কিউবার মানুষ দলে দলে কেন দেশ ছাড়ছেন

হাভানার নেল পারাদিসো রেস্তোরাঁর প্রধান ওয়েটার নোবার্তো ভাজকুয়েজ এক ওয়েটারের সঙ্গে কথা বলছেন। ২৫ জানুয়ারি তোলা
ছবি–এএফপি

কিউবার অন্য অনেক ব্যবসার মতো নেল পারাদিসোর রেস্তোরাঁ কর্মীসংকটে ভুগছে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে রাজধানী হাভানার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই রেস্তোরাঁ থেকে ৫০ কর্মী চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। দ্বীপদেশটি ছেড়ে এসব কর্মীর অনেকে বিদেশে চলে গেছেন।

কর্মী নিয়োগের দায়িত্বে থাকা এই রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক অ্যানি জুনিঙ্গা বলছিলেন, কর্মীরা চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের বদলি কর্মী পাওয়ার মতো যথেষ্ট সময় তাঁরা পাচ্ছেন না।  

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে নেল পারাদিসো রেস্তোরাঁ দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণ কমে আসার পর রেস্তোরাঁ খুললেও কর্মীর অভাবে দুই মাসের বেশি চালাতে পারলেন না। সংক্রমণ কমে আসার পর হাভানার ঘনিষ্ঠ মিত্র নিকারাগুয়া কিউবার নাগরিকদের ভিসা ছাড়াই তাদের দেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।

নিকারাগুয়ার এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর কিউবার কর্মীর বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। ২০২১ সালের নভেম্বরে নিকারাগুয়া ভিসা ছাড়াই কিউবার নাগরিকদের সে দেশে যাওয়ার সুযোগ দেয়। ছয় দশক আগে কমিউনিস্ট শাসন শুরুর পর এই প্রথম কিউবা থেকে দলে দলে মানুষ বাইরে যেতে শুরু করে।

ব্যবস্থাপক জুনিঙ্গা বলেন, ‘নিকারাগুয়ার ভিসা ছাড়াই সে দেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়াটা ছিল কিউবার অর্থনীতির জন্য একটা বড় ধাক্কা। আমরা মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে ৫০ কর্মী হারিয়েছি। গত ১৪ মাসে আমরা রেস্তোরাঁয় ৬০ কর্মী নিয়োগ দিয়েছিলাম। এখন আছেন মাত্র ১০ জন।’

চাকরি ছেড়ে যাওয়া এসব কর্মীর বদলি জনবল নিয়োগ সময়সাপেক্ষ এবং বেশ ব্যয়বহুল কাজ বটে।

জুনিঙ্গা বলেন, ‘আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ ও স্থায়ী কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে পারছি না। কারণ, যখন আমরা ভাবছি এই দলটি বেশ ভালো...এরপরই হয়তো একজন এসে বলল, “এটিই আমার শেষ সপ্তাহ। আগামী সপ্তাহে আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।” এটি আমাদের জন্য একটা বিপর্যয়।’

অপরিমেয় যন্ত্রণা
মার্কিন সীমান্ত কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২২ সালে কিউবার ৩ লাখ ১৩ হাজার নাগরিক অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে। কিউবার বেশির ভাগ মানুষ মধ্য আমেরিকা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন। অবশ্য কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ১৪০ কিলোমিাটার  (৮৭ মাইল) সাগর পাড়ি দিয়ে অনেকে ফ্লোরিডা উপকূল দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার চেষ্টা করেন। তবে নৌকায় করে এই পথ পাড়ি দেওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

এমন এক সময় কিউবার মানুষ দলে দলে দেশ ছেড়ে যাচ্ছে, যখন দেশের প্রায় ১ কোটি ১১ লাখ মানুষের বিশাল এক জনগোষ্ঠী বয়স বৃদ্ধির কারণে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন। একই সঙ্গে গত তিন দশকের মধ্যে দেশটি সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।  

কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ-ক্যানেল

কিউবায় মুদ্রাস্ফীতি দিন দিন বাড়ছে, খাবার ও জ্বালানি কেনার জন্য সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বাজারে ওষুধ পাওয়াটা অনেকটা অসম্ভব পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। প্রায়ই বিদ্যুৎ থাকছে না।

নেল পারাদিসোর প্রধান ওয়েটার নোবার্তো ভাজকুয়েজ বলছিলেন, ‘কর্মীর অভাব আমাদের বেশ জটিল অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’ একই সঙ্গে সুমিষ্টভাষী এই অধ্যাপক বলেন, তিনি ৫০ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, যাঁদের কেউ এখন আর কিউবায় নেই।

এই অধ্যাপক বলেন, ‘কিছু ছাত্র আমাকে বলেছেন, “প্রফেসর আমি একটাই চিন্তা করছি, কীভাবে আমি কিউবা ছেড়ে যাব।” তাঁদের এই কথা আমাকে অসহনীয় যন্ত্রণা দিচ্ছে।’

হাভানা ইউনিভার্সিটির এক তথ্যমতে, কিউবার যেসব নাগরকি দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত। তাঁদের বয়স ১৯ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে। কর্মক্ষম মানুষ চলে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি পর্যটনসহ দেশের অনেক শিল্পকারখানা ক্ষতির মুখে পড়েছে। করোনা মহামারির কারণে এমনিতে পর্যটনশিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বার্তা সংস্থাকে জানায়, কিউবার সরকার ও স্প্যানিশ গ্রুপ ইবারস্টারের যৌথ মালিকানাধীন পার্ক সেন্ট্রাল হোটেলের ৩০ শতাংশ কর্মী দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। হোটেলটির নির্বাহীদের এই শূন্যতা পূরণে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।  

উপলব্ধি যখন কোনো ভবিষ্যৎ নেই  
১৯৯৫ সাল থেকে ফরাসি নাগরিক স্তেফান ফেরাক্স হাভানায় একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালান। প্রায় ৬০ এজেন্সি বিদেশে কর্মী পাঠানোর কাজ করে থাকেন। শুধু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কর্মীরা বিদেশে যাচ্ছেন, এমন নয়। অনেকে দেশের বাইরে গিয়ে মাসে কিউবার ৪৫ গুণ বেশি আয় করেন।

ফেরাক্স বলেন, ‘পণ্যের স্বল্পতার কারণে আপনি যখন কোনো কিছু পাবেন না এবং যখন উপলব্ধি করতে শুরু করবেন এখানে কোনো ভবিষ্যৎ নেই, তখন দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের পরিমাণ বাড়বেই।’

এমনকি দূতাবাস ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্ষতির মুখে পড়েছে। গত জানুয়ারিতে বিজ্ঞানের এক অধ্যাপকের ‘বাঁধভাঙা কান্নার’ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। ওই অধ্যাপক বলছিলেন, ‘ল্যাবরেটরিগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থীরা দেশত্যাগ করছেন।’

কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ-ক্যানেল গত অক্টোবরে স্বীকার করেন, কিউবা থেকে মানুষের দেশ ছেড়ে যাওয়ার হার অনেক বেশি। এ জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইনকে দায়ী করে বলেন, তাদের আইন কিউবার মানুষকে দেশত্যাগে উৎসাহ জোগাচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল বলেন, পড়াশোনা ছেড়ে এভাবে তরুণদের অন্য দেশে গিয়ে চাকরি করা দেশের জন্য একটি ‘পরাজয়’।