পালিয়ে গিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন এই প্রেসিডেন্ট, ১৬ বছর ছিলেন জেলে
ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন। পরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এক দশক রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। দমন–পীড়নের জন্য একপর্যায়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের। কারাদণ্ড হয়, জেল খাটেন ১৬ বছর। গতকাল বুধবার মারা গেছেন তিনি।
এই রাজনৈতিক জীবন আলবার্তো ফুজিমোরির। লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুর প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। ৮৬ বছর বয়সে রাজধানী লিমায় নিজ বাড়িতে মারা যান ফুজিমোরি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে ভুগছিলেন।
ফুজিমোরির এক দশকের শাসনামলে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল লিমায় জাপানের দূতাবাসে চার মাসের জিম্মির ঘটনা। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে এটার শুরু। অবশেষে দূতাবাসে কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে এ নাটকীয় ঘটনার ইতি টানেন ফুজিমোরি। তুপাক আমারু গেরিলাদের হাতে জিম্মি সব ভিআইপিকে মুক্ত করা হয়। জিম্মির ঘটনায় জড়িত ১৪ জন নিহত হন।
১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পেরুর ক্ষমতায় ছিলেন ফুজিমোরি। বামপন্থী শাইনিং পাথ বিদ্রোহীদের কঠোর হাতে দমনের জন্য অনেকের কাছে প্রশংসনীয় ব্যক্তি তিনি। অন্যদিকে নির্মম ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে অনেকেই তাঁর তুমুল সমালোচনা করেন।
একের পর এক অবরোধ, নির্বিচার হত্যা ও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা—এ তিনটি বিষয় মিলিয়ে আলবার্তো ফুজিমোরির শাসনকালকে বিবেচনা করেন বিশ্লেষকেরা।
দেশে প্রত্যর্পণের পর বিচারের মুখোমুখি হতে হয় ফুজিমোরিকে। ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। টানা ১৬ বছর জেলও খাটেন। কিন্তু শেষের দিকে শরীরটা ভালো থাকত না। দুর্বলতা, পিঠে ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টে ভুগতেন। এ জন্য বারবার হাসপাতালেও যেতে হয়েছে তাঁকে।
মানবিক কারণে গত বছর কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় ফুজিমোরিকে। আর এ বছরের জুলাইয়ে তাঁর মেয়ে কেইকো ফুজিমোরি জানান, ২০২৬ সালে পেরুর পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে চান তাঁর বাবা।
কিন্তু শারীরিক অবস্থার কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। ফুজিমোরির পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র এএফপিকে জানায়, গত আগস্টে জিহ্বায় ক্যানসারের চিকিৎসা শেষ করার পর থেকেই ফুজিমোরির শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে যায়।
জাপানি অভিবাসী পরিবারে জন্ম ফুজিমোরির। পেরুর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল সামান্য। কিন্তু দেশটির সামরিক বাহিনী তাঁকে বেশ সমর্থন জুগিয়েছিল। পেরুর বিদ্রোহী গোষ্ঠী শাইনিং পাথ ও তুপাক আমারুদের দমনে ফুজিমোরি ও তাঁর কট্টর নিরাপত্তা প্রধান ভ্লাদিমিরো মোন্তেসিনোসের নীতি-উদ্যোগ আলোচিত হয়ে আছে।
রাজনৈতিক বিরোধীদের কঠোর হাতে দমনের কারণেও ফুজিমোরির পরিচিতি রয়েছে। ১৯৯২ সালে তিনি অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আইনসভা ভেঙে দেন। মোন্তেসিনোস আর সামরিক প্রধান ছাড়া তখন এটা কেউ জানতেন না।
দূতাবাসে জিম্মির ঘটনা
পেরুর রাজধানী লিমায় ১৯৩৮ সালের ২৮ জুলাই আলবার্তো ফুজিমোরির জন্ম। কৃষি প্রকৌশলীর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। কিন্তু পেশাজীবন শুরু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণিতের প্রভাষক পদে।
ফুজিমোরি ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন। গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। পরে দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ পদে চাকরিতে যোগ দেন।
রাজনীতিতে আসাটা অনেকটা হঠাৎ করে। ১৯৯০ সালে লেখক মারিও ভারগাস লোসাকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ফুজিমোরি। তাঁর এ বিজয় বেশ অবাক করা ছিল।
ফুজিমোরির এক দশকের শাসনামলে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল লিমায় জাপানের দূতাবাসে চার মাসের জিম্মির ঘটনা। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে এটার শুরু। অবশেষে দূতাবাসে কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে এ নাটকীয় ঘটনার ইতি টানেন ফুজিমোরি। তুপাক আমারু গেরিলাদের হাতে জিম্মি সব ভিআইপিকে মুক্ত করা হয়। যাঁরা জিম্মি করেছিলেন, তাঁদের ১৪ জন নিহত হন।
