সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি মাদুরো
ভেনেজুয়েলায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট আজ রোববার। আজকের এই ভোটকে লাতিন আমেরিকার দেশটির আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
১১ বছর ধরে দেশটিতে ক্ষমতায় আছেন প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো। এবার তিনি তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে চান। নির্বাচনে তাঁর প্রতিপক্ষ এডমান্ডো গঞ্জালেজ উরুতিয়া। আজকের নির্বাচনকে মাদুরোর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ভোটের আগের বিভিন্ন জরিপ বলছে, গঞ্জালেজের চেয়ে প্রায় ৪০ পয়েন্টে পিছিয়ে আছেন মাদুরো। তবে মাদুরো নির্বাচনে হেরে গেলে তিনি তা মেনে নেবেন কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষক-সমালোচকেরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
দেশটির ভোটারেরা ভেনেজুয়েলার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক দমনপীড়নের নিয়ে হতাশ, ক্ষুব্ধ।
অভিযোগ আছে, ক্ষমতা ধরে রাখতে সমাজতান্ত্রিক নেতা মাদুরো তাঁর প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতাদের দমনপীড়ন করে আসছেন। তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী রাজনীতিককে গ্রেপ্তার করেছেন। কাউকে কাউকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণা করেছেন।
চাভেজের জন্মদিনে ভোট
ভেনেজুয়েলায় প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের জন্মদিন আজ ২৮ জুলাই। তিনি ২০১৩ সালের ৫ মার্চ মারা যান।
মাদুরো নিজেকে চাভেজের অনুসারী ও উত্তরাধিকার হিসেবে দাবি করেন। চাভেজের জন্মদিনেই (আজ) দেশটিতে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট হচ্ছে।
নির্বাচনপূর্ব জরিপ
নির্বাচনপূর্ব একাধিক জরিপের ফল বলছে, মাদুরো তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী গঞ্জালেজের চেয়ে বড় ব্যবধানে পিছিয়ে আছেন। ব্যবধানটা এত বড় যে তা গোছানো অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।
জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ওআরসি কনসালটোরেসের সমীক্ষা অনুযায়ী, মাদুরোর প্রতি সমর্থনের হার মাত্র ১২ দশমিক ৫। বিপরীতে গঞ্জালেজের পক্ষে ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশের সমর্থন আছে।
ডেটা ফার্ম ডেলফোস ও আন্দ্রেস বেলো ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির সমীক্ষা অনুযায়ী, মাদুরোর প্রতি সমর্থনের হার প্রায় ২৫। তিনি গঞ্জালেজের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। তাঁর প্রতি সমর্থনের হার ৫৯ শতাংশের বেশি।
মাদুরো কেন এত অজনপ্রিয়
মাদুরো তাঁর পূর্বসূরি চাভেজের মতো জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করেছেন। তবে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
মূলত ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি মারাত্মক সংকটে রয়েছে।
অর্থনৈতিক সংকট দেশটিতে উচ্চমূল্যস্ফীতি ও গুরুতর আর্থিক চাপের সূত্রপাত করে। এ অবস্থায় কাজের সন্ধানে দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে শুরু করে ভেনেজুয়েলার লোকজন।
দেশের বাজে পরিস্থিতির জন্য কিছু সমালোচক মাদুরো ও তাঁর সহযোগীদের দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির অবনতির জেরে ভেনেজুয়েলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নিষেধাজ্ঞা ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকটকে আরও জটিল করে তোলে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়াশিংটন অফিস অন ল্যাটিন আমেরিকার ভেনেজুয়েলাবিষয়ক কার্যক্রমের পরিচালক লরা ডিব আল-জাজিরাকে বলেন, বাজে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য দেশটির জনগণ মরিয়া।
লরা ডিব আরও বলেন, ভেনেজুয়েলায় ন্যূনতম মজুরি প্রতি মাসে প্রায় ১৩০ ডলার হতে পারে। কিন্তু দেশটিতে একটি পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণে দরকার পড়ে প্রায় ৫০০ ডলার।
কত লোক ভেনেজুয়েলা ছেড়েছে
