। পেদ্রো পান ৫০ শতাংশের কিছু বেশি ভোট। কিকো পান ৪৯ শতাংশের কিছু বেশি।

ভোট গণনা শেষ হতেই পেদ্রো নিজেকে জয়ী দাবি করেন। পরাজয় মানতে অস্বীকৃতি জানান কিকো। তিনি নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তোলেন।

শুরু হয় অভিযোগ পর্যালোচনা। পর্যালোচনায় প্রায় দেড় মাস সময় লেগে যায়। গত ১৯ জুলাই ঘোষণা করা হয় চূড়ান্ত ফলাফল। কিকোকে ৪৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেন পেদ্রো।

জীবনে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়েই জয় পান পেদ্রো। তাঁর এ জয়ে বড় ভূমিকা রাখেন গ্রামীণ ভোটাররা। গ্রামীণ এমন অনেক কেন্দ্র আছে, যেখানে কিকো ভোটই পাননি।

গত ২৮ জুলাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন পেদ্রো। চারটির (কৃষক, শিক্ষক, সংগঠক, প্রেসিডেন্ট) মধ্যে তিনি নিজেকে কোন পরিচয় দিতে পছন্দ করেন, এর উত্তর পাওয়া গেল শপথের দিন।

অভিষেক ভাষণে পেদ্রো সগৌরবে জানিয়ে দেন, এই প্রথম তাঁর দেশ পেরু একজন কৃষক দ্বারা পরিচালিত হবে।