এ ঘটনা দেশে-বিদেশে ফুজিমোরির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থান প্রশংসা পায়।
১৯৯১ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত শাইনিং পাথ গেরিলাদের দমন করতে গিয়ে পেরুর সেনাবাহিনীর হাতে এক শিশুসহ ২৫ জনকে হত্যার ঘটনায় বিচার শুরু হয় ফুজিমোরির। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম চলে। ওই বছরে আদালত সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেন।
পালিয়ে গিয়ে পদত্যাগ
লাতিন আমেরিকার খনিসমৃদ্ধ দেশ পেরু। খনিজ সম্পদ দেশটির অন্যতম রপ্তানিপণ্য। নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে পেরুর অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে জনপ্রিয়তা বাড়াতে সক্ষম হন ফুজিমোরি।
ফুজিমোরির অর্থনৈতিক নীতি ছিল নয়া-উদারনৈতিক। শাসকশ্রেণি ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক সমর্থন পায় এ নীতি।
এত কিছুর পরও শেষ রক্ষা হয়নি। সেনাবাহিনীর ডেথ স্কোয়াডের দুটি হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় সমালোচিত হয় ফুজিমোরি সরকার। মানবতাবিরোধী অপরাধে নাম জড়ায় প্রেসিডেন্ট ফুজিমোরির। এটা তাঁর এক দশকের শাসনামলের অন্যতম কালো অধ্যায় বিবেচনা করা হয়।
সহযোগী মোন্তেসিনোসের দুর্নীতির খবর চাউর হলে ২০০০ সালে ফুজিমোরির গদি নড়ে ওঠে। জাপানে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট ফুজিমোরি। সেখান থেকে ফ্যাক্স করে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
পেরুর কংগ্রেসের ভোটাভুটিতে ফুজিমোরিকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তাঁকে ১০ বছরের জন্য সরকারি দপ্তরে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে তাঁকে জাপান থেকে পেরুতে প্রত্যর্পণ করা হয়। দেশের মাটিতে পা দেওয়া মাত্র গ্রেপ্তার হন সাবেক এই প্রেসিডেন্ট।
২৫ বছরের কারাদণ্ড
১৯৯১ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত শাইনিং পাথ গেরিলাদের দমন করতে গিয়ে পেরুর সেনাবাহিনীর হাতে এক শিশুসহ ২৫ জনকে হত্যার ঘটনায় বিচার শুরু হয় ফুজিমোরির। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম চলে। ওই বছরে আদালত সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেন।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আলবার্তো ফুজিমোরি একাই নন, তাঁর মেয়ে কেইকো–ও আইনি ঝামেলায় জড়িয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
স্ত্রী সুশানা হিগুচি ১৯৯৪ সালে ফুজিমোরিকে ডিভোর্স দেন। পরের বছরই সুশানা সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে মাঠে নামেন। কিন্তু ফুজিমোরি নতুন একটি আইন পাস করান। এর ফলে প্রেসিডেন্টের পরিবারের সদস্যদের নির্বাচনে লড়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
মা-বাবার বিচ্ছেদের পর মেয়ে কেইকো ফুজিমোরি পেরুর ফার্স্ট লেডির দায়িত্ব পালন করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর।
হাসপাতাল থেকে কারাগারে
যাহোক, কারাগারে থাকা অবস্থায় ফুজিমোরি বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। একাধিকবার হাসপাতালে যেতে হয় তাঁকে। হৃদ্রোগ ও পাকস্থলীর জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।
একই সময়ে ফুজিমোরির জিহ্বায় ক্যানসারের কোষ শনাক্ত হয়। এসব অপসারণে একাধিকবার অস্ত্রোপচার করতে হয় তাঁর।
২০১৭ সালে পেরুর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পেদ্রো পাবলো কুজিনস্কি দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ফুজিমোরির সাজা মওকুফ করেন। মূলত ফুজিমোরির শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি মাথায় রেখে পেরু সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তে বাদ সাধেন পেরুর সুপ্রিম কোর্ট। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে হাসপাতাল থেকে ফুজিমোরিকে আবারও কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
তারপর ফুজিমোরির কারামুক্তির বিষয়টি আলোচনার বাইরে চলে যায়। কিন্তু বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ডিসেম্বরে মানবিক বিবেচনায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
সাবেক প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন পেরুর প্রধানমন্ত্রী গুস্তাভো আদ্রিয়ানজেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তাঁর (আলবার্তো ফুজিমোরি) সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের এটা জানাতে চাই যে তাঁর মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।’