হন্ডুরাসে মাতৃত্ব যখন হয়ে ওঠে যন্ত্রণার কারণ
২০১৫ সালের নভেম্বর। একদিন বাড়ির কাছের নদী থেকে পানি আনতে গিয়েছিলেন ফাউসিয়া। সেখানে দুই ব্যক্তি তাঁকে মারধর করে গলায় ছুরি ধরে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাদের একজনের হাতে ধর্ষণের শিকার হন তিনি। কিছুদিন পর জানা যায়, তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন।
সেই ঘটনার ৮ বছর পর ৩৪ বছর বয়সী এই নারী জাতিসংঘের কাছে অভিযোগ করেন, তাঁর দেশ হন্ডুরাসে গর্ভপাতের সুযোগ দেওয়া হয় না। ফলে তাঁকে বাধ্য হয়ে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের জন্ম দিতে হয়েছে।
হন্ডুরাসসহ লাতিন আমেরিকার ছয়টি দেশে গর্ভপাত পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
ফাউসিয়ার এই লড়াইয়ে সহায়তা দিচ্ছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর রিপ্রোডাক্টভ রাইটস (সিডিআর)।
গত মার্চে ফাউসিয়া এ ঘটনা জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটিতে তোলেন। তিনি হন্ডুরাসের সংবিধানে থাকা লিখিত এই নিষেধাজ্ঞার বিধান তুলে নেওয়ার আদেশ দিতে আরজি জানান।
স্থানীয় নেতার মেয়ে ও ভূমি অধিকার কর্মী ফাউসিয়া বলেন, জায়গাজমি নিয়ে বিরোধের ‘প্রতিশোধ’ নিতে ওই দুই ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে এমনটি করেছে। তাদের পরিবার তাঁর বাবার জায়গা দখল করে নিয়েছিল। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে পারিবারিক বিরোধ চলছিল।
উইমেন রাইটস সেন্টারের বাগানে ফাউসিয়ার সঙ্গে কথা হয় বার্তা সংস্থার এএফপির। তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। তারা আমাকে বলেছিল, আমি এ নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে তারা আমাকে হত্যা করবে। আমার পরিবারকে শেষ করে দেবে।’
ফাউসিয়া আরও বলেন, ধর্ষণের এক মাস পর তিনি ভয় কাটিয়ে কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হন। এরপর শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ আইনি যাত্রা। এর মধ্যে যখন তিনি জানতে পারেন যে তিনি অন্তঃসত্ত্বা, তখন তাঁর পুরো পৃথিবী ভেঙে পড়ে।
ফাউসিয়া বলেন, ‘এটি একটি বড় ধরনের মানসিক ধাক্কা। এটি এমন একটি বিষয়, যা আমি চাইনি।’
এল সালভাদর, নিকারাগুয়া, ডোমিনিক প্রজাতন্ত্র, হাইতি, সুরিনেম ও হন্ডুরাসে গর্ভপাত নিষিদ্ধ; এমনকি এটি ধর্ষণের কারণে হলেও।
কিন্তু ফাউসিয়া যখন এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছেন, তখন তাঁকে বলা হলো, তিনি গর্ভপাত করলে তাঁর ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
ফাউসিয়া বলছিলেন, ‘সন্তান প্রসবের সময় আমি অঝোরে কাঁদছিলাম। তারা আমাকে দিয়ে অনেকটা জোর করিয়ে নবজাতককে দুগ্ধ পান করিয়েছে, চুমুও দিতে হয়েছে। আমার যদি এটিকে শেষ করে দেওয়ার সুযোগ থাকত, আমি সেটা করতাম। কারণ, এ ঘটনা আমার জীবনকে তলিয়ে দিয়েছে। এ এক অমোচনীয় ঘটনা।’
ফাউসিয়ার সেই সন্তানের এখন কী অবস্থা, জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলেননি।
জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি নিষিদ্ধ
এল সালভাদর, নিকারাগুয়া, ডোমিনিক প্রজাতন্ত্র, হাইতি, সুরিনেম ও হন্ডুরাসে গর্ভপাত নিষিদ্ধ; এমনকি এটি ধর্ষণের কারণে হলেও। গত বছর পর্যন্ত হন্ডুরাসে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি নিষিদ্ধ ছিল। তাই দুই সন্তানের মা ফাউসিয়াও সে সময় এ ধরনের বড়ি খেতে পারেনি।
ফাউসিয়া যখন তাঁর জীবনের এই দুঃসময়ের স্মৃতিচারণা করছিলেন, তখন তাঁর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি বলেন, হুমকি ও হয়রানির কারণে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে অন্তত ১০ বার থাকার জায়গা পাল্টাতে হয়েছে, এমনকি শহরও ছাড়তে হয়েছে। তিনি এতটাই বিষণ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে একবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন।
২০১৭ সালে ফাউসিয়ার সেই ধর্ষকেরা গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা যথেষ্ট প্রমাণ পাননি বলে কয়েক মাসের মধ্যেই তারা ছাড়া পেয়ে যায়।
কিন্তু সিডিএম ও সিডিআরের সহায়তায় ২০১৮ সালে মামলাটি আবার চালু হয়েছে। ধর্ষণের আট বছর পর অপরাধীরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। তবে অপরাধীরা চাইলে মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন
হন্ডুরাসে প্রতিদিন ১৪ বছরের কম বয়সী তিনটি মেয়েশিশু ‘ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা বা মা’ হতে বাধ্য হয়। দেশটির ২০২২ সালের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যের বরাত দিয়ে সিডিআর এমন কথা জানিয়েছিল।
সিডিআরের লাতিন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কাতালিনা মার্তিনেজ বলেন, আইনজীবীরা ফাউসিয়া ও তাঁর পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন। পাশাপাশি তাঁর প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। একই সঙ্গে তারা হন্ডুরাসে গর্ভপাতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আদেশ চেয়েছেন।
মার্তিনেজ বলেন, এ ঘটনা হয়তো লাতিন আমেরিকায় নারীদের প্রজনন অধিকারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। জাতিসংঘের কমিটির মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন হতে তিন বছরের মতো সময় লেগে যেতে পারে।
ফাউসিয়া যখন এএফপির সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তাঁর হাতে বাঁধা ছিল সবুজ রঙের রুমাল, যা গর্ভপাতের দাবিতে লড়াইয়ের প্রতীক। তিনি বলেন, ‘আমি যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছি, আর যাতে কাউকে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে না হয়, সেই কঠিন লড়াইয়ের জন্য আমি প্রস্তুত।’
লাতিন আমেরিকায় হাতে গোনা কয়েকটি দেশে—মেক্সিকো, কলম্বিয়া, কিউবা ও উরুগুয়ে—গর্ভপাত বৈধ।