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, তা বোঝার সম্ভবত সবচেয়ে ভালো সূচক হতে পারে দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্যমতে, ২০১৪ সাল থেকে ৭৭ লাখের বেশি মানুষ ভেনেজুয়েলা ছেড়েছে। এটি আধুনিক ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাস্তুচ্যুতির অন্যতম ঘটনা। এখনো প্রতি দিন প্রায় ২ হাজার মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
কিছু বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা করছেন, মাদুরো যদি টানা তৃতীয় মেয়াদে জয়ী হন, তাহলে এই সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে।
নির্বাচনী লড়াই
৬১ বছর বয়সী মাদুরো ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে তৃতীয় দফায় ছয় বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে চান।
ভেনেজুয়েলার দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক কর্মসূচি ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান অব্যাহত রাখার মাধ্যমে চাভেজের উত্তরাধিকার বজায় রাখতে চান মাদুরো।
মাদুরোর বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইয়ে আছে বিরোধী দলগুলোর একটি জোট, যারা নিজেদের ইউনিটারি প্ল্যাটফর্ম বলে।
বিরোধী এই জোটে নানা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির লোকজন আছে। তবে সবার লক্ষ্য হলো মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন।
ইউনিটারি প্ল্যাটফর্মের নেতারা বলছেন, তাঁরা জয়ী হলে ভেনেজুয়েলায় পরিস্থিতির উন্নতি হবে। অভিবাসী হওয়া ব্যক্তিরা তখন দেশে ফিরে আসবেন।
বিরোধী প্রার্থী গঞ্জালেজ (৭৪) একজন সাবেক কূটনীতিক। তাঁর ব্যাপারে মাদুরোর অভিযোগ, তিনি বিদেশি শক্তির দালাল। তিনি জিতলে সামাজিক কার্যক্রমগুলোকে বেসরকারীকরণ করবেন, যাতে দরিদ্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সবশেষ নির্বাচনে কী হয়েছিল
পক্ষপাতমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থার অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ হিসেবে দেশটির বিরোধীরা মূলত ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। সেই নির্বাচনে মাদুরো ৬৭ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হন।
তবে আঞ্চলিক সংগঠন অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস বলে, ২০১৮ সালের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মান পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষকেরা বলেন, ভোটার উপস্থিতি ছিল রেকর্ড পরিমাণ কম।
এবারের নির্বাচনী প্রক্রিয়া কি সুষ্ঠু
এককথায়, ‘না’।
মাদুরোর প্রতিদ্বন্দ্বী গঞ্জালেজ বিরোধী জোটের প্রথম পছন্দের প্রার্থী ছিলেন না। এমনকি তিনি দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থীও ছিলেন না।
মাদুরো সরকার জনপ্রিয় বিরোধী রাজনীতিক মারিয়া করিনা মাচাদোকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাধা দেয়। তাঁর স্থলে আরেকজনের নাম প্রস্তাব করা হয়। তাঁর পরিণতিও একই হয়। তারপরই গঞ্জালেজকে প্রার্থী করা হয়।
এ ছাড়া দেশটির বিভিন্ন বিরোধী রাজনীতিককে বিভিন্ন অভিযোগে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সমালোচকেরা এসব অভিযোগকে ভুয়া বলছেন।
সরকার কী বলছে
সরকারের অভিযোগ, মাচাদোর মতো বিরোধী রাজনীতিকেরা মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টায় জড়িত ছিলেন। তাঁরা ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে নিষেধাজ্ঞা দিতে উৎসাহিত করেছিলেন।
মাচাদো দুর্নীতিগ্রস্ত বলেও অভিযোগ মাদুরো ও তাঁর সহযোগীদের।
হারলে মাদুরো কি ক্ষমতা ছাড়বেন
নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিরোধীদের আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তবে মাদুরো পরাজিত হলে কী হতে পারে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে।
অনেকের আশঙ্কা, ফলাফল যা-ই হোক না কেন, মাদুরো নিজেকে জয়ী ঘোষণা করতে পারেন। আবার ক্ষমতা ধরে রাখতে তিনি আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেন। মাদুরো নিজেই ১৭ জুলাই এক সমাবেশে বলেছিলেন, তিনি বিজয়ী না হলে ভেনেজুয়েলায় ‘গৃহযুদ্ধ’ হতে পারে।
অঞ্চলটির বিভিন্ন দেশের সরকার ভেনেজুয়েলার ভোটারদের রায়ের প্রতি সম্মান জানাতে ইতিমধ্যে মাদুরোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।